আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মনিকা আলির উপন্যাস ও ব্রিক লেন মুভি বিতর্ক

সাহিত্যের সাইটhttp://www.samowiki.net। বইয়ের সাইট http://www.boierdokan.com

যায়যায়দিনের পাঠকদের হয়তো ৩ আগস্ট ২০০৬ তারিখের আর্ট অ্যান্ড কালচার ম্যাগাজিনের সংখ্যাটির কথা মনে আছে। তখন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী লেখক মনিকা আলির ব্রিক লেন উপন্যাস অবলম্বনে একটি মুভি তৈরি করার জন্য লন্ডনে শুটিং চলছিল। উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৩ সালে। ম্যান বুকার পুরস্কারের শর্ট লিস্টে মনিকা আলিই প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেখক।

ফলে তাকে নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। তার উপন্যাস নিয়ে আলোচনা হয়েছে লন্ডন ও অন্য জায়গার বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যেও। যারা নিয়মিত উপন্যাস পড়েন না তারাও এ নিয়ে খোজ-খবর করেছেন। জানতে চেয়েছেন উপন্যাসটির মধ্যে আসলে কি আছে। উপন্যাসের বিষয় নিয়ে বই প্রকাশের পর লন্ডন বা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো বিতর্ক না উঠলেও মুভির শুটিংয়ের সময় লন্ডনের বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে রীতিমতো আন্দোলন শুরু হয়।

তাদের অভিযোগ ছিল, উপন্যাসটিতে বাংলাদেশের লন্ডনের কমিউনিটিকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। মুভির শুটিং করতে গিয়ে তারা রীতিমতো একটি সংগঠনও গড়ে তোলেন। সংগঠনটির নাম দেন ক্যাম্পেইন অ্যাগেইনস্ট মনিকা আলিস ফিল্ম ব্রিক লেন। মিছিল-মিটিংয়ের মাধ্যমে তারা লন্ডনের মিডিয়ায় নিজেদের মতামত জানান দেন। ব্যাপারটি এতোদূর গড়ায় যে, সালমান রুশদি ও জার্মেইন গ্রিয়ারের মতো লেখকও মনিকা আলির পক্ষে-বিপক্ষে নিজেদের মত প্রকাশ করেন।

গত আগস্টে লন্ডনের পত্রপত্রিকাগুলো মনিকা আলিকে নিয়ে বেশ সরগরম ছিল। এবার লন্ডনের পত্রিকাগুলোতে নতুন করে মনিকা আলির খবর এসেছে। উপলক্ষ সেই একইÑ মুভি। মুভির প্রিমিয়ার হলো গত ২৬ অক্টোবর। প্রিমিয়ার উপলক্ষে আবারো লন্ডনের বাংলাদেশি কমিউনিটির পক্ষ থেকে পত্রপত্রিকাগুলোতে প্রতিবাদপত্র পৌছেছে।

গার্ডিয়ান পত্রিকা তাদের নিয়মিত লিডার বিভাগে স্থান দিয়েছে ব্রিক লেন প্রসঙ্গ। এ নিয়ে নতুন করে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত পৌছেছে তাদের দফতরে। মনিকা আলির উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি মুভিকে কেন্দ্র করে জমে ওঠা বিতর্ক নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন। সারা গেভরন পরিচালিত ১০১ মিনিটের এ মুভিটির চিত্রায়ন হয়েছে ইনডিয়া ও ইংল্যান্ডের নানা স্থানে। পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশি কমিউনিটির এক নারী নাজনীনকে নিয়ে এ মুভির কাহিনী।

১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে যায় লন্ডন প্রবাসী এক ব্যক্তি চানুর সঙ্গে তার বিয়ের সূত্র ধরে। লন্ডনের বাংলাদেশি সমাজ, সেখানে নাজনীনের নানামুখি সংগ্রাম এ মুভির বিষয়। মুভিতে নাজনীন চরিত্রে অভিনয় করেছেন তানিস্থ চ্যাটার্জি, চানু চরিত্রে অভিনয় করেছেন সতিশ কৌশিক। মুভির প্রিমিয়ার হলেও এখন রিলিজের অপেক্ষা চলছে। তবে বিতর্কের গতিবেগ দেখে মনে হচ্ছে এ নিয়ে লন্ডন ও বাংলাদেশ আবারো মুখর হয়ে উঠবে।

# গার্ডিয়ানের লিডার : ব্রিক লেন সমস্যা# ২৭ অক্টোবর ২০০৭ ব্রিক লেন মুভি নিয়ে লন্ডনের বাংলাদেশি কমিউনিটির কিছু লোকের প্রতিবাদকে খুব সহজেই উপেক্ষা করা যায়। গতরাতের প্রিমিয়ার শোর পর এটা বলাই যায়, এ পত্র লেখকরা মুভিটি দেখেননি। যে বইটি থেকে মুভিটি বিশ্বাসযোগ্যভাবে অ্যাডাপ্ট করা হয়েছে রাগান্বিত প্রতিবাদকারীরা সে বইটিও পড়েননি। ২০ বছর আগের স্যাটানিক ভার্সেস নিয়ে যা হয়েছিল এ ক্ষেত্রে তেমনি ঘটেছে বলে মনে হতে পারে। যা স্বীকৃত ও শিল্পিত তার বিরুদ্ধে অজ্ঞানতা প্রসূত বিরাগ।

অনেক রাজনৈতিক আলোচনায় পরামর্শ দেয়া হয় যে, তাদের শুধু আলোচনা থেকে বের করে দিলেই আর কোনো সমস্যা থাকে না। এতো দ্রুত নয়। অন্য যে কোনো কমিউনিটির মতোই পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশিদেরও অধিকার নেই। তাদের যেভাবে দেখানো হলো তাকে প্রত্যাখ্যান করার অধিকার তাদের নেই। বরং তারা নানা ভাগে বিভক্ত গোষ্ঠী।

একটি একক গোষ্ঠী হয়ে কথা বলার পরিস্থিতি তাদের নেই। এমনকি তারা ব্রিক লেনকে নিজেদের জায়গাও মনে করে না, তারা শুধু এর চারদিকে বসবাস করে। এর মানে এ নয় যে, তারা যা বলছে তা অপ্রাসঙ্গিক। একটা বই বা একটা মুভি যদি কোনো ব্যাপকভাবে পরিচিত এলাকার লোকদের নিয়ে গড়ে ওঠে তবে তারা সেটাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। উপন্যাস বা মুভির ক্ষেত্রে বাজারকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।

কমিউনিটি সেখানে কম গুরুত্বপূর্ণ। মনিকা আলির উপন্যাস হলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে টাওয়ার হ্যামলেটসে আসা এক তরুণীর গল্প। তখন যা ঘটতে পারতো তা-ই তিনি কল্পনা করেছেন। যদিও তিনি কয়েক সপ্তাহ আগে পত্রিকার এ লেখায় প্রতিবাদকারীদের বক্তব্যকে খারিজ করে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘সব রকমের লোকেরা সব রকমের ব্যাপার নিয়ে আক্রান্ত বোধ করে।

’ সত্য কথা। কিন্তু একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নিয়ে একটি উপন্যাস কখনোই অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েটদের নিয়ে আরেকটি উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। যেখানে ওই কমিউনিটিকে ব্যাপকভাবে একটা সমস্যা হিসেবেই বর্ণনা করা হয়। তাদের বিচার করা হয় গরিব, অশিক্ষিত ও সম্ভাব্য সন্ত্রাসবাদী হিসেবে। পুরনো বিষয় নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে নতুন টেকনিকটাই হয়তো প্রধান হয়ে ওঠে।

কিন্তু বিষয়টা যখন নতুন, বিশেষ করে একটি জনগোষ্ঠী তখন বৃহত্তর দায়িত্বশীলতার প্রসঙ্গ আসে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, মনিকা আলির উপন্যাসটিকে প্রথমদিকে সাত সমুদ্র তের নদী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এটা হলো বাংলাদেশ ও লন্ডনের দূরত্ব নিয়ে প্রতীক বাচক একটি কথা। পরে প্রকাশক এর আরো মশলাযুক্ত টাইটেল দেন। বইটাকে দেখা হতো লন্ডনের আধা বিদেশি এলাকা সম্পর্কে একটি গাইড হিসেবে।

এর পুরস্কার হলো, প্রচুর সাহিত্য সমালোচনা ও বাণিজ্যিক সাফল্য। কিন্তু মনিকা হলেন একজন মিশ্র জাতির অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট। তার প্রধান চরিত্রগুলো এসেছে সিলেট থেকে, এরাই ব্রিক লেনের বাসিন্দা। কিন্তু মনিকা এসেছেন একেবারে ভিন্ন একটা জায়গা ময়মনসিংহ থেকে। এটা হলো সে রকম ঘটনা যাতে পশ্চিম লন্ডনের একটা কাহিনীকে পূর্ব লন্ডনের কাহিনী বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে।

শিল্পীরা বৃটিশ-বাংলাদেশ জীবনের জনক্ষুধার গভীরে গিয়ে কিছু বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করছেন। তারা বেখবর একটি জনগোষ্ঠীর খবর তুলে আনছেন। এর একটা মূল্য আছে। আর এটা আসে একটা বিষয়ের প্রতি আগে যে মনোযোগ দেয়া হয়েছিল তার চেয়ে বেশি মনোযোগ স্থাপন করার মধ্য দিয়ে। # প্রতিক্রিয়া # ২৯ অক্টোবর, ২০০৭ মিশ্র জাতির একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে, (ফালতু কথা।

এভাবেই আপনাদের পত্রিকার লিডার লেখক বলেছেন ২৭ তারিখের লেখায়) স্রেফ একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে আমি উল্টো কথা বলতে চাই। যে কাউকে ও যে কোনো কিছুকে ইচ্ছামতো কল্পনা করার অধিকার আছে। আমি যদি জিউইশদের নিয়ে প্যাডেফিলিস বা প্যাটাগোনিয়ান বা দ্বাদশ শতকের ফিনল্যান্ডের ডাইনিদের নিয়ে লিখতে চাই তবে তো আমি কোনো বিশ্বাসযোগ্যতার তোয়াক্কা না করেই তা লিখবো। বলে রাখি, আমি যদি কোনো বাস্তব জনগোষ্ঠীতে বসবাসকারী বাস্তব মানুষদের নিয়েও লিখি তাহলেও কল্পনা করার সেই স্বাধীনতা নেবো। আমার লেখা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে, না-ও পারে।

সাদা, কালো, বাদামি জনগোষ্ঠীর প্রতি আমার কোনো দায়বদ্ধতা আছে, তাদের কোনো বিশেষভাবে উপস্থাপনের কোনো বাধ্যবাধকতা আছে এটাকে প্রধান বিবেচ্য হিসেবে মেনে নিতে আমি নারাজ। যদি মনিকা আলি আপনার জন্য প্রত্যাশিত মাত্রার বাদামি, খেটে খাওয়া মানুষ বা সিলেটি না হন সে ক্ষেত্রে সেটা আপনার ক্ষুদ্র রাজনৈতিক পরিচয়ের সমস্যা। বিপরীতক্রমে অন্য কারো জন্য তিনি হয়তো ততোটা সাদা নন। আমি এ সাংস্কৃতিক খাটিত্ব আর দায়িত্ব বোধ নিয়ে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েছি। এগুলো শুধু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপরই চাপানো হয়।

আর এটা একটা লোক দেখানো রাজনৈতিক ফ্যাশন থেকে করা হয়। শিল্প সামাজিক সংহতি রক্ষা বা গোষ্ঠীগত সম্পর্ক দৃঢ় করার জন্য কাজ করে না। এটা হলো সত্য বিষয়ক সেই ভাষ্য যা আপনি দেখেন। যদি সেটা কাউকে বিরক্ত বা আক্রান্ত করে তবুও। এটাকেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলে।

আমি কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত জানতাম, আমরা সবাই এটাকে ভালো আইডিয়া হিসেবে বিবেচনা করি। হ্যারি কানজরু ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক যখন আপনাদের লেখকই বলছেন যে, পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশিরা বহুধা বিভক্ত একটি গোষ্ঠী যারা এক হয়ে কথা বলতে পারে না তখন তিনি তাদের নিয়ে লেখা একটি নতুন উপন্যাসে যেখানে একটি গোষ্ঠী বিষয় হয়ে এসেছে সেখানে বিশেষ যতœ আশা করতে পারেন না। এ যুক্তি দেখানো যায় সেই ঔপন্যাসিকদের নিয়ে যারা সবার জন্য লেখেন বা কারো জন্যই লেখেন না। আমার মনে হয়, উপন্যাস, এমনকি বেখবর কোনো জনগোষ্ঠীকে নিয়ে লেখা উপন্যাসও লেখক যেভাবে চান সেভাবে কাজ না-ও করতে পারে। আপনাদের নিশ্চয়ই এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা হবে যে, কেন বাংলাদেশের অগণিত নারী মনিকা আলির কাছে চিঠি লেখার প্রয়োজন বোধ করেছেন।

তারা লিখেছেন, কারণ তারা মনিকা আলির বিষয়ের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেছেন। তাদের অভিজ্ঞতা মনিকা আলির বর্ণনার সঙ্গে মিলেছে। ব্রিক লেনের এক মধ্য বয়সী ব্যক্তিই শুধু জোরেশোরে এ নিয়ে তার আক্রান্ত বোধ করার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। এদের প্রতিনিধিত্ব করার মতো কোনো লক্ষণ তার প্রতিবাদের মধ্যে দেখা যায়নি। সর্বোপরি, আমরা এমন এক অভিজ্ঞতার সামনে থেমে গেলাম যেখানে একটি কাল্পনিক উপন্যাসের দ্বারা আক্রান্ত লোকরা এর বিরুদ্ধে কথা বলতে রীতিমতো র‌্যালির আয়োজন করেছে।

আমাদের সমাজ অনেক ন্যারেটিভের সমন্বয়ে তৈরি, একটা বর্ণনা সবগুলোকে কখনোই গিলে খেতে পারে না। লিসা আপিগনানেসি ডিপুটি প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ পেন আপনাদের লিডার একটা মূল পয়েন্ট মিস করেছেন। সর্বোপরি, ব্রিক লেন হলো একটি দরদি লেখা। মনিকা আলি পরিষ্কারভাবে তার উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত। মূল চরিত্রগুলো সুন্দর ও বীরোচিত।

যদি উপন্যাসটি স্থানীয় সংস্কৃতির ওপর বিরাগহীন আক্রমণ হিসেবে আসতো তবে প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে সহানুভূতির সঙ্গে দেখা যেতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হয়নি। সবশেষে ব্রিক লেন একটি উপন্যাস, সমাজ বিজ্ঞানের কোনো কাজ নয়। আপনার লেখায় যেভাবে এসেছে উপন্যাসে বৃটিশ-বাংলাদেশি জীবনের জনক্ষুধার অভ্যন্তরীণ কোনো চিত্র উঠে আসার কোনো প্রমাণ নেই। বরং এটা ব্রিক লেনের মতো একটা জায়গার কথা বলেছে যেটার অস্তিত্ব হয়তো অন্য কোথাও।

তাছাড়া বৃহত্তর দায়িত্বশীলতার তো কোনো মাত্রা নেই। আমরা যদি সেই দায়িত্ব নিই তাহলে তো অনেক কিছুই প্রকাশ করা যায় না। উপন্যাসগুলোকে অপ্রকাশিত রেখে দিতে হয়। জেমস ওয়ার্ড পূর্ব সোয়াশ ভূমিকা ও অনুবাদ : মাহবুব মোর্শেদ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.