আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শাশ্বতকে রক্ষায় রাবিতে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় মিছিল



জাহাঙ্গীর আলম আকাশ, রাজশাহী মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা হলো চিরন্তন-শাশ্বত সত্য। এই সত্যকে বুকে ধারণ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ‘শাশ্বত’ নামের একটি প্রাণকে বাঁচাতে অকৃত্রিম ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। শাশ্বতকে রক্ষায় প্রয়োজন ১৬ লাখ টাকা। এই টাকা সংগ্রহের মহৎ উদ্যোগ নিয়ে মানুষের সম্মিলিত ভালবাসা যোগাড়ের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে গতকাল সোমবার বেলা ১১টায় রাবি ক্যাম্পাসে এক বিরাট র‌্যালী বের করা হয়।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, এই র‌্যালী সম্ভবত স্মরণকালের সবচেয়ে বড়। ‘ছেলেকে যদি সারাজীবনের মতো পঙ্গু দেখতে না চান তাহলে এই মুহূর্তে চারটি ইনজেকশনের ব্যবস্থা করুন। ’ বাবা দাম জিজ্ঞেস করেন। ডাক্তার বলেন, এক একটি দুই লাখ রুপি। বাবা অঙ্ক কষেন, ২ লাখ রুপি করে চারটি মানে আট লাখ রুপি, অর্থাৎ বাংলাদেশী ১৬ লাখ টাকা।

আমার সামর্থ্যে কুলোবে না। ’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের মেধাবি শিক্ষার্থী শাশ্বত সত্যর বাবা অরুণ সত্য প্রিয় সন্তানের চিকিৎসা ব্যয় কী করে জোগাড় করবেন তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই। ‘শাশ্বত সত্য হলো মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা’Ñ চিরন্তন এই মূল্যবোধকে স্লোগান হসেবে নিয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ শ্বাশ্বত’র চিকিৎসা ব্যয় সংগ্রহের উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে সাত লক্ষাধিক টাকা সংগ্রহিত হয়েছে। অর্থাভাবে গত দু’বছর শ্বাশত’র চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে।

বাম পা ও মেরুদণ্ড ইতোমধ্যে একটু বেঁকে গেছে। ডান দিকের হিপ-জয়েন্ট ও পা আক্রান্ত হয়েছে। হাত দিয়ে লিখতে পারে না বেশিক্ষণ, ফুলে যায়। নিজে পোশাক বদলানো, একটানা একঘণ্টার বেশি শুয়ে থাকা, একটানা পনেরো মিনিট বসে বা দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও তার নাই এখন মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যায়, বুকের খাঁচা হৃদপিণ্ড কামড়ে ধরে। শাশ্বত সত্য হাড় ক্ষয় করা দুরারোগ্য ব্যাধি এ্যানকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস-এ আক্রান্ত।

শুরুতে তার বাম পায়ে অল্প ব্যাথা অনুভূত হতোসেই ১৯৯৮ সালে। তারপর তীব্র ব্যাথা। স্থানীয় ডাক্তার ব্যাথানাশক ক্লোফেনাক ইঞ্জেকশন দেন। পরদিন ঠিক একই সময়ে ব্যাথা তীব্রতর হয়। এরপর একে একে বারো দিন একই সময়ে এই ইঞ্জেকশন দিয়ে ব্যাথা কমানোর চেষ্টা চলে।

এরই মধ্যে ব্যাথা পুরো বাম পা থেকে ডান পায়েও ছড়ায়। রাজশাহীতে এসে ড. আজাহারউদ্দিনকে দেখানো হলো। তিনিও সেই ব্যাথানাশক ইঞ্জেকশন এবং সাপোজিটর দেন। ব্যাথা তো কমেই না, বরং এতোটাই বেড়ে যায় যে চলাফেরা বন্ধ হতে বসে। এরপর পা থেকে কোমরে, তারপর গিঁটে গিঁটে।

বিছানা থেকে ওঠার শক্তি হারায় সে। পড়তে ভালোবাসা ক্লাস নাইনের ছেলেটির জীবন তখন বিছানায় বন্দি। মাস তিনেক পর রাজশাহীর একটি ক্লিনিকে ড. তরিকুলকে দেখানোর সাথে সাথে তিনি ভারতে নিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। ছেলেকে প্রতিবন্ধী হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে বাবা-মা ছোটেন কলকাতার পেয়ারলেস হাসপাতালে। জানা গেল তাকে সিরোনেগেটিভ রিউমেটয়েড আর্থারাইটিস নামের নাম না-জানা দুরারোগ্য ব্যধি ধরেছে।

চিকিৎসক হাঁটু থেকে হলুদ এক ধরনের ফ্লুইড বের করলে ব্যাথা কমে আসে। এরপর তিন মাস পর পর চিকিৎসা নিতে হবে বলে ছেড়ে দেন। টানা সাতদিন সেখানে চিকিৎসা চলে। শাশ্বত’র ভাষায়, ‘আমাকে ব্যাথা উঠলেই ইঞ্জেকশন দিয়ে দিত। ব্যাথা কমতো।

আমার মনে হয় আমাকে প্যাথেড্রিন দেয়া হতো। সারাদিন চোখ ভর্তি ঘুম। ’ ফিরে আসার সময় ব্যাথা সামান্য কম থাকলেও দুই মাস পেরোতে না পেরোতেই ব্যাথার তীব্রতা এতোই বাড়ে যে তিন মাসের অপেক্ষা না করেই ছুটতে হয় কলকাতা। ঐ অবস্থাতে ক্লাস না-করে ২০০১ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেয় সে। ফল ৩ দশমিক ৫০।

২০০১ থেকে ২০০৩ এর মে মাস পর্যন্ত মোটামোটি ভালই ছিল শাশ্বত। তার নিজের কথায়Ñ ‘২০০১ থেকে ২০০৩ এর মে মাস পর্যন্ত আমি অনেক ভালো ছিলাম। ব্যাথা প্রায় হতোই না। হলেও কম। কিন্তু মে মাসে হঠাৎ করেই এমন পরিস্থিতি হলো যে আমার পক্ষে এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা চিন্তা করাও অসম্ভব ছিল।

’ ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে ওর শরীরের ওজন ছিল ৬০ কেজি আর ২০০৪ সালের ফেব্রয়ারিতে তা নেমে গিয়েছিল ২৮ কেজিতে। বাহ্যজ্ঞান প্রায় বিলুপ্ত হয়েছিল। দিনে ২/৩ চামচ বার্লির বেশি কিছু খেতে পারতো না, এটুকু খেলেও নীল বমি হয়ে বেরিয়ে আসতো। এবার কলকাতার পেয়ারলেসে না-গিয়ে বাবা নিয়ে গেলেন বেসরকারি এক ক্লিনিকে। সেখানে দু দফা এন্ড্রোস্কপি করে ডাক্তার বললেন, খাদ্যনালী শুকিয়ে গেছে।

বাবা অরুণ সত্য এবার কোলকাতায় আর না-দেখিয়ে নিয়ে গেলেন ভেলোরে ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজে। সেখানেও ডাক্তার জানালেন পিত্তথলী ভর্তি অসংখ্য পাথর। সিরোনেগেটিভ রিউমেটয়েড আর্থারাইটিস তো আছেই। ঔষুধ নিয়ে সে যখন দেশে ফিরে আসে তখন তার উঠে দাঁড়ানোর শক্তি আর অবশিষ্ট নাই। একটার পর একটা ঔষুধে ক্লান্ত শাশ্বতর এবার বুকে ব্যাথা শুরু হয়েছে, আর রাত্রে জ্বর হচ্ছে, শরীর বিছানাগত।

বাবা-মা তার জীবনের আশা ছেড়ে দিলেন। ‘কলকাতায় থাকতে আমি একটা বইতে প্রাণায়ামের বিষয়টি পড়ি। সেটা করে মনের দৃঢ়তা ফিরিয়ে এনে আমি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াই ২০০৬ সালের প্রথমদিকে। তাও কুঁজো হয়ে,’ শাশ্বত বলে। ছেলের এই চেষ্টা অসহায় বাবা-মাকে আশান্বিত করে।

আবার নিয়ে যান ভেলোরে জুন মাসে। চিকিৎসক বললেন, সিরোনেগেটিভ রিউমেটয়েড আরথাইটিস আরো একধাপ এগিয়ে এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস এ রূপান্তরিত হয়েছে। ডাক্তাররা মত প্রকাশ করেন যে বাম পায়ের হিপ জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে এবং শরীরের প্রত্যেকটি জয়েন্ট নষ্ট হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। যদি-না তাকে ৪টি বিশেষ ইনজেকশন অতিসত্ত¡র দেয়া হয় তাহলে তার দেহের অন্যান্য হাড়ের জয়েন্টও নষ্ট হয়ে যাবে। ডাক্তাররা আরোও বলেন, এ রোগের কারণ অজানা এবং তার শরীরে HLA ও ই-২৭ নামক এন্টিবডি তৈরি হয় যা শরীরের ভেতর থেকে উৎপন্ন হয়ে হাড়ের প্রতিটি জয়েন্টে আক্রমণ করে।

হাড়ের জয়েন্টে থাকে ঝুহড়ারধষ মবষষ। কিন্তু এই এন্টিবডি Synovial gell শুকিয়ে দেয় বা নষ্ট করে দেয়। Synovial gell এর কাজ হলো হাড়ের জয়েন্টগুলোর স্বাভাবিক নড়াচড়া নিশ্চিত করা, সেজন্য এটি দুই জয়েন্টের মাঝখানে থাকে। এক্ষেত্রে ডাক্তারের কথিত ইনজেকশনগুলো HLA I B--২৭ কর্তৃক Synovial gell নষ্ট হওয়ার হাত থেকে বাঁচাবে। ডাক্তার বলেন, হিপ জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধি নষ্ট হয়ে গেলে সেটি পরিবর্তন করা যাবে কিন্তু হাতের আঙ্গুলের বা অন্য জয়েন্ট যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তা আর পরিবর্তন করা যাবে না।

তার দেহে ঝুহড়ারধষ মবষষ এর অভাব এতো মারাত্মক যে অস্থিগুলোর জয়েন্ট দ্রুতই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঐখঅ হার্টের উপরেও এ্যাটাক করতে পারে। এজন্য তাকে নিয়মিত Salfasalazine ঔষধ সেবন করতে হয়, যা তার হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করবে। কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তার কিডনীগুলো আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে ইনজেকশগুলো নিলে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই তার সবকিছু রক্ষা পাবে।

রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ২০০৮ সালে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত এই অবস্থাতেই ছিল শাশ্বত। তবুও জগৎ দেখার তীব্র আাকুতিতে সব ব্যাথা-যন্ত্রণা সত্তে¡ও সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। শাশ্বতকে বাঁচানোর জন্য গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের উদ্যোগে “শাশ্বত চিকিৎসা সহায়তা” তহবিল গঠন করা হয়েছে। শাশ্বতকে বাঁচাবইÑ এই প্রত্যয়ে কর্মতৎপরতা অব্যহত আছে। ২টি ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের প্রচেষ্টা চলছে : শাশ্বত চিকিৎসা সহায়তা, সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর: ৩৪২৬০৪৯৮ অগ্রণী ব্যাংক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, রাজশাহী এবং সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর: ১৩৫-১০১-৩৩৭০৫।

Swift Code: DBBL-BD-DH-100, Dutch-Bangla Bank Ltd., রাজশাহী শাখা। জাহাঙ্গীর আলম আকাশ রাজশাহী, বাংলাদেশ ২০০৮-০৭-২১ মোবাইল +৮৮০১৭২০০৮৪৯৪৪ (বি.দ্র. রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক জনাব আ.আ-মামুন এর দেয়া তথ্য ও লেখা থেকে)।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।