আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সোনাদিয়ার বিধবারা



সোনাদিয়ার বিধবারা হাসনাত আবদুল হাই মুন্সী কেফাতুল্লা দাড়িতে হাত দিয়ে বিলি করতে করতে হেসে বলবেন, হুজুর জরিমন, তাহেরা, শাহের বানু, আয়েশা, জয়তুন, শফুরা, নূরজাহান সোনাদিয়ার এইসব বিধবারা নিজেরা কইলে তো হইবো না। সাক্ষী আনতে কন, সাবুদ দেখাইতে কন। বিচার কি হুদা মুখের কথায় হইবো? আদালত যখন হইছে, আসামী বানাইছে আমারে আর বিচার হইবো, তহন সব নিয়ম-কানুন মাইনা চলনই কি ঠিক না? আপনেই কন। শুনে বিচারক মৃদু মাথা নাড়েন, তাকে চিন্তিত দেখায়। তিনি মামলা পরিচালনাকারীর দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলবেন, কেবলই অভিযোগ? কোন সাক্ষী নেই? মানে প্রত্যদর্শী? ফটো-টটো তো থাকার উপায় নেই।

সেই সময় জান হাতে নিয়ে কেই বা এদের স্বামীদের লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে মারার দৃশ্য তুলতে সাহস পাবে? আর সোনাদিয়ার মত সেই ১৯৭১ সালে কারই বা ক্যামেরা থাকবে? কিন্তু তখন নিজ চোখে দেখেছে এবং আসামীর জড়িত থাকার কথা জেনেছে এমন কেউ কি নেই? মানে আই উইটনেস। মামলা পরিচালনাকারী একইভাবে ফিসফিস স্বরে বলবেন, হুজুর, তেমন সাক্ষী নাই। যারা ছিল এই সাঁইত্রিশ বছরের মধ্যে তাদের মৃত্যু হয়েছে। একই কারণে তখন যারা বিধবা হয়েছিল তাদেরও অনেকের মৃত্যু হয়েছে। শুধু এই কয়জন বেঁচে আছে।

জরিমন, তাহেরা বানু, আয়েশা, জয়গুন, শফুরা, নূরজাহান, এই বিধবারা। বিচারক আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো কেফাতুল্লাহর দিকে তাকিয়ে বলবেন, আপনি এদের চিনতে পারেন? লা হাওলা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। কি যে কন হুজুর। আমি মাইয়া মানুষের দিকে তাকাইয়া গুনাহ করতে যামু ক্যান? না, চিনি না, দেখি নাই কুনো দিন। কেফাতুল্লাহ জোরের সঙ্গে বলবে।

বিচারক টেবিলে কলম ঠকুতে ঠকুতে বলবেন, এদের নাম শোনেন নাই? জরিমন, তাহেরা, শাহের বানু, আয়েশা, জয়গুন, শফুরা, নূরজাহান এই সব বিধবাদের নাম? পঁচাত্তর বছরের মুন্সী কেফাতুল্লা মাথার টুপি ঠিক করতে করতে বলবে, হুজুর, এই সব নাম অনেক মাইয়ারই হয়। দেখবেন এক সোনাদিয়া গ্রামেই হয়তো তিনজন জরিমন, চারজন তাহেরা, পাঁচজন শাহের বানু, ছয়জন আয়েশা, সাতজন জয়গুন, দশজন নূরজাহান আছে। একই নাম ঘুইরা ফিরা দেখা যায়। নামের বড় কাহাত মানে অভাব, বাপ-মায়ে একেবারে নতুন নাম খুঁইজা পায় না। যে মৌলভী সাহেবরে ডাকা হয় তিনিও পান না।

তাই শফুরা, শাহের বানু, জরিমনদের সংখ্যা বাড়ে। বিচারক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলবেন, কিন্তু তাদের স্বামী? সব নূরজাহানের পিতা আর স্বামীর একই নাম হতে পারে না। স্বামী আর পিতার নাম ভিন্ন হবে। সেই নাম দিয়ে সনাক্ত করা যায়। কেফাতুল্লাহ বলবে, হুজুরের সঙ্গে দ্বিমত করার সাহস নাই।

আপনি যা কইলেন তা হক কথা। কিন্তু এই বিধবাদের মা-বাপ আর স্বামীদের তো চিনা লাগবো? কি কন হুজুর? বিচারক মাথা নেড়ে সায় দেবেন। সেটা থেকে কেফাতুল্লা উৎসাহবোধ করবে। সে বলবে, আমি এদের বাবা-মা, স্বামীর নাম জানি না। তাদের দেখিই নাই।

কিন্তু তারা সোনাদিয়ার বাসিন্দা ছিল। আপনি সেখানকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। মামলা পরিচালনাকারী বলবে। কেফাতুল্লা বলবে, হইছিলাম, মিথ্যা কমু ক্যান। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হইয়া গ্রামের অনেককে বাঁচাইছি।

গ্রামের বাড়ি-ঘর পাঞ্জাবীদের হাতে আগুন লাগান থাইকা বাঁচাইছি। খারাপ কিছু করি নাই সেই সময়। খারাপ কাজ করলি পর মুক্তি বাহিনীর পোলাপানে আইসা জানে মাইরা ফালাই তো। মামলা পরিচালনাকারী কাগজে চোখ রেখে বলবেন, আসামী স্বাধীনতার পর পলাতক ছিল। শহরে লুকিয়েছিল।

১৯৭৫ সালে আগস্টের পর গ্রামে ফিরে আসে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই পালিয়ে বেড়াচ্ছে কেননা তাদের খোঁজা হচ্ছে। ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়েছে। সেই সময় মুন্সী কেফাতুল্লাহ সোনাদিয়ায় ফিরে এসে নিজের বাড়িতেই বস-বাস শুরু করে। সে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অভয় দিয়ে আশ্রয় দেবার নাম করে ধরিয়েও দেয়।

তাঁদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেই অভিযোগও আছে। শুনে কেফাতুল্লা হাসবে। সে বলবে, অভিযোগ তো অনেকই আনা যায়। ভালা কাম করলে সকলে কি খুশী হয়? হয় না।

কারো না কারো স্বার্থে লাগে। তারা বেজার হয়। অভিযোগ করে নানা অজুহাতে। কিন্তু হুজুর আপনি অনেক জানেন। অনেক বুদ্ধি আপনার।

আপনিই কন শুধু অভিযোগে কাম হয়? বিচার হয়? সাক্ষী কই? প্রমাণ কই? বিচারক তখন মামলা পরিচালনাকারীকে বলবেন, এই শেষের অভিযোগ, মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেওয়া, তাদের নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগেরও সাক্ষী প্রমাণ নেই? না হুজুর, নেই। এই মানে অপরাধের অভিযোগের সময় তো ১৯৭১। তখনকার কেউ বেঁচে নেই? মামলা পরিচালনাকারী মাথা চুলকে বলবে, আছে। তাদের ডাকাও হয়েছিল। তাহলে? বিচারক তাকাবেন।

তাদের ধমক দেওয়া হয়েছে। ভয় দেখানো হয়েছে। তাই আসেনি। সাক্ষী দিতে চায় না কেউ। কারা ভয় দেখিয়েছে? আসামীর লোকজন? বিচারক তাকাবেন তার দিকে।

মামলা পরিচালনাকারী বলবে, তারা রাতের অন্ধকারে এসেছিল। তাদের হাতে গ্রেনেড, রাইফেল, বোমা বানাবার সরঞ্জাম। এইসব মারাত্মক অস্ত্র ছিল। তাদের মুখ কাপড়ে ঢাকা ছিল। তাদের চেনা যায়নি।

তারা সোনাদিয়ার মানুষ হতে পারে, নাও হতে পারে। কিন্তু তারা রাতের অন্ধকারে এসে এই মামলার যে কয়েকজন সাক্ষী পাওয়া যায় তাদের শাসিয়ে গিয়েছে। প্রয়োজনে আরো আসবে বলে গিয়েছে সিংস্র হয়ে। বিচারক জিজ্ঞাসা করবেন, কাদের শাসিয়েছে তারা? মামলা পরিচালক বলবে, যারা সাক্ষী দিতে পারে, এমন সবাইকে। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবিত বাবা-মা এবং তাদের মধ্যে যারা বিবাহিত ছিল তাদের স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের।

বিচারক সামনে বসে থাকা সোনাদিয়ার বিধবাদের দিকে তাকিয়ে বলবেন, কিন্তু এরা এসেছে সাী দিতে। অভিযোগের সমর্থন জানাতে। এদের কি ভয় দেখায়নি তারা? শাসায়নি? এদেরকে ভয় দেখিয়েছে। শাসিয়েছে। কিন্তু এরা ভয় পায়নি।

কেন ভয় পায়নি? বিচারক একটু অবাক হবেন। তারা বলেছে, আমরা তো মইরাই আছি। এই যে এত বছর গেল গিয়া কত ঝড়-তুফান বইয়া গেল আমাদের উপর দিয়া। আমরা যে বাঁইচা আছি এইটা মরনের চাইয়া কি আর এমন ভালা? এইভাবে আর না হয় নাই বাঁইচা থাকলাম। জানা-পরিচয় কত মানষে মরছে গুলিতে, ঝড়ে, গর্কিতে আমরাও না হয় মইরা যামু।

কিন্তু তার আগে বিচারটা দেইখা যাই। বিচারক সামনে বসা জরিমন, তাহেরা, শাহের বানু, আয়েশা, জয়ত্তন, শাকুরা, নুরজাহান বেওয়াদের দিকে তাকান। কারো ষাট, কারো সত্তরের ওপর বয়স হবে। মুখে গভীর বলিরেখা। মাথার শুকনো খড়ির মত সাদা চুল।

হাত-পা শীর্ণ। মলিন ছেঁড়া শাড়ির রঙ এক সময় সাদাই ছিল, এখন ময়লা জমে কালচে ধূসর দেখাচ্ছে। কোটরাগত চোখ দিয়ে তারা খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে বিচারকের দিকে। তিনি সেই দৃষ্টির সামনে অস্বস্তিবোধ করবেন। এক সময়ে চোখ নামিয়ে টেবিলে রাখা কাগজপত্রের দিকে তাকাবেন।

তারপর উঠে দাঁড়াবেন। ধীর পায়ে এজলাস থেকে নিষ্ক্রান্ত হবেন। বিশেষ আদালতের সামনে ছোটখাট ভিড় জমবে। ভিড়ের মধ্যে সাংবাদিক কয়েকজন। তারা হাতে কাগজ-কলম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসবে।

আদালত প্রাঙ্গণের কোলাহলে প্রথমে তাদের কথা শোনা যাবে না। মামলা পরিচালনাকারী তাদের শোনার মত কণ্ঠস্বর উঁচু করে বলবে, আজ শুনানি স্থগিত রাখা হয়েছে। মামলা চলবে। সাংবাদিকদের একজন বলবে, সাক্ষী? সাক্ষীর কি হলো? শোনা যাচ্ছে সাক্ষী নেই। মামলা পরিচালক ভিড়ের পাশে দাঁড়ানো জরিমন, তাহেরা, শাহের বানু আয়েশা, জয়ত্তন, শফুরা, নুরজাহান, সোনাদিয়ার এইসব বিধবাদের দেখিয়ে বলবে, কেন সাক্ষী থাকবে না কেন? এই যে সব সাক্ষী।

এদের স্যা নেওয়া হলো আজ। এরাই মেইন প্রসিকিউশন উইটনেস। ২. উপজেলা কর্মকর্তা টেবিলের সামনে রাখা কাগজে নামের তালিকার সঙ্গে বিতরণ করা রিলিফের মালামালের সংখ্যা আর পরিমাণ মিলিয়ে দেখছেন। পাশে তার দুই সহকারী দাঁড়িয়ে সাহায্য করছে। সামনে ভূমি দপ্তরের সহকারী কমিশনার বসে আছেন।

মাথার ওপরে পুরনো ইলেকট্রিক ফ্যান ঘ্যার ঘ্যার শব্দে ঘুরছে বাচ্চাদের নাকি কান্নার মত। বাইরে ফেরিঅলার ডাক, মোটর সাইকেলের ভটভট শব্দ আর লোকজনের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ কোলাহল বেড়ে যাওয়ায় উপজেলা কর্মকর্তা কাগজ থেকে চোখ তুলে খোলা দরজা দিয়ে তাকান। তিনি দেখেন ময়লা, আধ ছেঁড়া সাদা রঙ শাড়ি দিয়ে জীর্ণ শরীর জড়ানো, বয়সের ভারে প্রায় নুয়ে পড়ার একদল বয়স্কা গ্রামের মেয়ে লোক তার অফিসের সামনে জড়ো হয়েছে। দেখে তাঁর ভ্রূ কুঞ্চিত হয়।

বিরক্তির সঙ্গে তিনি বলেন, এরা এসেছে কেন? তার সহকারী দেখে নিয়ে বলে, মনে হয় রিলিফ নিতে। সাইক্লোন সিডরের ক্ষতিগ্রস্ত। সিডরের রিলিফ দেয়া কবেই শেষ হয়েছে। তারা এতদিন কি করছিল? তারপর কাগজের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, এই তালিকায় কি এদের নাম নেই? উপদ্রুত সব এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত জীবিত মানুষের নাম আনা হয়েছে। এরা কি বাদ পড়েছিল জরিপে? তখন ভূমির সহকারী কমিশনার বলেন, বাদ পড়তেও পারে।

এখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বাররা প্রায়ই পলাতক। মন দিয়ে কাজ করছে না। যাদের পাওয়া গিয়েছে হয়তো তারা কোনরকমে দায়সারা গোছের কাজ করে দিয়েছে। জরিপে বাদ পড়ে যাওয়া আশ্চর্যের কিছু না। হয়ত এরা বাদ পড়ে যাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ।

উপজেলা কর্মকর্তা বলেন, এদের বিদায় করতে হয়। সাংবাদিকরা ঘন ঘন আসা-যাওয়া করছে সিডর এর পর ত্রাণ কাজ সম্বন্ধে জানতে। এদের দেখে হয়তো একটা চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন লিখে পাঠাবে। লিখবে ত্রাণ বিতরণ সবার কাছে পৌঁছায়নি। তারা খারাপ খবরই খোঁজে।

ভাল কাজের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। চলুন দেখি। কি বলতে চায় ঐ মেয়েগুলো। তারপর ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে কিছুটা অবাক হয়ে বলেন, সবই দেখছি প্রৌঢ়া আর বৃদ্ধা। প্রায় একই বয়সের আর বিধবা মনে হচ্ছে।

সব সাদা থান পড়ে আছে। আশ্চর্যের ব্যাপার। একই এজ গ্র“পের মেয়েরা এখানে এসেছে কেন দলবেঁধে। গ্রামের মেয়েদের সামনে এসে একজন উপজেলা সহকারী বলে, কই থেইকা আইছো তোমরা? মেয়েদের একজন বলে, সোনাদিয়া। সহকারী উপজেলা কর্মকর্তার দিকে তাকিয়ে বলে, হ্যাঁ।

স্যার সিডর সোনাদিয়া গ্রামের উপর দিয়ে গিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা। উপজেলা কর্মকর্তা শোনার পর মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলেন, তোমরা রিলিফ পাও নাই? মেয়েদের মধ্যে একজন বলে, পাইছি। শুনে উপজেলা কর্মকর্তা বলে, সবাই পেয়েছো? জ্বি। হগ্গলে পাইছি।

তাহলে? আবার এসেছো কেন? উপজেলা কর্মকর্তা অবাক হয়ে তাকান। তারপর বলেন, আর রিলিফ দেয়া হচ্ছে না। রিলিফ দেয়া শেষ। মেয়েদের মধ্যে তখন একটা গুঞ্জন ওঠে। সবাই একসঙ্গে প্রায় চিৎকার করে বলে, বিচার চাই।

আমরা বিচার চাইতাম আইছি। শুনে বেশ অবাক হয়ে যান উপজেলা কর্মকর্তা। তাকে অপ্রস্তুত দেখায়। তিনি ভ্রূ কুচকে বলেন, বিচার? কার বিচার? তার মনে মনে সন্দেহ হয় হয়তো কোথাও রিলিফ বিতরণে অনিয়ম হয়েছে এবং তারই বিচার চাইতে এসেছে মেয়েগুলো। কিন্তু শুধু মেয়েরা কেন? পুরুষরাও রিলিফ চুরির জন্য অভিযোগ করে বিচার চাইতে পারে? তারা আসে নি কেন? ভয়ে? উপজেলা কর্মকর্তা বলেন, দরখাস্ত এনেছো? কার বিরুদ্ধে অভিযোগ, কোন ধরনের অভিযোগ? সব বলতে হবে।

মেয়েদের একজন দলা মোচড়া, ময়লা একটা কাগজ এগিয়ে দেয় তাঁর দিকে। উপজেলা কর্মকর্তা সেটা পড়েন। অভিযোগই বটে তবে রিলিফ চুরির জন্য না। তাদের স্বামীদের হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য গ্রামের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান এক মুন্সী কেফাতুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ। পড়া শেষ হলে কাগজটা তিনি ভূমি সহকারী কমিশনারের হাতে দিয়ে সোনাদিয়া গ্রামের প্রৌঢ়া আর বৃদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

নিজ মনে উচ্চারণ করেন, ১৯৭১, শান্তি কমিটি, মুক্তিযোদ্ধা, এতদিন পর এইসব কথা তুলছে কেন এরা? ১৯৭১-এর পর কত কিছু ঘটে গেল এদেশে। এরা হঠাৎ ১৯৭১-এ ফিরে গেল কেন? তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, এতদিন পর বিচার চাও কেন? মেয়েদের মধ্যে একজন বলে, হুনলাম সরকার কইছে বিচার হতি পারে। এমনু কথা এর আগে হুনি নাই। কওয়া হইছে সবাইরে মাফ কইয়া দিছে। তাই দরখাস্ত দিই নাই।

অহনে খবর পাইয়া আইলাম। আমরা বিচার চাই। তার কথা শেষ হবার সঙ্গে অন্য মেয়েরা বলে ওঠে, বিচার চাই। উপজেলা কর্মকর্তা দরখাস্তের নীচে নামগুলো পড়তে থাকেন, জরিমন, তাহেরা, শাহের বানু, আয়েশা, জয়ত্তন, শফুরা, নূরজাহান। নামের পরে টিপসই।

সাকিন, সোনাদিয়া গ্রাম। ৩. সোনাদিয়ার ওপর দিয়ে ১৯৭০ সালে নভেম্বর মাসে এক প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন বয়ে যায়। যারা বেঁচেছিল তাদের মতে এমন সাইকোন তারা জীবনে দেখেনি কিংবা শোনেও নি বাপ-দাদার মুখে। সাইকোনে বাড়িঘর সবই ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গিয়েছিল। কাঁচাবাড়ি, টিনের বাড়ির কোন নিশানা ছিল না।

যে কয়টা পাকা দালান ছিল সেসবও ভেঙ্গে পড়ে মুখ থুবড়ে। লাখ লাখ লোক মারা যায় উপকূল অঞ্চলে। কেউ বলে দশ লাখ, কেউ বলে ত্রিশ লাখ। সাইক্লোনের পর এক ভয়াবহ আর করুণ দৃশ্য দেখা যায় উপকূলের গ্রামের পর গ্রামে। মানুষ পানিতে ভাসছে, গাছে লটকে আছে, ডাঙ্গায় হাত পা মাটি আকড়ে পড়ে আছে।

সব উলঙ্গ। শকুন এসে খুবলে খুবলে খাচ্ছে মানুষের দেহ। চারিদিকে পচা মাংসের গন্ধ। যারা বেঁচেছিল তারা মৃত আত্মীয়-স্বজন খোঁজে নি। তাঁরা এতই বিহ্বল ছিল যে নিজের প্রাণ রক্ষার জন্য উপায় খুঁজছিল।

বলা যায় তাঁরা তখন মানুষ ছিল না। কয়েক দিন পর্যন্ত বাইরের কেউ আসেনি উপকূলের গ্রামে। লাশ সব ফুলে উঠেছিল। যারা বেঁচে ছিল তারা খাবারের পানি আর খাবারের জন্য হন্যে হয়ে পড়েছিল। সাইক্লোনের দুইদিন পর আকাশে হেলিকপ্টার দেখা যায়।

হেলিকপ্টার থেকে রিলিফ ফেলা হয়্যারা বেঁচে ছিল তারা দৌড়ে যেতে যেতে হুমরি খেয়ে পড়েছে শক্তির অভাবে। রিলিফ নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছে। তাদের পাশেই মৃত দেহের মাংস খাচ্ছিল শকুন, কুকুরও এসে জুটেছিল। তাতিয়ে ওঠা রোদে পচা গন্ধ আরো তীব্র হয়েছিল। সোনাদিয়ায় যারা মারা যায় তাদের মধ্যে সব ধরনের মানুষ ছিল।

যারা ঘরে ছিল, যারা বাইরে ছিল আর নৌকায় করে যারা সাগরে গিয়েছিল মাছ ধরতে, তারা। এদের মধ্যে মেয়ে ছিল, পুরুষ ছিল। যারা জীবিত তাদের মধ্যে দেখা যায় বিধবার সংখ্যাই বেশি। এইসব বিধবাদের মধ্যে অনেকের নাম ছিল জরিমন, তাহেরা, শাহের বানু, আয়েশা, জয়ত্তন, শফুরা, নূরজাহান ইত্যাদি। ১৯৭১-এর এক রাতে মুনশী কেফাতুল্লাহ সোনাদিযার যে সব বাড়ি গিয়ে পুরুষদের শনাক্ত করেছিল এবং যাদের মৃত দেহ পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় সমুদ্রের তীরে, তাদের বিধবাদের মধ্যেও জরিমন, তাহেরা, শাহের বানু, আয়েশা, শফুরা, নূরজাহান অন্যান্য নামের মধ্যে এইসব নাম ছিল।

সাইকোনে, বন্যায় কিংবা ১৯৭১-এর মত দুর্যোগের কারণে যারা সোনাদিয়া গ্রামে বিধবা হয় তাদের অনেকের নাম প্রায় একই ছিল। পরে কে যে সাইকোনের জন্য বিধবা হয়েছে আর কে মানুষের তৈরি দুর্যোগের জন্য, তা বোঝার উপায় থাকে না। ১৯৭০-এ বিধবা হওয়ার পর যখন সোনাদিয়ায় আবার আরেক দল মেয়ে ১৯৭১ সালে বিধবা হয় তখন নাম নিয়ে একটা জটিলতা দেখা দিতে পারতো। যদি কেউ তালিকা তৈরি করে দুইটি দুর্যোগে বিধবাদের পৃথক তালিকা তৈরি করতে চাইতো। কিন্তু ১৯৭১-এ বিধবাদের কোন তালিকা তৈরি করা হয়নি।

বিধবারা নিজেরাই স্মরণ করতে পারতো তারা কিসের জন্য বিধবা হয়েছে। যদি তাদের জিজ্ঞাসা করা হতো কিন্তু কর্তৃপ তা করেনি। বিধবারা তাদের জীবনের বিশাল শোকের কথা ভোলে নি। আর সেই জন্য সাইত্রিশ বছর পর তারা বিচারের কথা শুনে এগিয়ে এসেছে। ১৯৭১-এ যারা বিধবা হয়েছে এবং যারা বেঁচে আছে তারা তাদের শোক ভোলেনি।

অন্যায়-অত্যাচারের বিচার হবে শুনে তাঁরা বৃদ্ধ বয়সেও এগিয়ে এসেছে। ৪. মুন্সী কেফাতুল্লা বিচারের দ্বিতীয় দিনে বিচারককে সবিনয়ে বলবে, হুজুর। এরা, এই বিধবারা যে সাইকোনে বিধবা হয় নাই তার প্রমাণ আছে? আমি কইতে চাই, এরা বিধবা হইছে বটে। তবে ১৯৭০ সালে নভেম্বরের সাইকোনে। সরকারি খাতা খুইলা দেহেন রিলিফের খাতায় এদের নাম লেখা আছে।

মুন্সীর কথা শুনে বিচারক কিছুটা দ্বন্দ্বে পড়বেন। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জরিমন, তাহেরা, শফুরা, শাহের বানু, জরিমন, জয়ত্তন, নূরজাহান সোনাদিয়ার এইসব বিধবারা রক্ত-মাংসের শরীর হারিয়ে তখন শুধুই নাম হয়ে যায়। মুন্সী কেফাতুল্লাহর মুখে মৃদু হাসি দেখা যাবে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।