ইচ্ছেমতো লেখার স্বাধীন খাতা....
বাঘ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড থেকে জানা যায় সমগ্র পৃথিবীতে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ বন্য বাঘ অবশিষ্ট আছে। চায়নার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিতে বাঘের দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অত্যন্ত মূল্যবান। কিন্তু বর্তমানে চায়নায় বাঘের ক্রয় বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
তবু চায়নার জিয়ংসেন টাইগার অ্যান্ড বিয়ার পার্ক কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বাঘের বংশবৃদ্ধি করেই চলেছে।
ভবিষ্যৎ লাভের আশায় তারা বাঘের লালন পালন ও বংশবৃদ্ধির পেছনে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ইউয়ান লস দিয়েছে। ফার্মে মৃত বাঘের দেহ তারা কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করছে। তারা আশা করছে, অদূর ভবিষ্যতে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্রয়-বিক্রয় শুরু হবে।
চায়নার জিয়ংসেন পার্কে প্রতিদিন বহু টুরিস্ট ভিড় করেন। তবে তারা এ এলাকার চোখ জুড়ানো পাহাড়ি সৌন্দর্যের আকর্ষণে আসেন না।
তারা এ এলাকায় আসেন বিভিন্ন জীব জন্তুর ভয়ঙ্কর সব খেলা ও সার্কাস দেখতে। এর মধ্যে আছে বাঘ জ্যান্ত গরুকে আক্রমণ করে রক্তাক্ত করছে, শিম্পাঞ্জিরা সাইকেল রেস করছে বা উচু তারের উপর ভাল্লুক ও ছাগলের ডিসপ্লে। তবে এসব উদ্ভট শো-র কারণে নয়, ফার্মটি আন্তর্জাতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হতে যাচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে।
জিয়ংসেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুর্লভ প্রাণীর খামার। চায়নার দক্ষিণ দিকের গুইলিন শহরের ঠিক বাইরে খামারটির অবস্থান।
ছোট এ ফার্মটিতে প্রায় ১ হাজার ৩০০ বাঘ আছে, যা ইনডিয়ার মোট বাঘের প্রায় সমান। এছাড়াও ফার্মটিতে কয়েকশ’ ভাল্লুক, সিংহ ও পাখি আছে।
চায়নিজরা বহু দাম দিয়ে বাঘসহ দুর্লভ বিভিন্ন প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে বিভিন্ন রোগের ওষুধ, কামোদ্দীপক টনিক ইত্যাদি কিনে থাকে। কিন্তু আইনগত বিধিনিষেধের কারণে এখনো চায়নার এ ফার্মটি তাদের কোনো প্রডাক্ট বিক্রি করতে পারেনি। তাদের সব প্রডাক্টই তারা কোল্ড স্টোরেজে জমিয়ে রাখছে।
তারা আশা করছে, আইনের এ বিধিনিষেধ একদিন পরিবর্তন হবে। জিয়ংসেন কম্পানিটির প্রায় এক দশক ধরে লবিইংয়ের পর চায়না সরকার এ বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থা কনভেনশন অন দি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেনজারড স্পেসিস বা সিআইটিইএসকে চায়না জানিয়েছে বিশ্বব্যাপী বিধিনিষেধ আরোপ করার পরও বাঘের সংখ্যা বাড়েনি। যদিও এ বিধিনিষেধের কারণে চায়নার অর্থনীতির প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে এবং এতে চায়নার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
সংরক্ষণবাদী গ্রুপগুলো অবশ্য এ বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
তারা জানাচ্ছে, বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হলে তার ফল মোটেই ভালো হবে না। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড জানায়, এখন পৃথিবীতে বন্য বাঘ অবশিষ্ট আছে মাত্র ৩ হাজার ৫০০টি। এ তুলনায় চিড়িয়াখানা, সার্কাস ও আবদ্ধ স্থানে প্রায় ৬ হাজার বাঘ আছে। ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর অ্যানিমাল ওয়েলফেয়ারের এশিয়া অঞ্চলের ডিরেক্টর গ্রেস গ্যাব্রিয়েল জানান, বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হলে চায়নার বন্য বাঘ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের বাঘও শেষ হয়ে যেতে পারে।
জঙ্গলের প্রাণী বাঘকে চায়নিজরা বেশ নাটকীয়ভাবে খাচায় পোষা প্রাণীতে পরিণত করেছে।
১৯৫০ সালে দেশটির জঙ্গলে কয়েক হাজার বন্য বাঘ থাকলেও এখন সেখানে মাত্র ৫০টি অবশিষ্ট আছে। চায়নার উত্তর-পূর্বের আমুর টাইগার হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বিপদাপন্ন বাঘ। তবে ১৯৫০ সলের পর থেকে দেশটিতে খাচায় আবদ্ধ বাঘের সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে গেছে। শুধু জিয়ংসেনেই ১৯৯২ সালে মাত্র ১২টি বাঘ ছিল যা বর্তমানে বেড়ে ১ হাজার ৩০০ হয়েছে।
কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে খাচায় পোষা বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধিকে প্রাণী সংরক্ষণবাদীরা কোনো সাফল্য বলে মনে করেন না।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের একটি মনিটরিং গ্রুপ হচ্ছে ট্রাফিক। ট্রাফিকের এক কর্মকর্তা জানান, পার্কটি এতো বাঘের প্রজনন করাচ্ছে চায়না সরকার ও আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য। তিনি বলেন, জিয়ংসেন সবচেয়ে খারাপ বাঘের ফার্ম। এরা শুধু ব্যবসার জন্য প্রজনন করাচ্ছে। আমরা তাদের বাঘ প্রজনন থামানোর পরামর্শ দিয়েছি, কারণ বেশি বাঘ মানে বেশি সমস্যা।
তবু তারা বাঘের সংখ্যা বাড়িয়েই চলেছে। কারণ এতে সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার জন্য চাপ দেয়া সহজ হচ্ছে।
পার্কটির কিছু অংশ ফার্ম, কিছু অংশ চিড়িয়াখানা ও বাকি অংশ সার্কাস। প্রডাকশন লাইনের মতোই প্রতি বছর এখানে কয়েকশ’ বাঘের বাচ্চা জন্মানো হয়। এগুলোর মৃতদেহ কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণের মাধ্যমে এ পর্বের সমাপ্তি হয়।
জীবনকালে বাঘগুলোকে সারিবদ্ধ ছোট আকৃতির খাচায় বন্দি করে রাখা হয়। এ অবস্থাতেই বাঘগুলোকে হতাশভাবে পায়চারী করতে বা অলসভাবে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।
এদের মধ্যে সবচেয়ে ভাগ্যবান বাঘগুলো দর্শকদের দেখার জন্য ফুটবল মাঠের সমান আকৃতির একটি এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পায়। কয়েকটি আবার পার্কের ড্রিম থিয়েটার নামে সার্কাসের জন্য ট্রেনিং প্রাপ্ত। সার্কাসটিতে বাঘগুলোকে আগুনের রিংয়ের ভেতর দিয়ে লাফিয়ে যেতে হয়।
এছাড়াও সার্কাসটিতে বানরদের উটের পিঠে চড়তে বা ভাল্লুকদের নিরাপত্তা জালের বাইরে অনেক উচু তারের উপর দিয়ে সাইকেল চালাতে দেখা যায়।
পার্কে প্রতিদিন ঘুরতে আসা কয়েকশ’ টুরিস্টের জন্য মনে রাখার মতো সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় সম্ভবত প্রাণীগুলোর খাবার সময়। এ সময় বাঘের খাচায় ছেড়ে দেয়া হয় জ্যান্ত গরু বা মহিষ। দর্শকরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখে বাঘ কিভাবে একটা গরুকে আক্রমণ করে, তার ঘাড়ে দাত বসিয়ে দেয়, কিভাবে প্রাণীটি মৃত্যুযন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে ঢলে পড়ে।
রক্তাক্ত খেলাটি সাধারণত ১৫ মিনিট স্থায়ী হয়।
এ সময়ের মধ্যেই পোষা বাঘটি তার শিকারকে হত্যা করে ফেলে। এরপর বাঘটিকে তার খাচায় এবং অবশিষ্ট মৃত বা অর্ধমৃত শিকারটিকে কসাইখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কর্তৃপক্ষ বলে থাকে, শিকার ধরার প্র্যাকটিসটি রাখা হয় বনে ছেড়ে দিলে বাঘগুলো যেন শিকার করে খেতে পারে। তবে প্রাণী সংরক্ষণবাদীরা এ বিষয়টি অবাস্তব বলে জানাচ্ছেন। তারা জানাচ্ছেন, জিয়ংসেনের কোনো প্রাণীই বন্য জীবনে ফিরে যাওয়ার মতো উপযুক্ত হবে না।
এমএস গ্যাবরিয়েল বলেন, এ ফার্মটি বাঘের যতো দ্রুত সম্ভব বংশবৃদ্ধি করাচ্ছে প্রডাক্ট হিসেবে এদের বিক্রি করার জন্য। এদের জেনেটিক বিশুদ্ধতাও পরিবর্তন করা হয়েছে। এগুলো যদি দুর্ঘটনাক্রমে বনে চলে যায় তাহলে বনের বাঘকে এরা দূষিত করবে।
পার্কের এক কর্মী বলেন, বাঘের শরীরের প্রতিটি অংশই মূল্যবান। তবে বিধিনিষেধের কারণে আমরা এখনো এগুলো বিক্রি করতে পারছি না।
প্রত্যেক বছর দুই-একটি বাঘ মারা যায়। আমরা এগুলো ফ্রিজে রেখে দিই। সরকার এগুলো বিক্রি করার অনুমতি দিলে আমরা বিক্রি শুরু করবো।
পার্কটির প্রধান বিজনেস বাঘকে কেন্দ্র করে। এ কারণে পার্কের সব জায়গাতেই বাঘের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়।
পার্কের নিজস্ব রেস্টুরেন্টে কনকোয়ারিং কিং নামে ৫০০ ইউয়ান দামের একটি ডিশ পাওয়া যায়। কনকোয়ারিং কিং শব্দটি বাঘ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও এখানে সিংহ, কুমির, ময়ূর, সাপ, ভাল্লুক ও বিড়ালের ডিশ পাওয়া যায়। রেস্টুরেন্টের ওয়েটার বলেন, সব খাবারই এ পার্কে উৎপন্ন। তবে কোন খাবার কি উপাদান দিয়ে তৈরি, তা আমরা বলবো না।
বাকিটা আপনাদের কল্পনা করে নিতে হবে।
অবশ্য বন্য প্রাণী ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা পার্কটির ব্যবসায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে। পার্কের একজন কিপার জানান, মাসে ৫০০ ইউয়ান ইনকাম করতেই তাদের বেশ কষ্ট হয়। ফ্যাক্টরি ও বিল্ডিংয়ের কাজ করা মাইগ্রান্ট শ্রমিকদের ইনকামের তুলনায় এটা বেশ কম। অফিসের ম্যানেজাররা জানান, তারা তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে বেতন পাচ্ছেন না।
সেলস ম্যানেজার ব্যাই ওয়েনকিয়াং বলেন, নিষেধাজ্ঞার কারণে আমাদের ব্যবসার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের বসের আসল প্ল্যান ছিল এমন একটি পার্ক তৈরি করা যা মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে সাহায্য করবে, বাঘের সংখ্যা বাড়াবে এবং পরিবেশেরও উপকার করবে। তবে কাজ শুরু করার পর থেকে আমরা ৪০০ মিলিয়ন ইউয়ান লোকসান দিয়েছি। তিনি আরো বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তিন প্রজন্ম ধরে পোষার পর প্রাণীগুলোর বিজনেস করা যায়। এখন শুধু চায়নার স্থানীয় আইনের কারণে আমরা ব্যবসা করতে পারছি না।
আমরা জানি, চায়নিজ সরকার আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক চাপের মুখে আছে। তারা আমাদের সাহায্যও করে না আবার ক্ষতিও করে না।
ব্যাকস্টোরি
চায়নায় প্রায় ৫ হাজার বছরেরও আগে থেকে চিকিৎসার কাজে বাঘের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার হয়। সেখানে একটি প্রাণীর দাম চাহিদা অনুযায়ী ১ কোটি টাকারও বেশি হতে পারে। ওষুধ হিসেবে একটি প্রাণী দেহের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ হচ্ছে হাড়।
বাঘের ২৫ কেজি হাড়ের দাম হতে পারে ২.৪ মিলিয়ন ইউয়ান বা ১ লাখ ৬০ হাজার পাউন্ড। চায়নায় ১৯৯৩ সাল থেকে বাঘের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। পার্কের ভেতর বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ও পানীয় বিক্রি হয়। পার্ক কর্তৃপক্ষ যেগুলোর উপাদান সম্পর্কে কিছু জানায় না। এর মধ্যে আছে প্রায় ৬০ পাউন্ড দামের হাড় শক্ত করার পানীয়।
তারা জানায়, এটি বাঘের থাবার উপাদান দিয়ে তৈরি। বিষয়টি যদি সত্য হয় তবে তা হবে চায়না ও আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। শুধু বাঘ নয়, অন্যান্য দুর্লভ প্রাণীও চায়নার প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ। গুইলিনে ওষুধ হিসেবে সি হর্স, কুকুর, হরিণ, সাপ, পিপড়ে প্রভৃতি প্রাণীর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি হয়।
(পুরনো লেখা)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।