আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ব্রিক লেন: অভিবাসী নারীর আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠার কাহিনী

সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...

ব্রিক লেন চলচ্চিত্রটির মূল থিমটির সঙ্গে অপর্ণা সেনের পরমা ছবিটির মিল আবিষ্কার করা কঠিন কিছু নয়। বহুদিন ধরে স্বামী-সন্তানসেবী গৃহিণী বাইরের এক তরুণের সংস্পর্শে এসে হঠাৎ আবিষ্কার করে যে সংসার নামের আধা-বন্দীশালায় জীবনের কতকগুলো বছর সে অর্থহীন কাটিয়ে দিয়েছে, নিজের দিকে তাকাবার ফুরসৎ হয়নি, এমনকি প্রয়োজনও বোধ করেনি। তরুণের সান্নিধ্যে তার জীবন হঠাৎ অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে; জীবনের যে কত রূপ-রস আস্বাদন করা বাকি ছিল, হৃদয়ে ও শরীরে যে এতটা অনির্বচনীয় সুখ-উচ্ছ্বাস-কামনা এতদিন অনাবিষ্কৃত ছিল -- তা ক্রমশ ধরা পড়তে থাকে। গৃহিণী থেকে সে প্রেমিকা হয়ে ওঠে, মধ্য-ত্রিশ মহিলা থেকে সে প্রথম-প্রেমে-পড়া তরুণীর মতো সপ্রতিভ হয়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে। দুই চলচ্চিত্রের মধ্যে প্রায় দুই দশকের ব্যবধান, ভারতীয় প্রথাগত সমাজ যেমন পরমাকে প্রথমত মানতে পারেনি, দুই দশক পরে লন্ডন শহরের ব্রিক লেনে বাস করা অভিবাসী বাংলাদেশী/সিলেটিরাও মনিকা আলির বেস্ট-সেলার উপন্যাসটির কপি পুড়িয়েছে, পরিচালক সারা গ্যাভরনের ব্রিক লেন ছবির শুটিঙের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে।

উপন্যাস বা ছবিটি বাংলাদেশী কমিউনিটিকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে, এই ছিল অভিযোগ। স্পষ্টভাবে বললে গৃহিণী নাজনীন ও তার প্রেমিক করিমের মধ্যকার পরকীয়া সম্পর্ককে মানতে পারেনি বাংলাদেশী কমিউনিটি। প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির নির্মাতা সারা গ্যাভরনের প্রথম কাহিনীচিত্র এটি। ছবির নাম ব্রিক লেন হলেও লন্ডনের ব্রিক লেন বা বাংলা টাউনকে যেমন খুব বেশি ছবিতে দেখা যায়না -- স্বল্পালোকিত ইনডোরে বেশিরভাগ দৃশ্য চিত্রায়ত হয়েছে, তেমনি নাইন-ইলেভেনের ঘটনার পরে অভিবাসী মুসলমানদের অস্তিত্ব জাতিগত ঘৃণার মুখে সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ার পরও এটি কোনো রাজনৈতিক ছবি নয়। বরং আশির দশকে বসবাস শুরু করা একটি অভিবাসী বাংলাদেশী পরিবারের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট ও সম্পর্ক এবং সেই পরিবারের গৃহিণী নাজনীনের আত্মপ্রত্যয়ী নারী হিসেবে রূপান্তরের কাহিনী এটি।

ডায়াস্পোরা জনগোষ্ঠীর সার্বিক সঙ্কট হয়তো ছবিতে উঠে আসেনি, বরং একটি ডায়াস্পোরিক পরিবারের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট, সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ছবির ন্যারেটিভে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে চিত্রায়িত হয়েছে। নাজনীনের বালিকাবেলা কাটতো ছোট বোন হাসিনার সঙ্গে সবুজ-সমৃদ্ধ ধানক্ষেত কিংবা হলুদ সর্ষেক্ষেতের ভেতর দৌড়াদৌড়ি করে, পুকুর পাড়ের মাচায় পা-দুলিয়ে আচার-চাটনি খেয়ে। তার মায়ের আত্মহত্যার পর তার জীবন পাল্টে যায়। স্বতস্ফূর্ত গ্রামীণ জীবন থেকে মাত্র ১৭ বছর বয়সে এক ধাক্কায় সে আছড়ে পড়ে লন্ডনের ব্রিকলেন শহরের একটি ফ্ল্যাটে, স্থূলদেহ-কদাকার-অহঙ্কারী চানুর বৌ হিসেবে। বাংলাদেশের গ্রামের মুক্ত আকাশের নিচে দৌড়াদৌড়িতে যে অভ্যস্ত তার দায়িত্ব পড়ে ব্রিকলেনের একটি ফ্ল্যাটের বয়েসী স্বামী, দুই কন্যাকে সেবার-দেখভালের।

তার ঘরের বাইরে যাওয়া বলতে যখন কেনাকাটার প্রয়োজন হয়। বড় মেয়ে শাহানা, বয়স ১৩, পশ্চিমা সংস্কৃতিই যার কাছে সহজাত; এজন্য বাবা চানুর বিরাটা মাথাব্যথা এই মেয়েটি, যাকে সে ব্যঙ্গ করে 'মেমসাহেব' বলে ডাকে। ছোট মেয়ে বিবি অবশ্য নিজ সংস্কৃতি ডিঙোয় না, প্রথাগত বাংলাদেশী, বাবার অনুগত ও মৃদুভাষী। ছবি শুরুর প্রথম পর্যায়ে চানু তার অফিসের চাকরি ছেড়ে দেয়, কারণ তার ট্যালেন্টকে অফিস মূল্যায়ন করেনি, বহু প্রত্যাশিত প্রমোশনটি সে পায়নি। চানুর চাকরি ছাড়া ও ক্যাবচালকের পরবর্তী কাজ পাবার মধ্যে কেটে যায় অনেকদিন, সুদখোর এক মহিলার কাছ থেকে গোপনে ধার করে সংসার চালায় সে, এমনকি লোকমুখে-শোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার পদের একটি চাকরি পাবার জন্য যোগাযোগ করতে কম্পিউটার কিনে বসে, ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন করে।

তবে প্রতিবেশী ছাঁটা-চুলের ও সিগারেটে-অভ্যস্ত, স্বনির্ভর-নারী রাজিয়ার পরামর্শে ও সহায়তায় নাজনীন ঘরে বসে সেলাইয়ের কাজ শুরু করে এবং সংসারের হাল ধরে। এই কাজের সূত্রেই তার দরজায় টোকা দেয় করিম, বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের কাটা-জিন্স পৌঁছে দেয়া এবং সেলাই শেষে সংগ্রহ করা যার কাজ। করিম যখন কাজের সূত্রে নাজনীনের কাছে আসে তখন স্বামী থাকে বাইরে এবং মেয়েরা স্কুলে। তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে, নাজনীন জীবনে এই প্রথম প্রেমে পড়ে, তাদের মধ্যে অবলীলায় শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। করিমের সঙ্গে প্রেম ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা নাজনীনকে পাল্টে দেয়।

সে প্রগলভ হয়, স্বামীর সঙ্গে প্রথমবার বেড়াতে গিয়ে (এতদিন পরে এই প্রথম সে বাকিংহাম প্যালেস দেখে) প্রচুর হাসাহাসি করে, উচ্ছ্বাসে ভেসে যায়। চানু মেয়েদের বলে যে, দেখো তোমাদের মা দেশে যাবার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে বলে কত খুশি। কিন্তু চানুর এই মন্তব্যে নাজনীনের হাসি দপ করে নিভে যায়। কারণ এতদিন ধরে সে যা বলে এসেছে, যে সে দেশে যেতে চায়, বোন হাসিনার সঙ্গে পত্রালাপ যাকে বারবার দেশের কথা মনে করিয়ে দেয়, সেই নাজনীন এখন সম্ভবত আর দেশে যেতে চায়না। লন্ডনেই সে তার নিজস্ব ঠিকানা-আশ্রয় এতদিনে খুঁজে পেয়েছে যেন।

কিন্তু চানুর পক্ষে নাজনীনের এই রূপান্তর টের পাওয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি, সে দেশে ফেরার বন্দোবস্ত করতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু বড়ো মেয়ে শাহানা মোটেই দেশে ফিরতে চায়না, ব্রিটেনই তার দেশ; বাংলাদেশে সে কখনো যায়ওনি, ফলে বাংলাদেশকে নিজের দেশ মনে করাটা তার জন্য কঠিনও। এর মধ্যে নাইন ইলেভেনের ঘটনাটি ঘটে, মুসলমান হবার কারণে বাংলাদেশী কমিউনিটির প্রতি শ্বেতাঙ্গদের বিদ্বেষ চরমে ওঠে, করিম ধীরে ধীরে তার ধর্মীয় আত্মপরিচয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে, দাড়ি রেখে সে পুরোদস্তুর মুসলমান হয়ে কমিউনিটির নেতা বনে যায়। এই পরিস্থিতিতে কী করণীয়, তা ঠিক করতে কমিউনিটির সভা ডাকা হয়। সভায় স্পষ্ট হয় তরুণরা নিজ আত্মপরিচয় স্পষ্টতর করে তুলতে ইসলামনির্ভর মৌলবাদিতার পক্ষপাতী, কিন্তু চানু এর বিরোধিতা করে।

এই বেলায় চানু চরিত্রটির দিকে একটু আলোকপাত করা দরকার। সে দেখতে কদাকার, স্ত্রী-কন্যাদের বিষয়ে ঘোর পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ বহন-চর্চা করে সে -- শাহানার পশ্চিমা চালচলনের জন্য তাকে মারধর করতেও কুণ্ঠা বোধ করেনা। আর নিজেকে সবসময় দাবি করে 'শিক্ষিত' ও 'প্রতিভাধর' মানুষ হিসেবে। তার পড়াশুনার পরিধি বিস্তৃত অবশ্য; শপিংয়ে গিয়েও স্ত্রীর সঙ্গে হিউমের দর্শন নিয়ে আলোচনা করে, স্ত্রী হয়তো তা শুনছেও না, মনে মনে করিমকে খুঁজছে। কাহিনীকার কমিউনিটির সভায় তার মুখ দিয়েই শোনালেন এই সঙ্কটে ধর্মীয় উন্মাদনার পরিবর্তে বৃহত্তর মানবতায় আত্মপরিচয় খোঁজার কথা।

সেই সভায় করিম একজন নেতা, করিমদের চরমপন্থী অবস্থানের বিরুদ্ধে চানু বলে, তোমরা কি মনে কর ইসলাম একটি দেশ? ইসলাম যদি তোমার-আমার আত্মপরিচয়ের সূত্র হতো তবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীরা মুসলমান হয়ে ৩০ লক্ষ মুসলমানকে মারতো না। আমার ইসলাম আছে আমার হৃদয়ে। এবং সেটা আমাকে রক্ষাও করে। বস্তুত চানু চরিত্রটি স্ববিরোধী, মানবীয় সীমাবদ্ধতার আওতায় সাধারণ একজন মানুষ, যে নিমেষের মধ্যে আমুদে মুড থেকে মেয়ের 'বেয়াদবী'তে হিংস্র হয়ে ওঠে। ওদিকে তার পড়াশুনা তাকে মানবতাবাদীও করে তোলে, ধর্মীয় মৌলবাদিতার বিপক্ষে সে দাঁড়িয়ে যায়।

চানু এক পর্যায়ে নাজনীন ও করিমের সম্পর্কের বিষয়টি বুঝতেও পারে, কিন্তু বিচক্ষণ মানুষের মতো স্ত্রীকে মারধর বা চেঁচামেচি না করে বোন হাসিনার বহুগামী চরিত্রের কথা উল্লেখ করে নাজনীনকে বলে যে, তুমিও তার থেকে পৃথক কিছু নও। পরমা ছবিতে পরমার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে সমাজ পরমাকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করে। কিন্তু চানু নাজনীনকে সেসবে বাধ্য করেনা। চানুর সঙ্গে বাদানুবাদের পরে এবং প্রিয় অথচ বহুগামী বোনকে চানুর ভর্ৎসনা ও নাজনীনকে তার মতোই চরিত্রহীন বলায় নাজনীন অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং যখন জ্ঞান ফিরে, দেখা যায় হাসিমুখে চানুই তার শয্যাপাশে। নাজনীন ছবির মূল চরিত্র ঠিকই, কিন্তু ছবিকে প্রাণবন্ত করে রাখে চানুর স্ববিরোধী ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর স্টাইলিশ চরিত্র, যে-চরিত্রটি দর্শকের কাছে শেষ পর্যন্ত ভিলেন বলে প্রতিপন্ন হয়নি।

তরুণদের সঙ্গে সেই সভায় চানু তার বক্তব্য সফলভাবে তুলে ধরতে পারলেও তা তরুণদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি, চানু সভাস্থল ত্যাগ করে। বাইরে এসে স্বগতোক্তি করে, দেশে ফিরে যাবার এটাই সঠিক সময়। বিস্ময়কর যে, এই ঘটনার পর, রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে নাজনীনকে এই প্রথম আমরা দেখি যে চানুর হাত ধরতে। এর আগে আমরা তাদের শয্যাদৃশ্যে দেখেছি যে সঙ্গমকালে নিরুৎসাহী নাজনীন তার শৈশবকেই ভাবে, হাসিনার সঙ্গে ক্রীড়াময় দিনগুলোর কথা ভাবে। কিন্তু এই প্রথম দেখা যায় নির্জন রাতের রাস্তায় নাজনীন-চানু দম্পতি হাত-ধরাধরি করে হেঁটে যাচ্ছে, লং শটে এই দৃশ্য দর্শকের মনে এই অভিঘাতের জন্ম দেয় যে, নাজনীন কমিউনিটির করণীয় কী, এই ইস্যুতে করিমের অবস্থানকে অনুমোদন করছে না, বরং স্বামীর অবস্থানকেই সমর্থন করছে।

নাজনীন অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার পাশাপাশি যে রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও পরিপক্ব হয়ে উঠছে, এই দৃশ্য যেন তাই দর্শককে বলে দেয়। তবে চানু নাজনীনের অসুস্থতার ফাঁকে দেশে যাবার টিকেট কেটে বসে, অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠার পরে সেই টিকেটগুলো উপহার দেবার ভঙ্গিতে নাজনীনের হাতে তুলে দেয়। নাজনীন যাবার বিষয়ে হাঁ-না কিছুই বলেনা, কিন্তু শাহানা বেঁকে বসে। বাবাকে বলে তারা দু'জন চলে যাক, সে আর বিবি থেকে যাবে, কেউ একজন তাদের ঠিকই পালক-কন্যা হিসেবে নিয়ে নেবে। এই কথায় চানু ক্ষেপে যায়।

শাহানা মাকে বলে, তুমি তাকে বলো যে তুমি যেতে চাওনা। ২০ বছরে এই লোকটির কাছ থেকে তুমি কিছু চাওনি, আজ বলো যে তুমি যেতে চাওনা। উত্তেজিত তর্কের মুহূর্তে শাহানা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। নাজনীন তার পিছু পিছু যায়, মা ও মেয়ের এই দৌড়াদৌড়ির দৃশ্য নাটকীয়ভাবে সিনেমায় তুলে ধরা হয়েছে। এক রেলস্টেশনে শাহানা থেমে যায়, নাজনীন শাহানাকে বলে যে, চিন্তা করোনা।

আম্মা এখানে আছি। এর মধ্যে করিম নাজনীনকে বিয়ের কথা বলতে থাকে। সে জানায় বাবার আনা বিয়ের প্রস্তাবগুলো সে ফিরিয়ে দিচ্ছে, নাজনীন যেন দেশে ফিরে না যায়, চানুকে ডিভোর্স করে। কিন্তু নাজনীন জানায় যে সে করিমকে বিয়ে করতে পারবে না। নাজনীন এতদিনে বোঝে যে করিম নয়, স্বামী-সন্তানই তার প্রকৃত গন্তব্য, আর এই ব্রিক লেন তার প্রকৃত ঘর।

বোন হাসিনাকে লেখে, তুই বলিস তুই একটি ঘরের আশায় বারবার পুরুষ পরিবর্তন করেছিস। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আশ্রয়ের খোঁজে ছিলাম আমি, এতদিনে আমি আশ্রয় খুঁজে পেয়েছি। আর বালুকণা জমতে জমতে যেমন ঝিনুকের মধ্যে মুক্তোর জন্ম হতে থাকে, ঝিনুক যা টেরও পায়না, আমার মধ্যেও সেরকম ভালোবাসার জন্ম নিচ্ছে। আশ্চর্য, সেই ভালোবাসা চানুর জন্য! কিন্তু নাজনীন চানুকে বলে, সে দেশে ফিরতে পারবে না। আর চানু বলে, সে এখানে থাকতে পারবেনা।

নাজনীন চানুকে গলার হার খুলে হাতে সঁপে দেয়, আর চানু কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। পরদিন চানু মেয়েদের বলে, আমাদের পরিকল্পনায় পরিবর্তন এসেছে, তোমরা থাকছো, আমি একাই যাচ্ছি। মেয়েরা বাবার কাছে ঘেঁষে আসে, বিবি উদ্বিগ্ন হয় কীভাবে বাবা একা একা থাকবে, খাওয়া-দাওয়া করবে। আর শাহানা ক্ষমা চায়। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় নাজনীন, শাহানা আর বিবি বরফে ছাওয়া চত্বরে হুটোপুটি খেলছে, তিনজনই বরফের ওপরে শুয়ে পড়ে, আকাশ দেখে।

নাজনীনের পয়েন্ট অফ ভিউ শটে দেখা যায় আকাশে একটি প্লেন উড়ে যাচ্ছে। নাজনীন একটু বিষণ্ন হয়। কীসের জন্য? স্বামী চানু, বোন হাসিনা না বালিকাবেলার বাংলাদেশের জন্য? হয়তো সবকিছুর জন্যই। ব্রিক লেন ছবিটির বিরুদ্ধে আমার আপত্তির জায়গা একটাই, বাংলাদেশী অভিবাসীদের নিয়ে ছবিটি নির্মিত হলেও এতে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। ছবিটির সহযোগী পরিচালক হিসেবে লন্ডনপ্রবাসী নির্মাতা রুহুল আমিনের নাম পাওয়া যায়।

এছাড়া নাজনীনের দুই মেয়ের চরিত্রেও সম্ভবত বাংলাদেশী অভিবাসী দুই মেয়ে অভিনয় করেছেন। করিম চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন ক্রিস্টোফার সিম্পসন, তার শরীরে বাংলাদেশী রক্ত বইছে কিনা তা নাম দেখে নিশ্চিত হবার কোনো উপায় নেই, তবে চেহারায় সংকর একটা ছাপ রয়েছে। এই ছবির আর সবকিছুই অবাংলাদেশী। মূল নাজনীন চরিত্রে অভিনয় করেছেন ভারতীয় বাঙালি অভিনেত্রী তন্নিষ্ঠা চ্যাটার্জি, সাম্প্রতিক সময়ে যিনি আন্তর্জাতিক একাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে সুনাম অর্জন করেছেন। চানু চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলিউডের চেনামুখ সতীশ কৌশিক।

এমনকি নাজনীনের বাল্যকালের বাংলাদেশ-অংশের শুটিং হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। পাকিস্তানী অভিবাসীদের নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ইস্ট ইজ ইস্ট-এও মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ভারতীয় অভিনেতা ওমপুরী। ব্রিক লেন চলচ্চিত্রের আবহসংগীতের দায়িত্বে ছিলেন স্ট্যানলি কুব্রিকের আইজ ওয়াইড শাট ও মার্টিন স্করসিসের গ্যাংস অব নিউইয়র্ক ছবির অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ জোসেলিন পুক। তিনি সফলভাবে সংগীতের ব্যবহার করলেও ভারতীয় বা বাংলাদেশী যন্ত্রাংশের ব্যবহার কম। নাজনীনের বাল্যকাল-অংশে সরোদসহ কিছু যন্ত্রাংশের ব্যবহার হয়েছে বটে, কিন্তু লন্ডন-অংশে সেরকম কিছুর ব্যবহার নেই বললেই চলে।

বাঙালি নাজনীন ক্রমশ ব্রিটিশে রূপান্তরিত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু চানু কখনোই তার বাঙালিত্ব ত্যাগ করেনি। তাই অন্তঃত তার মনোজগতের অনষঙ্গবাহী কিছু বাংলাদেশী মিউজিকাল স্কোর ব্যবহার প্রত্যাশিতই ছিল। তবে পুকের সাউন্ডট্র্যাক বেশ ভিন্নধাঁচের, একটা রহস্যময়তা তৈরী হয় সংগীতকে আশ্রয় করে, যা চরিত্রগুলোর মানসিক জটিলতা ও সঙ্কটের যুৎসই সম্পূরকতা এনে দেয়। বিশেষভাবে মনে পড়ে শাহানা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে নাজনীন তার পিছু পিছু লন্ডন শহরে দৌড়ায়, এই সময়ে ব্যবহৃত আবহ সংগীতটি। চলচ্চিত্র-ভাষা হিসেবে পরিচালক সারা গ্যাভরন ও সিনেমাটোগ্রাফার রবি রায়ান ক্লোজ-আপের ব্যাপক ব্যবহার করেছেন।

বিশেষত বেশ কিছু বিগ ক্লোজ-আপে চরিত্রসমূহের, বিশেষত নাজনীনের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট-রূপান্তর-দ্বিধাকে ক্যামেরা ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছে, যা তন্নিষ্ঠা চ্যাটার্জি সফলভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। ক্লোজ-আপনির্ভর চলচ্চিত্র-ভাষা ইঙ্গমার বার্গম্যানের হাতে পূর্ণতা পেয়েছিল, তিনি আগাগোড়া নির্ভর করতেন তার তৈরি করা থিয়েটার-গ্রুপের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ওপর। কারণ ক্লোজ-আপনির্ভর অভিনয়রীতি কেবল নির্ভরযোগ্য ও বলিষ্ঠ অভিনেতাদের ওপরেই প্রয়োগ করা যায়। সারা গ্যাভরনের এই শৈলী প্রয়োগের ক্ষেত্রে তন্নিষ্ঠা বা সতীশ নির্ভরযোগ্যতা অর্জন করেছেন। নাজনীনের শ্যামল-কালো চেহারা কেবল বাঙালি গৃহবধূর অবয়বকে বিশ্বস্তভাবে প্রকাশ করেনা, তার ব্রিকলেনের রাস্তায় নতমস্তক নম্র-ভীরু এক্সপ্রেশন চরিত্রের সঙ্গে যুৎসইভাবে খাপ খেয়ে গিয়েছে।

করিমের সঙ্গে তার রোমান্টিক মুহূর্তগুলোও গ্রামের মেয়ের হঠাৎ-আসা প্রেমে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ার এক্সপ্রেশনে ঋদ্ধ। তার পরিবর্তনও বৈপ্লবিকভাবে আসেনি কাহিনীতে, এসেছে ধীরে; ছবির শেষ পর্যন্ত তার এই লুক-এর খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি, কেবল সুদখোর মহিলার সঙ্গে বাদানুবাদে তাকে আমরা উচ্চকণ্ঠ হতে দেখেছি। নয়তো করিমকে প্রত্যাখ্যান কিংবা ছবির শেষে স্বামীকে লন্ডনে থেকে যাবার কথা দৃপ্তকণ্ঠে বললেও আমরা নাজনীনের এই পরিবর্তনকে সহজভাবে নিই, যেন চানুর মতো আমরাও টের পাইনি তার পরিবর্তন। নাজনীনের চরিত্রে তন্নিষ্ঠা দারুণভাবে সফল। চানু চরিত্রে সতীশ কৌশিকও, তার অতি-স্থূল দেহ ছাড়া, মানানসই মনে হয়েছে।

বাংলাদেশী পুরুষরা সাধারণত এরকম স্থূলদেহী হননা। করিম চরিত্রে সিম্পসনও উৎরে গেছেন। সিনেমাটাগ্রাফির আরেকটি দিক হলো হ্যান্ড-হেল্ড ক্যামেরার সফল ব্যবহার; বিশেষত চানু যখন ঘরে শাহানাকে মারতে যায় এবং শাহানা পালিয়ে আরেক ঘরে দরজা বন্ধ করে দেয়, এরকম দুয়েকটি দৃশ্যে ক্যামেরাকে অনড় না রেখে, হাতে-ধরে চরিত্রগুলোকে অনুসরণ করা হয়েছে, যার ফলে দৃশ্যের নাটকীয়তা সৃষ্টির পাশাপাশি ঘটনার বিশ্বস্ততাও নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশ অংশে ওয়াইড এ্যাঙ্গেল লেন্সের বরাতে আমরা পাই উজ্জ্বল-ঝলমলে বিস্তৃত এক অনিন্দ্যসুন্দর গ্রামীণ আবহ; আর লন্ডন অংশে দেখা যায় স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার অনুজ্জ্বল স্বাচ্ছন্দ্য। এভাবে দুই দেশের আবহাওয়ার বৈপরীত্য ক্যামেরায় যথাযথভাবে ফুটে উঠেছে।

শাহানার ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার দৃশ্যে মা মেয়ের দৌড়ের পাশাপাশি প্যারালাল-কাটে যোগ করা হয়েছে নাজনীন ও হাসিনার বালিকাবেলার বিস্তীর্ণ মাঠে দৌড়ের দৃশ্য, যা মেলানি অলিভারের সম্পাদনার মুন্সিয়ানাকে প্রমাণ করেছে। শাহানা-নাজনীনের দৌড়ের সমান্তরালে হাসিনা-নাজনীনের দৌড় কী অর্থ বহন করে? নাজনীনের মনে পড়ছে, যে হাসিনার সঙ্গে শেষবারের মতো এরকম দৌড়েছিল? নাকি হাসিনা যেমন তার খেলার সঙ্গী ছিল, প্রিয় বন্ধু ছিল, মেয়ে শাহানার সঙ্গেও সম্পর্কের ব্যবধান ঘুচে যাচ্ছে? তারা পরস্পর বন্ধু হয়ে উঠছে? কারণ তারা দেশে না-ফেরার ব্যাপার একইরকমভাবে ভাবছে। শাহানা মায়ের ডাকে দৌড় থামিয়ে দিলে নাজনীন তাইতো বলে, আমি তোমার সঙ্গে আছি। ব্রিক লেন ছবির কাহিনী চানুর শেকড়ে ফেরার ভাবনাটি অভিবাসীদের বিদেশেই থেকে যাবার ইচ্ছের কাছে পরাস্ত হয়েছে। তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদের অন্তর্যাত্রা ছবিতে দ্বিতীয় প্রজন্মও যখন শেকড়ানুসন্ধানে আগ্রহী হয়ে উঠছে, তখন দেশের স্মৃতিতে আচ্ছন্ন প্রথম প্রজন্মের নারী ধীরে ধীরে দেশে আদৌ না-ফেরার ব্যাপারে সচেষ্ট হয়ে উঠেছে, যা ডায়াস্পরিক ডিলেমায় ভোগা অভিবাসীদের জন্য কোনটা শ্রেয়তর, সেবিষয়ে একটি সমাধানের ইঙ্গিত দেয়।

প্রকৃতি-প্রাচুর্যে ভরপুর হবার পরেও, আলো ঝলমল-রঙিন বাংলাদেশে ফেরা নাজনীন-শাহানাদের জন্য অসম্ভব, কারণ স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার লন্ডনই তাকে দেয় আর্থিকভাবে নিরাপদ এক উন্নত জীবন। দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশে নেই সচ্ছলতার নিশ্চয়তা। অবশ্য পশ্চাদপদ এক গ্রামের মেয়ে নাজনীনের এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তার স্বাবলম্বিতা অর্জনের মধ্য দিয়ে, যা আমাদের অবশ্যই স্বাগত জানাতে হবে। পরমা ছবিতে পরমার পরিবর্তন ছিল নন্দনতাত্ত্বিক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থিরচিত্রগ্রাহক রাহুল তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল, তার ভেতরের সুপ্ত শিল্পবোধকে জাগিয়ে তোলার জন্য। পরমার এককালীন সেতারবাদনের পারঙ্গমতা রাহুলের কাছে মূল্য পায়।

আর ব্রিক লেন-এর নাজনীনের পরিবর্তন অর্থনৈতিক, প্রভাবক করিমও কোনো প্রতিভা নয়, সাধারণ ছোট ব্যবসায়ী মাত্র। নাজনীন তাই প্রতিনিধিত্ব করে হাজারো বাঙালি অভিবাসী বাঙালি নারীর কিংবা বাংলাদেশে বাস করা লাখো গৃহবধূর। ব্রিক লেন ছবিটি তাই আমাদের কাছে অনায়াসে বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে। জুন ০২, ২০০৮ প্রথম প্রকাশ: ইউকেবেঙ্গলি.কম (Click This Link)

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।