লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। জনৈকা নারীর পঞ্চাশ বছর
মোহাম্মদ ইসহাক খান
- আমার লেখাপড়া বেশি দূর হয় নি, মাত্র কয়েক ক্লাস পড়েছি। বয়স যখন খুবই কম, তখনই একদিন ধরে আমার বিয়ে দিয়ে দেয়া হল।
আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় একজনের সাথে। গ্রামাঞ্চল, অজপাড়াগাঁ। এসব জায়গায় মেয়েদেরকে দ্রুতই বিয়ে দেয়ার নিয়ম। আমার আরও লেখাপড়া করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সে ইচ্ছে যে পূরণ হবে না, জানতাম। ছোটকাল থেকেই সব কিছু "মেনে নেয়া" শিখেছি, প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে এমনটা করার।
তুমি ছেলেমানুষ, জানো না হয় তো, পুতুল খেলার বয়স থেকেই সব মেয়ে নিজের সংসার নিয়ে চিন্তাভাবনা করে, বেশি কিছু না হোক, অন্তত স্বামীর কাছ থেকে একটা ন্যায্য ব্যবহার আশা করে। স্ত্রীর মর্যাদা না পাক, দাসীবাঁদীর আচরণ সে আশা করে না। আমি তাই বাসরঘরে দুরুদুরু বুকে বসে ছিলাম, বাপের বাড়িতে যে সুখ পাই নি, সম্পন্ন পরিবারের স্বামীর ঘরে হয়তো তার কিছুটা পাবো। লাল চোখ বেহেড মাতাল স্বামীকে দেখে আমার সে আশাও নষ্ট হয়ে গেল।
তারপরের কাহিনী নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছ।
দুঃখের কাহিনী, কাজেই কিছু কিছু বললেই বাকীটা ধরতে পারবে। বিরক্ত হচ্ছ না তো?
- না না, বিরক্ত হবো কেন, আপনি বলুন।
- আমার স্বামী ছিলেন খুব খারাপ স্বভাবের। অনেকে বলে, স্বামীকে নিয়ে আজেবাজে কথা মুখে আনতে নেই, পাপ হয়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী দোষ, যখন আমি জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি? তাঁর জীবদ্দশায় তো তাঁকে নিয়ে একটি কথাও বলি নি।
তিনি ছিলেন নেশাখোর, তাঁর হাতটান অর্থাৎ এটা-ওটা চুরির অভ্যেস ছিল, তিনি ছিলেন এক নম্বরের ছোটলোক, যার-তার কাছ থেকে টাকা ধার করতে কসুর করতেন না, মানসম্মানজ্ঞান কিছুই ছিল না, আর সবচেয়ে লজ্জার কথা, তিনি ছিলেন নারীলোভী। এই ব্যাপারটিকে তিনি অবশ্য দোষের কিছু বলে মনে করতেন না, কারণ তিনি "পুরুষ। " পুরুষ মানুষের "একটু-আধটু" দোষ থাকবেই, তোমরা তো এমনটাই বল, ঠিক বলিনি?
আমি গলা খাঁকারি দিলাম। কিছু বললাম না।
- আমার ওপর তিনি অনেক অত্যাচার করেছেন।
বিবাহিত জীবনের শুরু থেকেই। সংসারে আমার কোন মতামত কিংবা সিদ্ধান্তের ধার তিনি ধারতেন না। না ধারুন, আমি সেটাও মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু সত্যি বলতে কি, যখন তিনি আমাকে দরজার হুড়কো দিয়ে পেটাতেন, তারপর আবার সে রাতেই সারারাত পা টেপাতেন, তখন নিজেকে খুব ছোট বলে মনে হতো। আমার ওপর অবশ্য আদেশ ছিল, কিছুতেই যেন আমার আচরণে প্রকাশ না পায় যে আমি দুঃখে আছি।
বরং সবসময় যেন উল্টোটাই বাইরে প্রচার করি। তাই আমি আমার পাড়াপড়শি ভাবীদেরকে বলতাম, ভাবী, আমি তো সুখেই আছি। এই দেখুন, খাচ্ছি, দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, বেশ আছি।
আমি অবশ্য বৃদ্ধাকে এখুনি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম যে আশেপাশের লোকজন জানতেন কীনা যে তাঁর ওপর অত্যাচার করা হতো, কিন্তু তার আর দরকার হল না।
- আশপাশের মানুষ তাই জানতো যে আমি ভালোই আছি।
কতটা ভাল আছি নিশ্চয়ই আরও খানিকটা বিস্তারিত জানতে তোমার মন চাইছে। বাপের বাড়িতে দু'দিন পরপর টাকা আনতে যাওয়ার চাপ তো ছিলই। টাকা আনতে বিফল হলে দরজার হুড়কো কপালে ছিল, বলাই বাহুল্য। তাছাড়া তিনি আমার তিন-তিনটি সন্তান নষ্ট করেছিলেন। আমি গর্ভ ধারণ করতাম, তারপর তার কথামতোই নষ্ট করে ফেলতে হতো।
আমি কান্নাকাটি করতাম, কিন্তু বলেছিলাম তো, মুখ খোলার কোন উপায় আমার ছিল না। এক পর্যায়ে আমার স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। স্বামীর হাতে-পায়ে ধরে আমি অবশেষে মা হতে পারলাম, অন্য কথায়, আমার একটি সন্তানকে বাঁচাতে পারলাম। পরবর্তীতে অবশ্য আরও দুটো সন্তান হয় আমার। বোধহয় আমার ওপর একটু দয়া হয়েছিলো তাঁর।
শুধু আমার সাথে নয়, আমার সন্তানদের সাথেও খুব খারাপ আচরণ করতেন তিনি। কুকুর-বেড়ালের মতো মারধোর করতেন, একবার তো তাঁর হাতে মার খেয়ে আমার এক ছেলের জীবন নিয়েই টানাটানি লাগলো। খোদাতায়ালার কাছে অনেক কান্নাকাটি করেছিলাম বলেই হয়তো বেঁচে যায় ছেলেটা।
তাঁর আরও "গুণাবলী" ছিল। গোপনে অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছিলেন তিনি।
খারাপ জায়গায় যাতায়াত ছিল। আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম, এসব চাউর হলে সবার কাছেই ছোট হয়ে যাবো। কিন্তু তিনি পাকা লোক, পাপের খবর কী করে গোপন রাখতে হয়, তা তিনি ভাল করেই জানতেন।
শুধু তাই নয়, আমাকে না জানিয়ে, আমার বাবা-মাকে না জানিয়ে তিনি অন্য আরেক জায়গায় বিয়েও করেছিলেন। অবাক ব্যাপার, জানতে পেরে আমার চোখ দিয়ে একটু পানিও পড়ে নি, বোধহয় আমার ক্লান্তি এসে গিয়েছিলো অথবা চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল।
অবশ্য সে স্ত্রী আর তার ঘরের এক সন্তান অসুখ হয়ে মরে যায় বলে সেই পরিবারটাই শেষ হয়ে যায়।
আমি উদয়াস্ত কাজ করতাম, সন্তানদের মানুষ করতাম, আর অবসর সময়ে নিজের কপাল নিয়ে ভাবতাম। ভেবে কোন লাভ ছিল না, তারপরও ভাবতাম। বোঝার চেষ্টা করতাম, কী এমন দোষ করেছিলাম আমি, যার কারণে আমার ভাগ্য এমন হল?
অবশেষে একদিন তিনি মারা গেলেন। ততদিনে আমার সংসারের পঞ্চাশ বছর পুরো হয়েছে।
আমার সন্তানেরা বড় হয়েছে, যে যার কাজে চলে গেছে। আমি আছি আমার আত্মীয়ের বাসায়, এক কোণে, আশ্রিতা হয়ে। এই বয়সেও অনেক কাজ করতে হয়, ঝাড়ু দিতে হয়, ঘর মুছতে হয়, থালাবাসন ধুতে হয়, নইলে খাওয়া জোটে না। কাউকে বল না যেন, আমার সাথে এরাও খুব খারাপ ব্যবহার করে, আমাকে ভাবে নর্দমার একটা কীট। কাজের বুয়ার মতো খাটি, তারপরও কবে যে লাথি মেরে বের করে দেয় ঠিক নেই।
ওদেরই বা কী দোষ, কেউ কি কাউকে এমনি এমনি খেতে দেয়, বল?
সন্তানদের কথা মনে পড়ে। বুকে ধরে যাদেরকে মানুষ করলাম, তারাও ... ... ছেড়ে দাও ওসব কথা। ভাল থাকুক ওরা।
এই হল আমার বৃত্তান্ত। আর কিছু জানতে চাও?
- একটা কথা কিন্তু বলতেই হয়, এতটা অতৃপ্তি, এতটা ঘৃণা নিয়ে মানুষটির সাথে আপনি কাটিয়েছেন বিশাল একটা সময়।
দু'বছর নয়, দশ বছর নয়, দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর। আপনার কি মনে হয় নি, একটা অসাধ্য সাধন করছেন? মানে, বলতে চাইছি, আপনি কি একবারও ভাবেন নি, আর পারছেন না, এবার ক্ষান্ত দেবেন? টানা পঞ্চাশটা বছর আপনি কী করে সহ্য করলেন? ইচ্ছে হয় নি পালিয়ে যেতে, অথবা কোন একটা উপায়ে এই সম্পর্কের ইতি টানতে?
বৃদ্ধা সাদা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন, তারপর বললেন, বাবারা, তোমরা এখন বল সবাই সমান। আমাদের সময়, বিশেষ করে আমার ক্ষেত্রে কথাটা একেবারেই মিথ্যে ছিল। আমার বলার কিছু ছিল না। আমার পিতা ছিলেন অর্থনৈতিকভাবে নাজুক অবস্থায়, অর্থাৎ আমাদের পরিবার ছিল দরিদ্র।
এমন একটি ঘরে মেয়ে জন্ম নেয়া পাপের শামিল। তাছাড়া আমাকে ছোট বেলা থেকেই শেখানো হয়েছিলো যে আমি হচ্ছি একটা বোঝা, আমাকে কোনমতে "পার করতে পারাটাই" আমার বাবা-মায়ের একমাত্র চাওয়া। আমিও মেনে নিয়েছিলাম। ধরে নিয়েছিলাম, মেয়ে হয়ে জন্মানোর পাপটা যখন করেই ফেলেছি, তখন প্রায়শ্চিত্ত তো করতেই হবে।
একটু থেমে তিনি যোগ করলেন, তাছাড়া একটা সময় আমার "অভ্যেস" হয়ে গেল।
মনে হতে লাগলো, এটাই হয়তো স্বাভাবিক, এমনটাই হবার কথা ছিল। তাই আমার যন্ত্রণার অনুভূতিগুলো একটা সময় ভোঁতা হয়ে গেল। তেতো ওষুধ খেয়েছ কখনো? প্রথম প্রথম গিলতে কষ্ট হয় ঠিকই, কিন্তু দিনের পর দিন খেতে খেতে অভ্যেস হয়ে যায়। আমি ধরে নিলাম, আমার কেউ নেই। না পিতামাতা, না স্বামী, না সন্তানেরা।
আমি একা, সম্পূর্ণ একা। একা একাই বলতে গেলে এতগুলো দিন কাটিয়ে দিলাম, আপন বলতে কাউকে পেলাম না। কেউ আমার কাছের মানুষ হল না, কেউ জানতে চাইলো না, আমার কোন কষ্ট আছে কীনা। আর তো কয়েকটা দিন, দেখো, আমি ঠিক কাটিয়ে দিতে পারবো।
অচেনা বৃদ্ধা আবার চোখের পানি মুছলেন।
তাঁর ঝাপসা ঘোলা চোখের দিকে আমি তাকালাম। সেখানে আকুতি, এই জীবনের সমাপ্তির তীব্র আকুতি। যে জীবনে তিনি শুধু যন্ত্রণা পেয়েছেন।
*****
আমি বৃদ্ধাকে একটা থাকার জায়গা করে দিয়েছি। সেখানে আরও অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থাকেন, জীবনের শেষ দিনগুলো কোনমতে পার করবার জন্য।
যাদের দেখার কেউ নেই। জগৎ-সংসার যাঁদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তাঁদেরকে খুঁজে খুঁজে আমরা এখানে নিয়ে আসি।
এখন আর তাঁকে কুঁজো হয়ে ঘর মোছা কিংবা বাসন ধোয়ার মতো কাজ করতে হয় না। তিনি এখন খানিকটা আরামে আছেন। খুব বেশি কিছু নয়, কিন্তু আগের চেয়ে একটু ভাল অবস্থায়, তা বলা যায়।
এটুকু আমাদের সাফল্য। তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে অনেকগুলো রোগ, এসবকে কাঁচকলা দেখিয়ে তিনি হয়তো বেঁচে থাকবেন আর বছর দশেক, একটু নির্ভার হয়ে, এটাই আমাদের পাওয়া। বিফলতা অনেক। এই বৃদ্ধার ক্ষেত্রে আমাদের বিফলতা পঞ্চাশ বছরের। তাঁর পঞ্চাশ বছর তো আর আমরা ফিরিয়ে দিতে পারবো না।
তাঁর দুঃসহ স্মৃতিকে সুখের স্মৃতিতে বদলে দিতেও পারবো না।
এই বৃদ্ধার সামনে গেলে আমার মাথা নিচু হয়ে আসে। যে ভার তিনি পঞ্চাশ বছর বয়েছেন, আমি হলে তা এক মুহূর্তও বইতে পারতাম না। একই সাথে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং নিজেদের প্রতি লজ্জাবোধ হয়।
(৩১ জানুয়ারী, ২০১৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।