প্রথম পর্ব
পানিকে হাইড্রোজেনের উৎস হিসেবে গাড়িতে ব্যবহার করতে পারলে খরচ যেমন কমবে তেমনি কমবে হাইড্রোজেনের উৎস নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাথাব্যথা। কাজেই নিঃসন্দেহে সেটি হবে এনার্জির ইতিহাসে একটা অসাধারণ ব্রেক থ্রু। আসুন পানি দিয়ে চালানো একটি গাড়ি ডিজাইন করা যাক।
পানি থেকে হাইড্রোজেন পাওয়ার জন্য ইলেকট্রোলাইসিস করতে হবে। যেহেতু পানির বন্ধন ভাঙতে শক্তির দরকার তাই আমরা একাজে একটা ব্যাটারি ব্যবহার করবো।
তারপর প্রাপ্ত হাইড্রোজেন গতানুগতিক একটা ইঞ্জিনেই দহন করা হবে। এতে করে যে এনার্জি পাওয়া যাবে তা একাংশ ব্যাটারি চার্জ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে যাতে করে ইলেকট্রোলাইসিস প্রক্রিয়াটি নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে চলতে পারে। যেহেতু এতে প্রডাক্ট পানিই হবে কাজেই এই যন্ত্রটাকে আমরা পারপেচুয়াল মোশন মেশিন নাম দিতে পারি।
বোঝাই যাচ্ছে এটা দিয়ে আর যাই চলুক গাড়ি চলবেনা। উপরন্তু ইলেকট্রোলাইসিস, দহনে এবং মেকানিক্যাল এনার্জিতে রূপান্তরের সময় বেশ কিছু এনার্জি অপচয় হবে।
তাই ব্যাটারি চার্জের জন্য শক্তির প্রাপ্যতা কমতে কমতে তার চার্জ দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাবে।
কিন্তু যারা এই ওয়াটার ফুয়েলড কার বানিয়েছেন বলছেন তারা ইলেকট্রোলাইসিস পদ্ধতিতে পানিকে অসাধারণ দক্ষতার (কম শক্তির অপচয় করে) সাথে ভাঙতে সমর্থ হয়েছেন যা বাকিদের কাছে বিভ্রান্তিকর।
পানি দিয়ে গাড়ি চালানোর ইতিবৃত্ত
১. এসএসসির সময়ই আমরা কেমিস্ট্রি বইতে পড়েছি সোডিয়াম/পটাসিয়াম পানির সাথে তীব্র ভাবে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন তৈরি করে। তীব্রভাবে বিক্রিয়া করলে অন্তত সেইটা আমরা গাড়িতে ইউজ করতে পারবো কি? কিন্তু সোডিয়াম/পটাসিয়াম না হয়ে যদি অপেক্ষাকৃত কম ক্রিয়াশীল বোরন হয় তবে? এই কাজটাই করলেন ইউনিভার্সিটি অব মিনোসোটার জনৈক ছাত্র। এভাবে উপজাত হিসেবে পেলেন বোরন অক্সাইড যা থেকে পুনরায় বোরন তৈরি করে রিইউজ করা যাবে।
কিন্তু সমস্যা হল গণিতে। সমসাময়িক ৪০ লিটারের ট্যাংকের ফুয়েল থেকে যে এনার্জি পাওয়া যায় তাই পেতে হলে এই ব্যবস্থায় আমাদেরকে গাড়িতে ১৮ কেজি বোরন ও ৪৫ লিটার পানি মজুদের ব্যবস্থা রাখতে হবে (যা থেকে তৈরি হবে ৫ কেজি হাইড্রোজেন)। তাহলে একটা গাড়ির ওজন কত হবে?
২. আরেকজন দাবী করলেন তিনি লবণাক্ত পানি দিয়ে গাড়ি তৈরি করতে পারবেন। তিনি একদিন তার উদ্ভাবিত যন্ত্র দিয়ে লবণাক্ত পানি থেকে লবণ পৃথকের চেষ্টা করছিলেন। হঠাৎ দেখলেন তার টেস্টটিউবে আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছে যা দিয়ে তিনি মোমবাতিও জ্বালালেন।
কিন্তু আসলে তার জেনারেটরে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার হচ্ছিল যা লবণ পানির অভ্যন্তরীণ বন্ধন আলাদা করে হাইড্রোজেন বিমুক্তকরণে মাধ্যমে একটা অতি সাধারণ ফুয়েল সেলের মতই কাজ করছিল। আর এতে করে যে পরিমাণ হাইড্রোজেন পাওয়া যাবে তা দিয়ে গাড়ি চালানো যাবে কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্টই সংশয় আছে।
৩. আরেক ভদ্রলোক গাড়িতে স্পার্ক প্লাগের পরিবর্তে ইনজেকটর ব্যবহার করে তা থেকে পানির ধারা প্রবাহিত করে ইঞ্জিন সিলিন্ডারের গায়ে ইলেকট্রিক রেজোন্যান্স সৃষ্টির মাধ্যমে তা থেকে হাইড্রোজেন তৈরির দাবী তোলেন। অবশ্য তার বক্তব্য তিনি প্রমাণ করতে পারেননি। তার আগেই তার মৃত্যু হয়।
যদিও দুর্মুখেরা বলে তাকে হত্যা করা হয়েছিল তার যুগান্তকারী আবিষ্কারের কারণে। তবে এখন পর্যন্ত তা কেবল দুর্মুখের মুখেই শোভা পাচ্ছে।
৪. ২০০৮ সালের জুনে জাপানে এক ধরনের পানিচালিত গাড়ির তৈরির দাবী করে একটি বিশেষ সংস্থা। গ্যালনপ্রতি (১ গ্যালন = ৩.৭৮৫ লিটার) যাবে ১৮৮ মাইল। বিস্তারিত বলতে নারাজ ঐ সংস্থার কর্মকর্তাদের মতে যা বোঝা যায় তা হল এটা আসলে একটা হাইড্রোজেন ফুয়েল যেখানে হাইড্রোজেনের উৎস হিসেবে মেটাল হাইড্রাইড ও পানি ব্যবহার হবে।
কিন্তু মেটাল হাইড্রাইড কি তবে রিপ্লেস করতে হবে না? উত্তরে তারা বলেছেন হাইড্রোজেন তৈরির রিএকশন নিয়ন্ত্রণ করে যন্ত্রটিকে বহুদিন কর্মক্ষম রাখা যাবে। ফলে বহুদিল মেটাল হাইড্রাইড বদলাতে হবেনা। কথা আরো আছে নির্মাতারা এই ধরনের যন্ত্র তৈরিতে যে খরচ দেখিয়েছেন তা এখনও সমসাময়িক অন্যান্য ফুয়েল সেল থেকে বেশি। স্ট্যাক লাইফ যা কিনা এই ধরনের ফুয়েলের পরিচিত একটি সমস্যা তা নিয়েও কিছু বলা হয়নি। সবকিছু দেখে বিশেষজ্ঞরা একে এনার্জি ওয়ার এর যুগে নাম কামানোর ধান্দা হিসেবেই দেখছেন।
৫. যে জিনিসটা আমি সবার শেষে বলার জন্য রেখেছি সেটি আমাদেরই জনৈক আবিষ্কারকের অবদান। পত্রিকায় তার কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা নাই। তবে যতটুকু আছে তা পড়ে যা বুঝেছি তাই বলি।
হাইড্রোজেনের উপস্থিতিতে গ্যাসোলিনের কর্মদক্ষতা বাড়ে এইটা মোটামুটি প্রমাণিত সত্য। এই নিয়ে কিছু পেপারও আছে।
সাধারণত গাড়িতে লীন এয়ার/ফুয়েল রেশিও (স্টয়কমেট্রিক বা বিক্রিয়া হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অনুপাত থেকে অনেক বেশি) মেইনটেইন করলে নক্স (নাইট্রোজেনের অক্সাইডসমূহ) এর এমিশন বহুলাংশে হ্রাস পায় (দহন তাপমাত্রা হ্রাস পায় বলে)। তবে ইঞ্জিনের ওভারঅল ইফিসিয়েন্সী এতে সামান্যই বাড়ে। কিন্তু দহন বিক্রিয়ার গতি কমে বলে গাড়িতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয় দ্রুত। হাইড্রোজেন এই সমস্যা চমৎকারভাবে মিটিয়ে দেয় দহন বিক্রিয়ার গতি বাড়িয়ে। অন্তত কিছু গবেষক তাই দাবী করছেন এখন।
আমি কিন্তু এখানে হাইড্রোজেনকে এয়ার ফুয়েল রেশিও বাড়ানোর কাজে ব্যবহারের কথা বলছি, সরাসরি ফুয়েল হিসেবে নয়। গবেষণায় দেখা গেছে এর ফলে ইঞ্জিনের ইফিসিয়েন্সী সর্বোচ্চ ১২% বাড়ার সুযোগ আছে (যদিও বাস্তবে ৩% এর বেশি কেউ করে দেখাতে পারেননি) এবং নক্স এমিশন ৯৮% পর্যন্ত কমতে পারে। এসব এখন পর্যন্ত নিরীক্ষণের পর্যায়েই আছে।
আমাদের আবিষ্কারকের আবিষ্কার নিয়ে বিভিন্ন রকম তথ্য পত্রিকায় দেখেছি। কোথাও দেখলাম তিনি শুধু পানি দিয়েই গাড়ি চালিয়ে দেখিয়েছেন ।
সেক্ষেত্রে ৪নং পয়েন্ট অনুসারে তিনি অবশ্যই পানিকে ফুয়েল হিসেবে ব্যবহার করছেন না বরং অন্য কিছু (যেমন মেটাল হাইড্রাইড) কে করছেন। আর আরেক জায়গায় দেখলাম তিনি তেলের সাথে পানি (যা থেকে পের হাইড্রোজেন) ব্যবহার করার দাবী করেছেন। সেক্ষেত্রে ইফিসিয়েন্সী তিনি যতটা যতটা বাড়বে বুঝিয়েছেন তার ধারেকাছে যাওয়ার প্রশ্নই আসছে না (৫নং পয়েন্ট)। দেড় লিটার পানিতে ৯০০ কিমি! এই পরিকল্পনা দিয়ে বড় সড় একটা নদী দেখে পাওয়ার প্ল্যান্ট বানানোর উদ্যোগ নেওয়াটাই যৌক্তিক ছিলনা কি?
আমি ভদ্রলোকের আবিষ্কারকে খাটো করে দেখছি না শুধু বলবো এই নিয়ে এখনই উচ্ছসিত হওয়ার কিছু নাই। তার গবেষণার ফলাফল নিরীক্ষণের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে তার কৌশল সম্পর্কে তথ্য প্রমাণের অভাব।
যেটুকু পাওয়া যায় তাতে এই পরিকল্পনা ভিত্তিহীন বলেই মনে হয়। তিনি যে স্বল্প মূল্যে গাড়িতে এমন সুযোগ দেবার কথা বলেছেন তা সন্দেহের উদ্রেককারী। শুধু পানিতে যেমন গাড়ি চালানো অসম্ভব তেমনি তিনি যে দেড় লিটার পানিতে ৯০০ কিমি গাড়ি চালানোর কথা বলেছেন সেটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। গাড়ির মাইলেজ, কৌশলের খুটিনাটি এবং সেলের স্ট্যাক লাইফ কত হবে বা ইঞ্জিনের লাইফ টাইম কত হবে অর্থাৎ কত দিন পর পর সেল বদলাতে হবে এইসব খুটিনাটি তাকে সময় নিয়ে উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে দেখাতে হবে। কম দামে ইঞ্জিন তৈরি করলেই হবেনা সেই ইঞ্জিন আদৌ টিকবে কিনা তা দেখতে হবে।
তবে এত কিছু করার আগেই যদি তার কৌশলে ত্রুটি কিংবা শঠতা ধরা পরে যায় তবে তার প্রজেক্টের সম্ভাবনার সেখানেই মৃত্যু লিখে দেয়া যায়। । ওয়াটার ফুয়েলড কার সম্পর্কে জনৈক বিশেষজ্ঞের অভিমতটাই আমার শেষ কথা হিসেবে তুলে দিচ্ছি-
"As Carl Sagan used to say, extraordinary claims require extraordinary evidence. The next time you hear about a water car, remember that and don't get your hopes up too quickly.
We'd be the first to be overjoyed if it really worked (we're not against the idea), but before we jump around, we'll need some serious evidence and not just PR stunts that don't really explain anything (and that are probably designed to lure investors)."
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।