জীবন গঠনে নিজেস্ব প্রতিক্রিয়ার দায় বেশি, ঘটে যাওয়া ঘটনার ভূমিকা সামান্য।
বছর খানেক আগে আস্তমেয়ে নিকে লিখেছিলাম ,
"আমার খুব মানুষ দেখার শখ। উত্তর বঙ্গে খালি পায়ে ঠেলা গাড়িতে চলার পাশাপাশি ইউরোপের আল্পস মুগ্ধ চোখে দেখতে চাই। চীনের কোন গ্রামে বসে পূর্বপুরুষের বন্দনা করতে চাই। আফ্রিকার সুন্দর মানুষগুলোর সাথে আগুন ঘিরে বসে প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে চাই।
সাউথ আমেরিকার খোলা মনের মানুষগুলোর সাথে গলা মিলিয়ে হাসতে চাই, গান গাইতে চাই। মধ্যপ্রাচ্যের মাথা গরম মানুষগুলোর পাশে কালো বোরখায় নাক ঢেকে 'কেউ একজন' হয়ে যেতে চাই। মেয়ে আমি। আস্তমেয়ে। মেয়েদের অনেক বাঁধা, নিজের তৈরি, সমাজের তৈরি, ভালবাসার তৈরি।
কতদূর পায়ের চিহ্ন ফেলতে পারব জানি না। কিন্তু এই একটা বছর আপনাদের সাথে থাকলাম, অনেকগুলো 'মানুষ' দেখলাম... আমার খুব বেশি ভাল লেগেছে। খুব। "
তখন লিখি নি, আমি সিঙ্গাপুরে বসে সুদূর ইউরোপের এক ভবিষ্যত নিউরোসাইন্টিস্টের চোখ ভরা স্বপ্ন দেখতে চাই। মালয়শিয়ার তিওমান দ্বীপে পৃথিবী উদ্ধারের তীব্র স্বপ্নে ডুবে থাকা মানুষগুলোর সাথে সাগরের নীলে হারাতে চাই।
বাংলা, ইংরেজি, একটু একটু আরবি শেষে এখন ইন্দোনেশিয়ানে নিজের জিভ নাড়াতে চাই। বলি নি, কারণ তখন জানতাম না, ঠিক এক বছর পরে পৃথিবীকে নিজের করে নেয়ার অভাবনীয় একটা সুযোগ নিজ দোরে দেখা দিবে। আমার ফ্যাকাল্টি থেকে ফান্ড করছে আমাকে, সিঙ্গাপুরগামী প্লেইনে চড়বো আর মাসখানেক পরেই।
লিখেছিলাম, সামহোয়ারে এক বছরে অনেক মানুষ দেখে তীব্র ভালো লাগার কথা। ভেবেছিলাম, যখন যেখানেই মানুষ দেখি, যেই সামহোয়ার আমার যাত্রা শুরু করিয়ে দিয়েছিল, সেই সামহোয়ারে এসে নিজেকে উজাড় করে যাবো।
আমার প্রথম সত্যিকারের বিদেশ যাত্রা, সিঙ্গাপুর যাত্রার সম্ভবনার পর থেকেই ভাবছিলাম, সামহোয়ারে ভার্চুয়াল দিনলিপি লিখতে হবে ঠিক। থুঁটি নাটি সব লিখবো! কয়টা একুশ বছর বয়সী বাংলাদেশী, তাও আস্ত এক খানা মেয়ে, এমন সুযোগ পায় বলুন!
আজ লিখলাম প্রথম পর্ব। ভ্রমন পূর্ব 'কি হবে না হবে' অনুভূতিতে ভরা পোস্ট। ব্লগস্পটে পোস্ট করলাম, সামহোয়ারে পোস্ট করতে পারলাম না।
কেন?
উত্তর দেয়ার আগে, আপনাদের জন্য জন্য একটি সহজ ধাঁধাঁ।
বলুন তো, পৃথিবীর কোন্ দেশে অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে প্রতিবাদকারীকেই বধ হতে হয়? মেয়ে হলে তো কথাই নেই!
পারলেন না?
সে কি, সামহোয়ারইনে নিয়মিত আসেন, কিন্তু এই সহজ ধাঁধাঁর সহজ উত্তরটুকুও জানেন না?
উমম... হিন্ট দিচ্ছি, মানবীর ব্লগে যান। পড়ে দেখুন রাহেলা সংক্রান্ত পোস্টগুলো।
মেয়েটা কি নৃশংস ব্যবহার পেয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল, সেই কত বছর আগের কথা। এখনও ওর খুনী ধর্ষকের পৃথিবী দাপিয়ে হেঁটে বেড়ায়।
এ লজ্জার কাহিনী আপনার আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের কাহিনী।
কি, রাহেলার গল্প শুনে ঘেন্নায় রক্ত জ্বলে উঠে? রাহেলার সুবিচারের পিটিশনে সাইন করেন?
রাহেলাদের জন্ম এক দিনে হয় না। রাহেলা হত্যা মামলার আসামীরা ভূমি ফুঁড়ে বের হয় না। ওদের সৃষ্টিতে আপনার নিজেরও হাত আছে। আমাদের আশে পাশেই যে রাহেলার নির্যাতনকারী আর তাদের মাথায় তুলে রাখা মানুষে গিজ গিজ। আপনি কখনও তা নিয়ে সাহস করে কিছু বলেন নি, কারণ, রাহেলাদের নির্যাতনকারীদের হম্বিতম্বি আর কালো হাতের নিচে পিষে পড়বেন নিজেই।
পড়ুন, দেখুন, জানুন।
যা ভার্চুয়ালী প্রকাশিত হয়েছে, তা ভার্চুয়ালিটিতে সীমাবদ্ধ না থাকলে পৃথিবীতে আরেকটা রাহেলার জন্ম হতো। প্রচন্ড অশ্লীল মন্তব্য , দিনের পর দিন ঝুলে থাকার পরে আর অসংখ্য ইমেইলের মাধ্যমে প্রতিবাদ করার পরে কর্তৃপক্ষের চুপিসারে শুধু মন্তব্যটা ডিলিট করে দেয়া, আর একে সুবিচার মনে না করার 'অপরাধে' প্রতিবাদকারিনীর বধ হওয়া। হুম, রাহেলার খুনীরাও হয়তো 'এই দুষ্টু, আর এরকম করবি না' টাইপের বকা খেয়েছে। মানবীকে বলা দরকার, ওতটুকুই তো যথেষ্ট! কারো কোন অধিকার নেই একে সুবিচার মনে না করার!
ঘটনা এখানেই শেষ না, প্রতিবাদকারিনীকে বধ করার পরে অপরাধীর চরিত্রের যেই কালিমা প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে , সেই দাগ উঠাতে, ওই অশ্লীল মন্তব্যকে জাস্টিফাই করার জন্য এর উপর একের পর এক পলিটিক্যাল রং চড়ানো হচ্ছে।
রং চড়ানো বললাম, কারণ অপরাধীর এরকম মন্তব্য এই প্রথম না। এবারে শুধু পলিটিক্যাল রং চড়ানোর রাস্তাটা সহজ ছিল। আমার প্রিয় পোস্টে রাখা শেষ তিনটা পোস্ট নিজেই পড়ে নিন, নতুন চোখের জন্ম হবে।
ভার্চুয়াল জীবনে একটা প্রতিবাদ করতে কি এসে যায়? আপনি চাকরি খোঁয়াবেন না, আপনাকে বাসায় গিয়ে কেউ মেরে আসবে না, কিন্তু আমরা যে সম্মিলিত মেরুদন্ডহীনতায় ভুগছি, তা থেকে বেঁচে আসার জন্য ছোট্ট একটা প্রয়াস হতে পারতো!
আপনি নিজে মেয়ে না হলেও একজন মেয়েকেই বিয়ে করবেন, আপনার কোল আলো করে টুকটুকে এক মেয়ে আসবে। দেশটাকে কাঁটামুক্ত না করলে আপনাকে, আপনার প্রিয় স্ত্রীকে, কিংবা আপনার রক্তে মাংসে গড়া মেয়েকেই হেঁটে যেতে হবে এই কাঁটাপথে।
নিজের গা বাঁচাতে চুপ থেকে লাভ নেই। সামহোয়ারের মত একটা পাবলিক ফোরামে জনমতই সব। আমার প্রিয় পোস্টের শেষ তিনটা পোস্ট পড়ে দেখুন, কর্তৃপক্ষকে আপনার ভাবনার কথা জানান। কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করে চোখ বন্ধ করে আছে আমি বিশ্বাস করতে চাই না। দেখিয়ে দিন, আজ হোক, কাল হোক, তারা দেখবেন হয়তো!
এই পুরা ব্যাপারটায় আমি অনেক সময় ব্যয় করে সামহোয়ারে অন্তত: তিনটা ইমেইল করেছি, একটারও জবাব পাই নি।
আমার দৃঢ় সন্দেহ হচ্ছে, অশ্লীল মন্তব্যটা অসংখ্য প্রতিবাদী ইমেইলের বেড়ী ভেদ করে অনেকদিন ঝুলে থাকলেও এই পোস্ট প্রথম পাতায় যাওয়ার সাথে সাথে বধ হবো।
হলে ক্ষতি নেই আমার, দীর্ঘ, দীর্ঘ দিন সামহোয়ারের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা নিয়ে থাকতে পেরেছি। রাগ ইমনকে করা ত্রিভুজের একটা কমেন্টের জন্য ত্রিভুজকে তিন মাসের জন্য ব্যান করা হয়েছিল। সামহোয়ারইন এ ধরণের অশালীন মন্তব্যের ব্যাপারে খুবই অসহনশীল বলেই জানতাম। অন্তত: এই রকম একটা বিষয়ে, যাকে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে অশোভন এবং অমানবিক বলে জানে, সেরকম একটা বিশ্বজনীন, অবিতর্কিত ক্রাইমের ব্যাপারে প্রতিবাদ করে কাজ হয় নি, সেরকম আগে দেখি নি।
কিন্তু এবার কালো হাতের স্পর্শ অনেকদূর চলে গিয়েছে মনে হয়। কমেন্ট ডিলিটে অপরাধীর গা বাঁচানোই সহজ হয় কেবল, রেকর্ড ডিলিটেড।
তাই আপাতত: লেখা বিরতি দিচ্ছি সামহোয়ারইনে। উহু, পুরাপুরি চলে যাবো বলবো না, কারণ আমি স্বপ্নবাজ মানুষ। কখনও যদি রাহেলার খুনী মনস্কদের কালো হাতের ছায়া সরে যেতে দেখি, তাহলে আসবো।
কিন্তু দীর্ঘ দিন আপনাদের মাধ্যমে পৃথিবীকে চিনেছি বলে আপনাদের বলে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছি। আপাতত আমার পৃথিবী দেখার গল্প করবো ব্লগস্পট থেকে, সন্ধ্যাবাতি.ব্লগস্পট। আমার স্বপ্ন দেখার দিনগুলোতে আপনাদের স্বপ্ন ধার দেয়ার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
ভালো থাকবেন সবাই, আপনার মা, মেয়ে, বোন, স্ত্রী, প্রিয়তমা, সবাইকে নিয়ে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।