যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
জীবনে টুকটাক ক্রিকেট খেলেছি অনেকই, টেনিস বল, টেপটেনিস, কাঠের বল এমনকি শক্ত রাবারের বেইসবল দিয়েও খেলেছি। কিন্তু কেউ কোনদিন এই বদনাম করতে পারবেনা যে আমি ঠুকিয়ে ঠুকিয়ে ব্যাটিং করি। ক্রিজে নেমে এলোপাতাড়ি পেটানোর চেষ্টা করি, দুচারটা চার-ছয় মেরেই আউট হয়ে ফিরে আসি। কিন্তু সেই আমারই ব্লগীয় ইনিংসটা এতই ধীর গতিতে চলছিলো এবং চলছে যে, আমি নিজেও কোনদিন আশা করিনি যে দু'শ পেরুতে পারবো। এই স্লো ইনিংস গাভাস্কারকে ছাড়িয়ে রিজওয়ানুজ্জামান (পাকিস্তানের এই ওপেনার একবার নাকি ১২০ বলে ৫ রান করেছিলো!) পর্যন্ত চলে গেছে মনে হয়।
এই পোস্টটা মূলতঃ স্মৃতিচারণের, নিজের কথা বলার। বিশাল পোস্টও হয়ে যেতে পারে, আবার খুব কমেও শেষ হয়ে যেতে পারে। নিজেও এখনও বুঝছিনা কীবোর্ড কোনদিকে টেনে নিয়ে যাবে। যেদিকেই নিয়ে যাক, আপাততঃ যেতে থাকি।
সামহোয়ারে প্রথম ঢুকেছি ধীমান ব্লগার সাদিকের ব্লগে, ছেলেটা এখন ইউসিএলএ'তে পড়াশোনায় আর সুফি সাধনায় এমনই ব্যস্ত যে ব্লগে মনে হয় মাসে দু'মাসেও একবার আসেনা।
অথচ আগে ইকেয়া থেকে আয়না কিনে আনলেও ব্লগে সেটার জানান দিয়ে যেতো । যাইহোক, সাদিকের ব্লগের খুব গভীর সুফিজম নিয়ে কোন একটা লেখা ফরোয়ার্ডেড পাই এক বন্ধুর কাছ থেকে, খুলে পড়তে গিয়ে দেখি মাথা ঝিমঝিম করছে। বুঝছি, আবার বুঝছিনা; ঠিক কিভাবে বুঝে নিলে নিশ্চিত হবো যে বুঝছি সেটা বুঝছিনা। বুঝলাম, এ নিশ্চয়ই খুব উঁচুমার্গের আড্ডাখানা (সাদিকের লেখা আসলেই খুব গভীর, রীতিমতো গবেষণা করানো যায় ওগুলো দিয়ে), খানিকটা ভয় পেলাম। কিছুদিন আর ওপথ মাড়ালামনা।
এর মাঝে যায়যায়দিনের পাঠকদের লেখা নিয়ে সাজানো বিশেষ সংখ্যায় একটা লেখা ছাপা হলো আমার, এবেনের গল্প, 'স্ট্যান্ডার্ড' নামে। নিজের লেখা এর আগে মাত্র একটা প্রকাশিত হয়েছিলো যায়যায়দিনেরই সমকালে, তারপর অনেকদিন এসবের ধারেকাছেও যাইনি। কিন্তু এবার বাড়তি যেটা যোগ হলো, সেটা হলো যে পাঠকদের অনেকের কাছ থেকে লেখা বিষয়ে ই-মেইল পেলাম, আর সেজন্য আমি তখন খানিকটা হাই, নিজেকে কিছু একটা ভাবা শুরু করছি। এই ইমেইল পাওয়ার অবশ্য অন্য কারণ ছিলো, ইমেইলকারীদের অধিকাংশই এবেনকে কোনভাবে চেনেন। তবে কারণ যাই হোক, আমি মহাউল্লাসে ভার্চুয়াল-বাস্তবের বন্ধুবান্ধবদের জানাতে শুরু করলাম ব্যাপারটা।
তখনই একজন আমাকে দিলো সামহোয়ারের আরেকজন ব্লগারের লিংক, বললো, আপনিও এখানে লিখতে পারেন। আমি সেই পেজে গিয়ে দেখি বড় বড় অক্ষরে লেখা "তোড়ায় বান্ধা ঘোড়ার ডিম!" --আবারও সেই উচ্চমার্গের কথা। এটা ছিলো আরেক প্রতিভাবান ব্লগার হিমু'র ব্লগ, এখন সচলায়তনে লিখেন। তাও, এবার সাহস করে দুএকটা লেখা পড়া শুরু করলাম। দেখলাম ঈশ্বর উইকএন্ডের আগে আগে হিমুকে বানিয়ে ভুলে ওভেনে রেখে দিয়েছে পুরো দুইদিন -- সে নিয়ে বেচারার মহাআক্ষেপ।
মার্গটা একটু কমলো মনে হলো, মজা পেলাম; তারপর সেখানকার নানান লিংকে গুঁতোগুঁতি করতে করতে চলে এলাম প্রথম পেজে।
প্রথম পেজে এসে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। দেখি দুদল ব্লগারের মধ্যে ধুন্ধুমার বিতর্ক চলছে, "কেন প্রাপ্তি নামের ছোট্ট একটি মেয়ের ছবি নিয়ে নাস্তিক-আস্তিক রাজনীতি হবে" -- সেটাই বিতর্কের বিষয়। বিতর্ক দেখে সত্যি বলতে কি, আরো মজা পেয়ে গেলাম। মার্গ তো এখন আমার কানের আশেপাশে!! সবসময়ই জ্ঞানী-গুণীজনের কাছে শুনেছি বাঙালীরা এক হলেই নাকি এর বিরুদ্ধে সে, সে'র বিরুদ্ধে এ -- এসব নিয়ে ঝগড়ায় মেতেই থাকে।
কার ছেলের হাইট বাবার পাঁচফুট হাইটকেও ছাড়াতে পারবেনা, কার মেয়েকে দেখে এখনই বোঝা যায় মা'র চেয়েও ধুমসী হবে -- এসব নিয়েও নাকি তর্কাতর্কি চলে। আমি অবশ্য এরকম তর্ক কখনও হতে দেখিনি, বেশীরভাগ তর্কই দেখেছি ঐ দুটো বিষয় নিয়ে -- "ইশ্বর আছে কি নেই", অথবা "হাসিনা ভালো না খালেদা ভালো"। এমনকি আবাহনী-মোহামেডান নিয়েও কোন তর্ক হতে দেখিনা। এপ্রসঙ্গে দেখি সবাই একে অন্যের সাথে খুনসুটি করে। যাই হোক জ্ঞানী-গুণিজন যাই বলুক, আমি বাঙালীর এই তর্কাতর্কি ভীষন উপভোগ করি, শুধু উপভোগই করিনা, কিভাবে যেন নিজের অজান্তেই জড়িয়েও যাই।
সামহোয়ারেও তাই হলো, আপাততঃ পড়ার কাজে জড়িয়ে গেলাম। এর যুক্তি পড়লে মনে হয়, "হুমম, কথা সত্য। " আবার ওরটা পড়ে মনে হয়, "হুমম, এটাওতো ফেলে দেয়া যায়না। " মনের মাঝে এক অলৌকিক দোলনায় দুলি। দুলতে দুলতে কখন যেন সাইনআপ করে ফেলি টের পাইনা।
তখন আমার এক হটমেইল আইডি ছিলো জ্বিনের বাদশা নামে, সেটাকেই এখানেও সেঁটে দিলাম। তৈরী হয়ে গেলো জ্বিনের বাদশা! সেটা সম্ভবতঃ মে মাসের ৩১ তারিখ, ২০০৬। এখনও মনে আছে, আমার ব্লগে প্রথম মন্তব্য করেছেন "আমার লেখা" নামের একজন ব্লগার। তিনি যে কোথায় হারালেন, জানিনা। প্রথম পোস্টে পড়ল ৮ টি মন্তব্য।
আমি কি খুশী! তারওপর সেদিনই ব্লগার হযবরল (তুখোড় পদার্থবিদ) একটা পোস্টও দিয়ে দিলো, "একজন আইছে জ্বিনের বাদশা নামে" বা এরকম কিছু শিরোনামে। আমি তো মহাখুশী, যাক অভিষেক খারাপ হয়নি।
সেই শুরু। প্রথম প্রথম খেয়াল করলাম ব্লগে কয়েকটা সার্কল তৈরী হয়ে আছে। নতুন যারা ঢুকছে, তারা নানাভাবে চেষ্টা করছে একেকটা সার্কলে ঢুকতে।
আমিও চেষ্টা করলাম। এরমাঝে একজন (সম্ভবতঃ হযবরল) টিপস দিলো যে মন্তব্য পেতে হলে বেশী বেশী অন্যদের ব্লগে মন্তব্য করুন, নিজেকে চেনান। আমি মহাউৎসাহে লোকজনের ব্লগে মন্তব্য করতে শুরু করলাম। বিনিময়ে মন্তব্যও পেতে লাগলাম, দুয়েকটা করে। এখনও স্পষ্ট মনে আছে, মন্তব্য পাওয়ার জন্য তীর্থের কাকের মতো বসে থাকতাম, এমনও দিন গেছে, রাত তিনটার (তখন আমি সেইরকম নিশাচর ছিলাম) সময় পোস্ট দিয়ে সকাল পর্যন্ত সিগারেট টানতে টানতে কাটিয়ে দিয়েছি আর মন্তব্য চেক করেছি।
কেউ মন্তব্য করলে সাথে সাথে সেটা রিপ্লাই করতাম যে তা কিন্তু না, এখানেও একটা হিসেব ছিলো। যখন মন্তব্যটা সাম্প্রতিক মন্তব্যের ঘরে নিচে নামতে নামতে উধাও হয়ে যেতো, তখনই রিপ্লাই করে সেটাকে আবার প্রথম পাতায় (সাম্প্রতিক মন্তব্যের ঘরে) তুলে আনতাম। আহা সেই দিনগুলো!!
কিন্তু কিছুদিন যেতেই যে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম, তা হলো কারো সাথে আমার সেরকম জমছেনা। এরমাঝে আরেকটা ব্যাপার টের পেলাম, প্রত্যেক সার্কেলেই ব্লগারদের মাঝে আবার মেসেঞ্জার বা সেরকম অনলাইনচ্যাটের মাধ্যমে যোগাযোগ থাকে। আমার সাথে তো কারুর নেই! মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, সেজন্যই হয়ত জমছেনা।
যাই হোক, হাবিজাবি/খাদ্য-অখাদ্য যাই পারি, ব্লগে ঢোকাতে লাগলাম একের পর এক। এমনই একদিন হঠাৎ হাসান নামের একজন ব্লগার লিখলেন একটা পোস্ট, ব্লগারদের নিকনেমগুলো বাস্তব জীবনে কতটা হাসির হতে পারে। সে পোস্টটা শুরুই করেছিলেন জ্বিনের বাদশা নিকটা দিয়ে, মনে হয় কথাটা ছিলো অনেকটা এরকম "হঠাৎ কোন আড্ডায় যদি বলা হয় 'আজকে জ্বিনের বাদশা কথাটা কিন্তু খারাপ কয়নাই', তাইলে ব্লগের বাইরের লোকের চেহারা কিরকম হবে!" সেই পোস্ট পড়ে আমার চোখ যেন একটু ভিজে গেলো আনন্দে, মনে হলো অস্তিত্বের স্বীকৃতি পেয়েছি। হাসানকে ইদানিং কোথাও দেখিনা, শুনেছি বিয়ে করে সংসারী হয়েছে, সংসার সুখে কাটুক।
তাও ঠিক যেরকম বন্ধুত্ব বা স্বীকৃতি চাইছি সেটা পেয়েছি বলে মনে হচ্ছিলনা।
কোথায় যেন একটা দূরত্ব আছে, কোথায় যেন ঠিক মিলে যাচ্ছেনা। ভাবলাম, আমার নিজেরই সমস্যা, ভার্চুয়াল পৃথিবীকে খুব আপন করে নিতে পারছিনা। আবার ভাবলাম, সবাই কিভাবে পারে? ঠিক সেরকম সময়েই একজন হাত বাড়িয়ে দিলেন, এবং সেটা এমন একজনই যার লেখার আমি অলরেডি বিরাট ভক্ত। বিরাট বললে ভুল হবে, বলতে হবে সবচেয়ে বেশী ভক্ত। একটা পোস্টে তাঁকে নামের শেষ "দা" যোগ করে ডাকাতে তিনি হেসে হেসে বললেন, এরপর যদি "দা" টা ফেলে শুধু "শুভ" বলে না ডাকতে পারেন, তাহলে আপনাকে দা দিয়ে একটা কোপ দেয়া হবে ।
আমার আসলেই চোখে পানি চলে এলো এদিন, ল্যাবে বসে আমি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছি, চোখের পানি পড়ছে। শুভ ভাই, যাকে আমি একদম অতুলনীয় ব্লগার ভাবি, যার লেখা পড়লে আবেগে গা কাঁপতে থাকে, যিনি একদম চোখে আঙুল দিয়ে বারবার জামাতপন্থী ব্লগারদের দেখিয়ে দিচ্ছিলেন কোন জায়গাটায় তাদের "মহান" নেতারা অপরাধী, সেই শুভ ভাই উদারভাবে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। হয়ত এখনও যে সামহোয়ারে লিখছি, সেই শক্তিটা সেদিন এসেছিলো। মনে হয়েছিলো, না, বন্ধুত্ব হবে।
ব্লগারদের বর্তমান প্রজন্ম যারা শুভ ভাই'র পোস্টগুলো পড়তে পারেননি, তারা ভীষন মিস করেছেন বলে আমি মনে করি।
অসম্ভব নরম হৃদয়ের এই অভিমানী লোকটি আপোস করতে পারেননি অনেক কিছুর সাথেই, সরিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। আমাদেরই এখন তাঁকে খুঁজে নিতে হবে বারবার। শুভ ভাই প্রসঙ্গে বলি, তিনি প্রতিষ্ঠিত লেখক আলী মাহমেদ, অদ্ভুত রকমের আবেগ দিয়ে লিখতে পারেন তিনি। হুমায়ুন আহমেদের পর এত আবেগঘন লেখা আমি আর কারো বইয়ে পাইনি। এই প্রজন্মের যেসব পথভ্রান্ত যুবক/যুবতীরা আসলেই বিশ্বাস করে ৭১ এ এদেশে যুদ্ধাপরাধ হয়নি, জামাতী নেতাগুলো নিষ্পাপ, তাদের অন্ততঃ শুভ ভাই'র "ফ্রিডম" বইটা পড়তে বলবো।
বইটি পড়ে যদি তাদের চোখে পানি না আসে তাহলে আমার আর কিছুই বলার নেই। গতবার দেশে যাবার পর শুভ ভাই'র সাথে দেখা হয়েছে, এই লেখাটার মাধ্যমে শুধু এটুকু বলতে পারি, আমি যে কতটা কৃতজ্ঞবোধ করেছি সেটা বলে বোঝাতে পারবনা।
সেই শুরু। ধীরে ধীরে ব্লগারদের সাথে পরিচয় বাড়তে থাকে। আমিও সাহস পেতে থাকি।
সবাই যেভাবে, "বাহে, খবর কি?" বলে মন্তব্য করে আনিও শুরু করি। ধীরে ধীরে খাতির হয় হযবরল, সাদিক, ধুসর গোধূলী, ঝড়ো হাওয়া, মাহবুব মুর্শেদ, মোরশেদ ভাই,শোহেইল ভাই, শিমুল ভ্রাতঃ, তীরুদা, কৌশিকদা, কালপুরুষ, টিপু, কনফুসিয়াস, চোর, ত্রিভুজ, আস্তমেয়ে, সাব্বির (কোথায় যে গেলো!), দূরের কন্ঠস্বর -- আরো অনেকের সাথেই। ব্লগে দেখি পরিচিতমন্ডলের এক ছোটভাই, যে কিনা অলরেডী ব্লগস্পটে লিখে আমাদের কাছে বিখ্যাত, সেই সৌরভকে। এখানে লিখত "অনুভূতিহীন মানব" হিসেবে। তখনও মাহবুব সুমন ব্লগিং শুরু করেননি।
পরে সুমনের সাথে হেভী খাতির হয়, অসম্ভব চমৎকার একজন মানুষ। সুমনের চিন্তার ডাইমেনশনের প্রসার দেখে আমি রীতিমতো মুগ্ধ! যেকোন বিষয়েই সম্ভবতঃ একদম বেসিক জায়গাটাতে খুব সহজেই ফোকাস ফেলতে পারে সুমন। তবে ব্যাটার আহ্লাদ বেশী, ইদানিং আমাকে চাচা ডাকতে চায় । দেশে গিয়ে শুভ ভাইর সাথে দেখা হওয়ার পাশাপাশি দেখা হয় ঝড়ো হাওয়ার সাথে, এক কথায় বলা যায় ভালো মানুষ। চমৎকার হাসির সুদর্শন এই যুবক (মহিলা ব্লগারদের জন্য বিনা পয়সার টিপস ) সংক্ষিপ্ত আকারের লেখা লেখার জন্য বেশ বিখ্যাত।
যাকে বলে একেবারে রিয়াল ব্লগিং। ৭১ এর গল্প লেখার আহবানে ঝড়ো হাওয়ার বিশেষ সহযোগিতার সূত্রে বেশ খাতির হয়ে যায়, উনাকে ইদানিং দেখিনা ব্লগে। ব্যস্ত খুব?
ব্লগে অনেককিছু ঘটেছে, সব স্মৃতিতে থাকেনা, সব স্মৃতিচারণ না করলেও হয়। তবে এখনও মনে পড়ে স্বাধীনতার পক্ষে শুভ ভাই আর পিয়াল ভাই যেভাবে একের পর এক প্রমাণসহ পোস্ট করে যাচ্ছিলেন আর সেগুলো দেখে কিভাবে প্রকম্পিত হচ্ছিলাম। একথা আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি যে ব্লগে আসার ফলে স্বাধীনতার ইতিহাস বিষয়ে সচেতনতা অনেক বেশী বেড়েছে, অনেক কিছু নতুনভাবে জেনেছি, দালালগুলোকে নতুনভাবে চিনেছি।
এখন ভাবি, আরো আগেই জানা উচিত ছিলো, আরো বেশী পড়া উচিত ছিলো। আমরা ৮০ এর দশকে এরশাদের আফিম খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা প্রজন্মের, অনেক কিছুই জানতে পারিনি, অনেক কিছুই জানতে দেয়া হয়নি। সেগুলো যে সাইবারমাধ্যমের কল্যাণে এভাবে বেরিয়ে আসতে পারছে, এটা একটা বিরাট পাওয়া।
আরেকটা ব্যাপার ছিলো, প্রাপ্তির চিকিৎসায় ব্লগারদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার প্রেক্ষিতে তৈরী প্রস্তাবনা, "প্রাপ্তি ফাউন্ডেশন"। ভবিষ্যতে ব্যয়বহুল দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুদের কাছে যাতে সবার সহযোগিতা খুব দ্রুত পৌঁছে যেতে পারে, সেজন্য একটি ফান্ড গঠনের প্রক্রিয়া।
কৌশিকদা একটা বিশাল সংবিধান লিখে ফেললেন, কয়েকজন মিলে লোগো বানিয়ে ফেললেন, আরো অনেক কিছু করা হলো। কিন্তু কিভাবে যেন উদ্যোগটা স্তিমিত হয়ে গেলো। প্রাপ্তি প্রসঙ্গে বলি, আশা করি, ছোট্ট প্রাপ্তিসোনা খুব শিগগিরই পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে উঠবে। এই প্রাপ্তির কল্যাণে সামহোয়ারে প্রচুর ঝগড়া/কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি বন্ধ হতো একসময়, সামহোয়ার আজকের টিকে থাকার জন্য প্রাপ্তির কাছে কোন না কোনভাবে ঋনী হয়ে থাকবেই।
তবে ব্লগে সবচেয়ে সাড়া ফেলেছিলো সম্ভবতঃ কৌশিকদার "আগুনের পরশমণি" সিরিজটা।
একেকজন ব্লগারের সাক্ষাৎকার নেয়া হতো, সবাই নানারকম প্রশ্ন করত, জমতো জিনিসটা। অনেকদিন পর ইদানিং কৌশিকদা সেটা আবারও শুরু করেছেন, আশা করি আবারও জমে উঠবে।
গত বছরের মাঝামাঝি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে হেলাফেলা করে লেখা একজন ব্লগারের একটি পোস্ট ডিলিটকে কেন্দ্র করে ব্লগে চুড়ান্ত রকমের ধুন্ধুমার লেগে গেল। আমার দূর্ভাগ্য, এরকম সব ধুন্ধুমার কান্ডগুলোতেই আমি হয় বিয়ের শপিংয়ে ব্যস্ত, না হয় সাইপানে অবকাশ কাটাচ্ছি (জানুয়ারীর ধর্মঘটের সময়েও অনেক পরে জানলাম)। তো, সেই ঘটনার ফলাফল এমনই হলো যে প্রায় জনাবিশেক বা তারও বেশী রেগুলার ব্লগার সামহোয়ার ছেড়ে চলে গেলন চিরতরে।
এরা সবাই খুব ভালো লিখতেন, অনেকের লেখার সাহিত্যমানও খুবই উঁচু। সবচেয়ে বড় কথা এরা সবাই ব্লগটাকে মাতিয়ে রাখতেন প্রচুর মন্তব্যে, আর পারস্পরিক ইন্টারএ্যাকশনে। এই ঘটনা নিশ্চয়ই সামহোয়ারের ইতিহাসে বিরাট একটা শক! ব্লগে এসে পুরো ঘটনা টের পেলাম সম্ভবতঃ পরদিন। আমি নিজে কখনই এভাবে ভাবিনা যে ব্লগ ছাড়তে হবে, কর্তৃপক্ষের কাছে এটা সেটা দাবী করার ভিত্তিতে। বিশেষ করে সামহোয়ার কর্তৃপক্ষের আচরণ পড়ে আমি যেটা বুঝেছি যে, তারা ব্লগারদের সাথে সেরকম কমিউনিকেশন রাখতেই আগ্রহী নন।
সম্ভবতঃ প্রয়োজনীয় হ্যান্ডসের অভাব।
একসেন্সে বলা যায়, ব্লগাররা কি চায় না চায়, সেটা নিয়ে তারা তেমন মাথা ঘামাননা। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও তাই, অতএব তাদের সাপেক্ষে আমি একই স্ট্যান্স নিই। তারা কি করছে সেটা দেখার আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো, সম্ভবতঃ যেদিন ব্যানকরা/আনব্যানকরার বাটন চালু হয়েছিলো সেদিন থেকেই। আমি সবসময়েই একশোভাগ বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী, এমনকি মিথ্যা কথা বলার স্বাধীনতার ব্যাপারে।
সেই বাটন তৈরীর দিনই মনে হয়েছে সামহোয়ারে ঝামেলা বাড়বেই। সেই বাড়া-কমার মাঝেই পেরিয়েছে সামহোয়ার ২০০৭ সাল। হয়ত এখন ধীরে ধীরে কনভার্জেন্সের দিকে যাচ্ছে। আমি তাই ব্লগ ছাড়িনি। আসলে যেকোন ব্লগেই আসি কেন? কর্তৃপক্ষের টানে? নেভার!! সহব্লগারদের টানে।
সহব্লগারদের কমেন্ট পড়ে, লেখা পড়ে মজা পাওয়ার টানে। এই যে সেদিন আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ হলে, জমজমাট খুনসুঁটি হলো ব্লগারদের মাঝে, আবার মাঝে মাঝে জটিল বিষয়গুলো গভীর আলোচনা হয় -- এগুলোর টানে। কাজেই ব্লগটা আমার কাছে স্টেডিয়ামের গেটের বেশী কিছু না, বাকী খেলোয়াড়, রেফারী, দর্শক সবই ব্লগাররা। সামহোয়ারে কত কত মেধাবী লেখকদের সাথে পরিচয়! এই যে গত বছর খাতির হলো --রাশেদ, প্রত্যুদা, এস্কিমো ভাই, রাগ ইমন, মিরাজ ভাই (এই লোক গেলো কই?), নির্বাসিত, জেবতিক দা, শিপন, ফারহান, মেহরাব, রন্টি, মুকুল, ইমন, বিষাক্ত মানুষ (আসলে ভালো), দুরন্ত, বাফড়া, গন্ডার, অচু, জোনাকি, মানবী, সাইফুর, ভাস্কর চৌধুরী, ঝড়ো, মাসু, হ্যারি, রাগিব -- আরো কত কত নাম!! সবার নাম লিখতে গেলে তো শেষই করা যাবেনা! আমার কাছে সামহোয়ার মানে এই মানুষগুলো, সময় পেলেই এখানে আমার আসা হবে,আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কে ঠেকাবে, এক বউ ছাড়া ।
সম্ভবতঃ কোনদিন বলতে পারবোনা আর লিখবোনা এখানে।
সেটা হয়না। আমি পুঁজিবাদী মানুষ, ভার্চুয়াল জগৎকে যতটা বাস্তবসম্মতভাবে ব্যবহার করা যায় ততটাই আমি করব। এটুকুই হয়তো এখন বলতে পারি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।