কবিতা ও যোগাযোগ
৫০ বছর পূর্তির শ্রদ্ধার্ঘ্য
মোহন রায়হান : দায়বদ্ধ স্বপ্নবান কবি
তপন বাগচী
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কবিতায় মোহন রায়হানের অবদানের বিশিষ্টতা অস্বীকার করার উপায় নেই। সদ্য স্বাধীন দেশে শতাব্দীর বিচারে সত্তর দশকে কাব্যাঙ্গনে ‘অজস্র আগুনের ফুল’ ফুটেছিল। তিন দশক না যেতেই সত্তরের শীর্ষ সারির কবিদের মধ্যে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, আবিদ আজাদ, নাসিমা সুলতানা, ত্রিদিব দস্তিদার, সৈকত আসগর, গোলাম সবদার সিদ্দিকী প্রমুখ অকালে প্রয়াত হয়েছেন। কবিতায় মৌলিকত্বের স্বাক্ষর রেখেও সত্তরের অনেকে কবিতা ছেড়ে স্থিত হয়েছেন প্রবন্ধসাহিত্যে: যেমন ড. মোরশেদ শফিউল হাসান, ড. আবুল আহসান চৌধুরী, ড. সলিমুল্লাহ খান প্রমুখ। আবার কবিতার এই দৌড়ে মাঝপথে বিশ্রামে গেছেন অনেক শৌখিন কবি।
কিন্তু শুরু থেকে ক্লান্তিহীন সৈনিকের মতো রাজপথে উদ্যত সঙ্গিন হাতে যাঁরা টিকে আছেন, কবি মোহন তাঁদের সামনের কাতারের একজন। ‘জীবনের জন্য শিল্প’ অভিধা ধারণ করে যাঁরা কাব্যচর্চা করেন মোহন রায়হান তাঁদেরই একজন। তাই বলে শিল্পের দায় পূরণে তিনি অপারগতা দেখাননি। সত্তরের কবিদের সৌভাগ্য যে, তাঁরা একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধকে স্পর্শ করেছেন। কেউ কেউ সক্রিয় অংশগ্রহণের কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।
কেউ কেউ বয়সের সীমাবদ্ধতা এবং পারিবারিক বিধিনিষেধে যুদ্ধে যেতে পারেননি, কিন্তু দেশপ্রেমমুগ্ধ কবি হয়ে স্বাধীনতার পরেও রাজাকারদের বিরুদ্ধে কবিতা হাতে লড়াই করেছেন। কেউ কেউ যুদ্ধে অংশ নিয়েও লোভ এবং সুবিধার কাছে নতজানু হয়েছেন। কেউ কেউ একাত্তরের সক্রিয় অংশগ্রহণের আবেগ ও দর্শন এখনও লালন করেন সাহসিক চিত্তে। এমন মুক্তিযোদ্ধা কবিদের মধ্যে আবিদ আনোয়ার এবং মোহন রায়হানের নাম দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের চিহ্নিত বিপক্ষশক্তির সঙ্গে এরা কোনোভাবেই বিন্দুমাত্র আপস করেননি।
কবি হিসেবে এটিও গৌরবের সমাচার। বহু বছর আগে পড়া মোহন রায়হানের একটি কবিতার চরণ আমার এখনও মনে বাজে :
যদি তুমি আসো
যদি মিছিলে স্লোগান তোলো
আমি দীপ্ত গর্বে বুলেটের মুখে পেতে দেব বুক।
(‘যদি তুমি আসো’, আমাদের ঐক্য আমাদের জয়)
প্রেম ও বিপ্লবের এই শিল্প-সম্মিলন দেখে আমাদের মতো অনেক তরুণ কবি উদ্বুদ্ধ হয়েছিল যুগপৎ কবিতা লিখতে এবং রাজপথে স্লোগান তুলতে। সমকালীন কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর একটি চরণও একই রকম চেতনার ধারক-- ‘মিছিলেই তুমি সবচেয়ে বেশি নারী’। সত্তর কবিদের একটি অংশ নারীকে বিদ্রোহী বিপ্লবী হিসেবে দেখতে চেয়েছেন।
আন্দোলন সংগ্রামকে যাঁরা কবিতার উপজীব্য করে তুলেছেন, কবিতাকে যাঁরা জীবন জাগানোর গান হিসেবে বিবেচনা করেছেন, সত্তরের সেই ধরনের কবিদের মধ্যে মোহন রায়হানের নাম সকলেরই জানা। এই তালিকায় মতিন বৈরাগী, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, ত্রিদিব দস্তিদার, সোহরাব হাসান, আবু করিমের নামও শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চার্য। কবিতাকে এরা জীবনেরই প্রতিরূপ ভাবার চেষ্টা করেছেন।
মোহন রায়হানের কবিসত্তার পাশাপাশি তাঁর সংগঠক-সত্তার বিশ্লেষণও জরুরি। স্কুলজীবন থেকেই তিনি সংগঠন করতেন-- হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা সম্পাদনা যার নজির।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সিরাজগঞ্জে স্থাপিত ‘জয় বাংলা বেতারকেন্দ্রে’ স্বাধীনতার কবিতাপাঠের গৌরবও তিনি বহন করছেন। সাহিত্য-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে তিনি নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন। বাংলাদেশ লেখক শিবির এবং বাংলাদেশ লেখক ইউনিয়নের তিনি নেতা ছিলেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী সংগঠক সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এবং জাতীয় কবিতা পরিষদের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ও রোষের শিকার হয়ে নির্যাতন ভোগ করেছেন কিন্তু আপস করেননি। কবিতার খাতা ছেড়ে সরে দাঁড়াননি। সংগ্রামে এবং শিল্পে এই নিবিষ্টতা, এই দৃঢ়চিত্ত ভূমিকা আজ তাঁকে কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করাতে পারে।
কবিতা কতটা শিল্প, কতটা কালোত্তীর্ণ তা বিচার-বিশ্লেষণের ভিন্ন সময় ও সূত্র রয়েছে। কিন্তু কবিতা ও কবির উপস্থিতি কতটা সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছে, তার মূল্যায়নের সময় এসেছে।
একজন রাজনৈতিক নেতার বক্তব্যের শ্র“তিমাধুর্যের চেয়ে দিকনির্দেশনাই গ্রাহ্য। কবি যখন রাজনৈতিক সত্য উচ্চারণ করেন কবিতার মঞ্চে তখন আমরা শিল্পের করণকৌশলের চেয়ে স্বপ্ন ও সাহসের বাণী চাই। সেই স্বপ্ন ও সাহসকে প্রতীকে-রূপকে কবিতা করে তোলার চেষ্টা করেছেন কবি মোহন রায়হান। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের অপরিপক্বতা কিংবা অগভীরতা নিয়ে আমরা ভাবতে যাই না, সমাজের প্রতি তাঁর দায়বোধের কথা জেনেই আমরা উদ্বুদ্ধ হই। একজন কবির পক্ষে এটিও বিশাল কৃতিত্বের।
মোহন রায়হানের অনেক কবিতার মধ্যে কোনো আড়াল না দেখে কেউ কবিতা বলতে দ্বিধা করতে পারেন। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ কথিত ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’র পাশে ‘কবিতা অনেক রকম’ সংজ্ঞার্থ মাথায় রাখলে সকল ল্যাঠা চুকে যায়। জীবনের তীব্র দাবির কথা বলতে গেলে একটু ঝাঁজ বেরোবেই। ‘সাহসী মানুষ চাই’ কবিতায় সেই কবেই তো মোহন রায়হান ঘোষণা দিয়েছেন : ‘আমাদের জীবনের জন্য আজ শিল্প চাই’। আর তাই তাঁর সিদ্ধান্ত :
তোমাদের লোভাতুর জিভ টেনে ছিঁড়ে নেব আমি
অলীক উচ্চারণে যাঁরা নিজেদের ভেবে থাকো কবি
ভূমিতে শেকড়হীন; যে বৃক্ষ বাড়েনি তার মূলের মাটিতে
সেই শিল্পতরু আজ আমাদের প্রয়োজন নেই।
(‘সাহসী মানুষ চাই’, জ্বলে উঠি সাহসী মানুষ)
মাটির সোঁদা গন্ধে বেড়েওঠা এই কবি রাজধানী ঢাকায় এসে যখন অর্ধসভ্য মানুষগুলোর মুখোশ দেখতে থাকেন, তখন ঘৃণা ও উত্তেজনা প্রকাশ না করে পারেন না :
এই আমার বিংশতি যুবক বুকের অগ্নিময় উত্তুঙ্গ বিক্ষোভ থেকে
নতুন অস্ত্রের মতো ঝলোমলো এই যৌবনের বহ্নিতেজ থেকে
আমি হ্যান্ডগ্রেনেডের মতো আমার প্রচণ্ড রুদ্ররোষ ছুঁড়ে দেই
এইসব বুদ্ধিজীবী লেখক শিক্ষক কবি ঘুণে-ধরা রাজনীতিকের প্রতি।
(‘সাহসী মানুষ চাই’, জ্বলে উঠি সাহসী মানুষ)
আমরা একজন বিপ্লবী মোহন রায়হানের ভেতর রোম্যান্টিক এক প্রেমের কবিকেও প্রত্যক্ষ করি। ভাবলে অবাক হই কতটা উন্মাতাল হলে একজন কবি বলতে পারেন :
এতবড় ঢাকা শহরে
আমাদের চুমু খাওয়ার
এতটুকু আড়ালও নেই।
(‘উদ্বাস্তু’, গোলাপজানের পকেট পঞ্জিকা)
কিংবা,
হে নারী তোমার স্তন
বারুদ ও স্পিন্টারে ঠাসা
যুগল গ্রেনেড
অন্য কোনো করতল
উড়িয়ে গুঁড়িয়ে দিও
ভয়ানক বিস্ফোরক।
(‘যুগল গ্রেনেড’, গোলাপজানের পকেট পঞ্জিকা)
প্রথম কবিতাংশে রোম্যান্টিসিজম আছে, দ্বিতীয় কবিতায় নারীর অঙ্গকে বিপ্লবের হাতিয়ার হিসেবে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় নির্মাণ করা হয়েছে।
তবে একেবারেই নির্ভেজাল নারীপ্রেমের কবিতাও তিনি লিখেছেন কিন্তু তার ভেতরেও সংগ্রামের চেতনা রয়েছে।
মোহন রায়হান সমাজের কাছে দায়বদ্ধ কবিপ্রতিভা। দেশের রাজনৈতিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে বরাবরই প্রতিবাদী। রক্ত, বারুদ, অস্ত্র, লড়াই প্রভৃতি শব্দ তাঁর কবিতায় অনিবার্য উপাদান। কবিতার ভাষায় কর্কশ হওয়ার পেছনের কারণ বোধহয় তাই।
এইসব বিদ্রোহাত্মক শব্দানুষঙ্গ ব্যবহার করেও কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গোলাম কুদ্দুস, শামসুর রাহমান, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ রফিক, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ প্রমুখের কবিতা পেলবতা অর্জন করেছে ছন্দ-অন্ত্যমিল-অলংকারের জন্য। বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা থাকায় কাব্যতত্ত্বের এই সকল বিষয় কবি মোহন রায়হানের অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু বক্তব্যের প্রতি জোর দিতে গিয়ে কবিতার লাবণ্য কিছুটা ক্ষইয়ে ফেলেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। মোহন রায়হান কেবল কবি হলে হয়তো কবিতার জন্য বিশেষ যত্ন নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি নিজের দামি সময়টা ব্যয় করেছেন রাজনৈতিক আন্দোলনে, কবিতার আন্দোলনে; সংগঠন ও উৎসব আয়োজনে।
কেবল নিজের নয়। আরো সকল সুস্থ চিন্তার মানুষকে এক কাতারে নিয়ে এসে অশুভ-অসুন্দরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলতেই সময়-শ্রম-মেধা বিনিয়োগ করেছেন। আমরা যাঁরা কাছ থেকে চিনি, তাঁরা মোহন রায়হানের কবিতায় কর্মকাণ্ডের সমন্বিত রূপটাকেই বিবেচনা করতে চাই। কিন্তু কালের ধূলি ঝেড়ে অনাগত কালের পাঠকের সামনে যখন কেবলি ‘কবিতা’ তখন সেই পাঠক হয়তো অজ্ঞাতসারেই কবিতার প্রতি অবিচার করে বসতে পারেন। অনাগত সেই ঝুঁকি মোকাবেলায় পূর্ব-সতর্কতার বিকল্প নেই।
মোহন রায়হান ব্যক্তিজীবনে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ। সাহিত্যেও তার প্রতিফলন রয়েছে। মানুষের বিপদে ও প্রয়োজনে তিনি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেন। লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে অনেকেই তাঁর সহযোগিতা পেয়েছেন, কারো চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন, কারো ব্যবসার কাজ পাইয়ে দিয়েছেন, কারো অনুষ্ঠানের স্পন্সর জোগাড় করিয়ে দিয়েছেন। সবকিছুই করেছেন তিনি নিঃস্বার্থে।
রাজনৈতিক কারণে জেলখাটার অভিজ্ঞতা তাঁর ব্যাপক। কবিদের মধ্যে মযহারুল ইসলাম, আল মাহমুদ প্রমুখের পাশে মোহন রায়হানের নামও যুক্ত হবে।
সকল কিছুর পরেও মোহন রায়হান কবি, স্বপ্নবান কবি। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর তিনি। সামাজিক পটভূমিকায় বিচার করলে মোহন রায়হানের কবিতার গুরুত্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
[১ আগস্ট কবি মোহন রায়হানের জন্মদিন]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।