নিজের সম্পর্কে লেখার কিছু নেই । সাদামাটা ।
]
পৃথিবীর বিতর্কিত সব ছবিরা……
[ ছবি যাদের দোলা দেয়, শুধু তাদের জন্যে ….. ]
তৃতীয় পর্ব
দ্য হোলি ভার্জিন মেরী / ক্রিস ওফিলি
The Holy Virgin Mary / Chris Ofili
এটা যে মাতা মেরীর ছবি কে বলবেন ?
তা বোঝার কোনও সাধ্য নেই আপনার ছবিটি দেখে । নির্দোষ , কালো কিম্ভুত একটি নারীমূর্ত্তিই বলে মনে হবে আপনার শুধু । হয়েছিলোও তাই ।
কেবল গন্ডোগোলটা পাকালেন স্বয়ং নিউইয়র্কের মেয়র রুডলফ গুলিয়ানি । ১৯৯৭ সাল থেকে চলতে থাকা “সেনসেশান” নামের চিত্রপ্রদর্শনীটি লন্ডন, বার্লিন ঘুরে ১৯৯৯ সালে যখোন নিউইয়র্কের ব্রুকলিন মিয়্যুজিঅ্যামে এলো, প্রথমদিকে তাতে ছবিটি দর্শকদের নজর টানেনি । টানবে কি করে ! কালো কিম্ভুত একটি নারীমূর্ত্তির তো নজর কাড়ার কোনও আবেদনই নেই ! তাহলে ? নিউইয়র্কের ট্যাক্সপেয়ারদের টাকা থেকে বার্ষিক সাত মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়া হয় যে মিয়্যুজিঅ্যামকে সেই ট্যাক্সপেয়ারদের মেয়র তো সেখানে চলা প্রদর্শনীতে যেতেই পারেন । সেখান থেকেই শুরু । কি নাম ছবিটির ?
দ্য হোলি ভার্জিন মেরী ।
ছবির ভেতরে হাতির বিষ্ঠার (এলিফ্যান্ট ডাং ) দু’টি স্তুপের উপর রঙিন পিন দিয়ে, একটিতে “মেরী” অন্যটিতে “ভার্জিন” শব্দ দুটি লেখা । শুধু কি তাই ? হাতির এক থাবা শুকনো বিষ্ঠা দিয়ে মেরীর উন্মুক্ত স্তনটি দেখানো হয়েছে । “অসুস্থ্য” (Sick) একটি ছবি, মেয়র ঘোষনা দিলেন । ছবিতে আরো যা আছে তা সরাসরি নোংরামী । হাতীর বিষ্ঠা, পর্ণোগ্রাফিক ছবির কোলাজ সব মিলিয়ে “বিতর্কিত” – “অশ্লীল” ।
ব্লাসফেমাস ।
গুলিয়ানি ব্রুকলিন মিয়্যুজিঅ্যামের বিরূদ্ধে কেস ঠুকে দিলেন আদালতে । ঘোষনা দিলেন, বার্ষিক সাত মিলিয়ন ডলারের অনুদান বন্ধ করা হবে । মিয়্যুজিঅ্যামটিকে উচ্ছেদের ঘোষনাও দিলেন তিনি । মিয়্যুজিঅ্যামটির ডিরেক্টর ও বসে থাকলেন না ।
মেয়রের বিরুদ্ধে পাল্টা আর একটি কেস ঠুকে দিলেন “ ফেডারেল ল স্যুট” । ততক্ষনে মৌচাকে ঢিল ছোড়া হয়ে গেছে । দর্শনার্থীরা আগে না বুঝলেও এবারে বুঝলেন যে ছবিটির নারী মূর্ত্তিটি আর কেউ নয়, ভার্জিন মেরী । ছবিটির উপরে সাদা রঙ ছুঁড়ে মারা হয়েছে । সাদা চামড়ার মানুষেরা ছবিটি শুঁকতে গিয়ে পেলেন মাতা মেরীকে অশ্রদ্ধার গন্ধ ।
খুঁজে পেলেন বর্ণবাদ । কেন ? ছবিটি যে কালো চামড়ার একজনের আঁকা , কৃষ্ণ আফ্রিকার মাটির গন্ধ গায়ে মাখা শিল্পী ক্রিস ওফিলির । সমালোচনার ঝড় উঠলো বিভিন্ন আঙ্গিকে ।
ছবি - মাটির গন্ধ গায়ে মাখা শিল্পী ক্রিস ওফিলি
সমালোচকদের নোটবইতে (CRITIC'S NOTEBOOK) লেখা হলো – “ছবিটা তো প্রথমদিকে দর্শনার্থীদের কোনও হিসেবের মধ্যেই ছিলো না । অথচ প্রদর্শনীতে এতো এতো অসাধারন ছবির ভীড়ে , অখ্যাত এক শিল্পীর ততোধিক অখ্যাত আর মামুলী একটি ছবি; যার আদপেই কোন আকর্ষনীয়তা নেই তা এতো হৈ-চৈ ফেলে দিলো কেন ? কারনটি নিউইয়র্কের মেয়র রুডলফ গুলিয়ানি স্বয়ং ।
গুলিয়ানি যদি এটার দিকে না তাকাতেন তবে ছবিটির কথা ব্রুকলিন মিয়্যুজিয়মের প্রদর্শনীকক্ষের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে যেতে পারতোনা । ”
অন্তর্জালে সমালোচকদের বিভিন্ন সমালোচনার উপর মন্তব্যকারী একজন মন্তব্য করেছেন এভাবে - “ আমি যখোন ছবিটি দেখি, আমি তখোন ছবিটিতে তেমন কিছুই দেখিনি । আর এখোন সমালোচকদের লেখা দেখে মনে হচ্ছে, আরে তাইতো....” ।
তার মানে , দর্শকদের দেখা আর অনুভব করার মধ্যে বিস্তর ফারাক ।
তাই “ফেইথ এ্যান্ড কালচার” এর লেখক জোনাথন মেরিট খেদোক্তি করেছেন এভাবে – “ আসলে ক্রিশ্চিয়ানরা শিল্প সম্পর্কে কোনও কিছু না জেনে, না বুঝেই অন্যের কথা শুনে খুব অল্পতেই কোনও শিল্পকে অপরাধমূলক বলে রায় দিয়ে ফেলেন আহাম্মকের মতো....” ।
জোনাথন মেরিট কি আমাদের কথাও বলে গেছেন এই সাথে ? আমরাও তো কোনও বিষয়ে কিছু না বুঝেই, না জেনেই অন্যের কথা শুনে হুট করে ঝাপিয়ে পড়ি নিন্দা জানাতে । হবে হয়তো !
তবে ব্রুকলিন মিয়্যুজিঅ্যামের এই ঘটনা থেকে একটা ভালো উপলব্ধি বেড়িয়ে এসেছে এই যে, ছবিটি মানুষ কে বাধ্য করেছে ভাবতে যে, কিভাবে একটি ছবি “ কম্যুউনিকেট” করে সমাজে ।
১৯৯৬ সালে ছবিটি আঁকেন ওফিলি । ৮ ফুট বাই ৬ ফুট সাইজে এটা একটা কোলাজ ধর্মী ছবি । হলদে কমলা ব্যাকগ্রাউন্ডের উপরে একজন নীলবসনা কৃষ্ণকায় নারী ।
অনেক কিছু মিশিয়ে কোলাজের কাজটি করেছেন শিল্পী । শৈল্পিক ব্যাকরণে যাকে বলে “ মিক্সড মিডিয়া” ব্যবহার করেছেন ওফিলি । এ্যাক্রিলিক আর তেল রঙ, পলিয়েষ্টার রেজিন, গ্লিটার, হাতির বিষ্ঠা আর পর্ণোগ্রাফিক ছবির পেপার কাট পিস দিয়ে গড়ে উঠেছে কোলাজটি । ছাপ পড়েছে বাইজেন্টাইন আর্টের, গুস্তাভ ক্লীমট এর ষ্টাইল (একই ধাঁচে আঁকা ক্লীমট এর ছবি “দ্য কিস” সম্পর্কে জানতে এখানে.... Click This Link)
আর ফোক আর্টের । মেরীর চারপাশে কোলাজকৃত ছোট ছোট ছবিগুলোকে আপনার সাদা দৃষ্টিতে মনে হবে যেন উড়ছে – প্রজাপতি ।
খুব কাছে এসে ভালো করে দেখলে দেখবেন, প্রজাপতি নয় ; এগুলো সব পর্ণোগ্রাফিক ছবি থেকে নেয়া স্ত্রী-যৌনাঙ্গ । প্রচলিত ধর্মীয় ছবিগুলোতে যেমন দেখানো হয় ডানাওয়ালা শিশু এ্যাঞ্জেলগণ দল বেঁধে যিশু বা মেরীর চারপাশে নৃত্যরত, সম্ভবত পরিহাসোচ্ছলে শিল্পী এখানে সেটাই বুঝিয়েছেন । এক থাবা হাতির বিষ্ঠা শুকিয়ে বার্নিশ করে কৃষ্ণকায় নারীর উন্মুক্ত স্তন বানানো হয়েছে । নারিটিকে মনে হয় যেন সন্তান সম্ভবা । তাকে আবৃত করে রাখা বসনের অলঙ্করন করা হয়েছে পাতার মতো আকৃতির স্ত্রী যৌনাঙ্গ দিয়ে ।
আরো মজার ব্যাপার হলো , একটি ছবি যেন দেয়ালে হেলান দেয়া অবস্থায় রাখা হয়েছে এমোনভাবেই তৈরী হয়েছে কোলাজকৃত মূল ছবিটি । আর সেটা হেলানো অবস্থায় দেখাতে ষ্ট্যান্ড হিসেবে দুইপাশে ব্যবহার করা হয়েছে স্তুপাকৃত হাতির বিষ্ঠা । বাম দিকে এরকম স্তুপাকৃত হাতির বিষ্ঠার উপরে রঙিন পিন দিয়ে লেখা রয়েছে “ ভার্জিন” আর ডান দিকেরটিতে “মেরী” ।
এলিফ্যান্ট ডাং ব্যবহার করেছেন শিল্পী তার “ নো উওম্যান নো ক্রাই” ছবি সহ অনেক ছবিতেই । কেন করেছেন ?
“দ্য নিউইয়র্ক অবজারভার” পত্রিকার কলামিষ্ট এ্যানি রফি ছবিটির সামগ্রিক উপস্থাপনা এবং তাতে এলিফ্যান্ট ডাং ব্যবহারে শিল্পীর জীবনাচারের দিকটিকে ছবির সাথে একসূত্রে গাঁথতে চেয়েছেন ।
লিখেছেন – “শিল্পী তার পূর্বপরুষের পদধূলিতে মাখা কৃষ্ণ আফ্রিকার লাগোস, নাইজেরিয়া, জিম্বাবুয়ের নৈসর্গিক পটভূমিতে মানুষ আর প্রানীদের জীবন বৈচিত্রে মজেছেন । মাটিকে তিনি দেখেছেন মায়ের মতো সুন্দর । । কাছ থেকে দেখেছেন আফ্রিকাবাসীদের জীবনাচার । সামাজিক আচারে তিনি দেখে থাকবেন অদ্ভুত সব জিনিষের কাছে তাদের আত্মসমর্পণ, দেবদেবীদের কাছে পূঁজোর অর্ঘ নিবেদন ।
দেখে থাকবেন মুখোশের বাহারী কাজ । এগুলিই ছাপ রেখে গেছে তার শিল্পী মনে । তাই হয়তো তিনি তার অন্তরে আজন্ম লালিত আফ্রিকার ছবিকে তুলে এনেছেন ছবিতে আফ্রিকার মতো করেই । আফ্রিকান মায়েদের মতোই চিত্রিত করেছেন মেরীকে । আফ্রিকার মাটিতে যেমন দেখা যায় সচারচর , অর্ন্তবাসহীন উদোম স্তন, গর্ভবতী শরীরে জড়িয়ে থাকা রং-চংয়ে নীল দেহবসন ; তেমন করে ।
তারপরে তিনি এলিফ্যান্ট ডাং দিয়ে স্তন এঁকেছেন আফ্রিকান উর্বরতার প্রতীক হিসেবে । শিল্পী অবশ্যই মেরীকে অসম্মানিত করতে চাননি । যদি কেউ ছবিটিকে এভাবেই দেখেন তবে তিনি দেখতে পাবেন শিল্পী আসলে এলিফ্যান্ট ডাং দিয়ে প্রকৃতিকেই বোঝাতে চেয়েছেন । জীবনের স্পন্দনকে দেখিয়েছেন, যে জীবন আফ্রিকার মাটিতে চলমান । আর যদি কেউ এলিফ্যান্ট ডাংকে পৃথিবীর মাটির রঙ না বুঝে শুধুমাত্র “ডাং” ই বোঝেন, হাতীকে শুধু একটি প্রানীই বোঝেন তবে তা আমাদের পশ্চিমা চোখের দোষ .....” ।
ওফিলি নিজেও বলেছেন - ছবিটিকে ভুল বোঝার সমস্যাটি তৈরী হয়েছে , শিল্পীর নিজস্ব ব্যাখ্যা না বুঝে আগেভাগেই দর্শকরা তাদের নিজেদের ব্যাখ্যা চাপিয়ে দেয়াতে ।
একজন চিত্র-সমালোচক তো সর্বসমক্ষে ওফিলির কাছে ক্ষমা চেয়ে স্বীকার করেছেন , তিনি “দ্য হোলি ভার্জিন মেরী” ছবিটির ভুল ব্যাখ্যা করেছেন । ছবিটি আসলে অশোভন বা অর্থহীন তো নয়ই বরং এই নীতিহীন , নিস্তেজ বিশ্বে আধ্যাত্মিকতার অর্থ খোঁজার একটি চেষ্টা ।
দর্শকদের আক্রোশের হাত থেকে বাঁচাতে ১৯৯৫-২০০০ সালের টার্ণার পুরষ্কারে ভূষিত ছবিটি এখোন ব্রুকলিন মিয়্যুজিঅ্যামে অভঙ্গুর প্লেক্সিগ্লাসের আবরন দিয়ে সুরক্ষিত করা হয়েছে । ছবিটি আপনি যদি দেখতে চান তবে আপনাকে একটি বিশেষ মেটাল ডিটেক্টর এর ভেতর দিয়ে যেতে হবে ।
আর তাই শিল্পী নিজেই বলেছেন , “ বাহ....যে ভাবেই হোক ছবিটি দেয়ালে ক্রুসিফায়েড না হয়ে মনে হয় এভাবেই বেশ রিল্যাক্সড অবস্থায় আছে । আর নিজের জায়গায় বসে দেখছে, বাকী সব ছবিরা কিভাবে দেয়ালে ক্রুসিফায়েড হয়ে লটকে রয়েছে । ”
ছবিটি টানছে সকল শ্রেনীর দর্শক, এমোন কি ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতাদেরও যারা এর বিরূদ্ধে বিষোদ্গার করছেন এই বলে – ব্লাসফেমাস, স্যাক্রিলিজিয়াস এ্যান্ড ভালগার ।
আপনিও যদি তেমনটা বলতে চান , বলতে পারেন কারন - দ্য হোলি ভার্জিন মেরী ইজ বোথ আর্টিস্টিক্যালি কারেক্ট , এ্যান্ড পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট ..........
লা ম্যাহা দেসনুদা / ফ্রান্সিসকো গ্যঁয়া
La Maja Desnuda - Francisco Goya
ফ্রান্সিসকো গ্যঁয়া র নাম শোনেন নি এমোন কেউ কি আছেন যারা ছবি ভালোবাসেন ?
মডার্ণ আর্টের জনক বলা হয় যাকে ? “প্রথা” বা “ট্রাডিশান” এর চেয়েও যিনি বিশ্বাস করতেন, শিল্পীর দৃষ্টিভঙিই হলো সবচেয়ে আসল ?
হ্যা , ফ্রান্সিসকো গ্যঁয়া; স্প্যানিস চিত্রশিল্পের জমির বেড়া ডিঙিয়ে যার সুখ্যাতি ছড়িয়ে গেছে বিশ্বময় । শিল্পীজীবনের বেশীর ভাগটাই যার কেটেছে স্পেনের রাজা চতুর্থ চার্লসের দুর্নীতিগ্রস্থ সভার পেইন্টার হিসেবে ।
তীক্ষ্ন চোখে দেখেছেন ক্ষয়ে যাওয়া রাজতন্ত্রের শেষ মদমত্ততাকে, দেখেছেন স্পেন জনগণের উপর বিজয়ী নেপোলিয়নের নৃশংসতাকেও । এ থেকে মানবতাকে তার কাছে মনে হয়েছে, শুধুই নিষ্ঠুর । তাই পূর্বসুরী ভুবনখ্যাত চিত্রশিল্পী জিওভান্নি বাতিস্তার লঘূহৃদয় ভিত্তিক শিল্পাচারকে প্রত্যাখান করেছেন তিনি । যে নির্মমতা, যে নৃশংসতার ভেতর দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে তা থেকে জন্ম নিয়েছে আর এক শিল্পী যার তুলিতে ক্যানভাসে সর্বপ্রথম ফুঁটে উঠেছে “হিউম্যান ম্যাডনেস” এর বিভৎস চিত্ররূপ । একের পরে এক এঁকেছেন ‘The Yard of a Madhouse’ (1794), ‘The Madhouse 1812-14’, “Saturn Devouring His Son,” 1819 ।
‘The Yard of a Madhouse’ (1794),
“Saturn Devouring His Son,” 1819
নিজে চিত্রিত হয়েছেন “ভায়োলেন্স” এর শিল্পী হিসেবে । তার এচিং “ দ্য ডিজাষ্টারস অব ওয়র” সিরিজে তিনি দেখিয়েছেন নেপোলিয়নের নির্মমতা, পদদলিত মানবতা । নান্দনিকতা থেকে সরে এসে এক প্রতিবাদী শিল্পীর দ্বিতীয় জন্ম যেন ।
What more can one do?, from The Disasters of War, 1812–15
অথচ এই শিল্পীর তুলিতেই একসময় ধরা পড়েছে ওয়েষ্টার্ন আর্টে রূপক কিম্বা পৌরানিক অর্থের ভান না করা, প্রথম নিষিদ্ধ নগ্ন নারীর প্রমান সাইজের দেহখানি – “লা ম্যাহা দেসনুদা ” । তার এই ছবিখানি দিয়েই ১৯ শতকের “ রিয়েলিজম” শিল্পের এর যাত্রা শুরু ।
৩৮ বাই ৭৫ ইঞ্চির ক্যানভাসে তেল রংয়ের ছবি । ১৭৯৮ সালে আঁকা । ছবিটি দু’টি বিশালাকৃতির বালিশের উপরে অর্ধশায়িতা একজন নগ্ননারীর । পাশ্চাত্যের ছবিতে এই প্রথম এক শিল্পী দুঃসাহস দেখালেন, ছবিতে নারী যৌনকেশকে দৃশ্যমান করে । আর এটা করতে গিয়েই চুড়ান্ত অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করে শিল্পীকে তলব করা হয়েছিলো রাজকীয় কর্তৃপক্ষের সামনে ।
কেন বা কার নির্দেশে আঁকা হয়েছে এই অশ্লীল ছবিটি, ছবির নগ্নিকাই বা কে এমোন প্রশ্নের উত্তর চাওয়া হয়েছে তার কাছে । সন্তোষজনক কোনও জবাব মেলেনি সেদিন । কি উত্তর তিনি দিয়েছিলেন সেদিন আজ পর্য্যন্ত তার উল্লেখ নেই কোথাও । মাথা নত করে নিজের দোষ স্বীকার করতে হয়েছে তাকে । একই ভঙ্গীমায় একই নারীকে আবার শোভন পোষাকে ঢেকে, এঁকে দিতে হয়েছে আর একটি ছবি – “লা ম্যাহা ভেসতিদা” ।
প্রথমটি “নেকেড ম্যাহা” দ্বিতীয়টি “ক্লোথড ম্যাহা” ।
সমাজের অনুশাসন আর ভ্রুকুটির কাছে এটা শুধুই কি এক শিল্পীর পরাজয় ? নাকি শিল্পের স্বাধীনতায় রাহুবন্ধন ?
ছবি না হয় বোঝা গেল, একজন বিবসনা । কিন্তু কে সে ? জল্পনার শেষ নেই । বিশ্লেষণকারীরা বা বিশেষজ্ঞরা একমত হতে পারছেন না কেউ । কেউ বলছেন , গ্যঁয়ার জীবনে যে সব নারীরা এসেছেন তাদের সম্মীলিত রূপটিকেই তুলে এনেছেন তিনি ।
যাই ঘটুক, ছবিটি যে অশ্লীলতার চুড়ান্ত তাতে দ্বিমত নেই কারো । ছবিটি রূপক তো নয়ই, এমোনকি পৌরানিক কোন চরিত্রও নয় যে এ নগ্নতাকে মেনে নেয়া যায় । তাই এই নগ্নিকার পরিচয় পেতে উসখুশ করা লোকের অন্ত নেই । খুঁজে-পেতে যাদের নামকে টেনে আনা হলো, তারা রাজকীয় অন্তঃপুরের সব রমনী । প্রথমেই উঠে এলো “ডাচেস অব এ্যালবা”র নাম ।
মারিয়া দেল পিলার থেরেসা । যার ছবি গ্যঁয়ার ক্যানভাস আলোকিত করেছে দু’দুবার । কানাঘুসা, ডাচেস অব এ্যালবার সাথে প্রনয়ের সম্পর্ক ছিলো তার । দ্বিতীয় যার নাম এসেছে তা আরো ভয়াবহ । যে রাজসভায় কাজ করেন শিল্পী সেই রাজ্য স্পেনের প্রধানমন্ত্রী - ডিউক অব এ্যালকুদিয়া, ম্যানুয়েল দ্য গোডয় এর তরুনী রক্ষিতা পেপিতা ট্যুডো ।
১৮০৮ সালে ক্ষমতা থেকে ম্যানুয়েল দ্য গোডয় এর পতনের পরে রাজা সপ্তম ফার্দিন্যান্ড তার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলে “নেকেড ম্যাহা” আর “ক্লোথড ম্যাহা” ছবি দু’টিও বাজেয়াপ্ত হয় । ১৮১৩ সালে ধর্মীয় বিচারসভা ছবি দু’টিকে “ অবসীন” আখ্যা দিয়ে আবার বাজেয়াপ্ত করেন । স্পেনের ক্যাথলিক চার্চ শিল্প-অশিল্প সব ধরনের নগ্ন ছবি আঁকার উপরে জোরালো নিষেধাজ্ঞার ফতোয়া জারী করলে গ্যঁয়ার জীবদ্দশায় ছবিটি আর কারো চোখের সামনে আনা হয়নি । এর দু’যুগ পরে ছবি দু’টি চলে আসে সান-ফার্নান্দোর আকাদমী অব ফাইন আর্টসে ।
সবখানে, সব কালেই ধর্মীয় গোড়ামীর হাত যে অনেক লম্বা , তারই প্রমান ?
১৯৩০ সালে গ্যঁয়ার কাজের সম্মানার্থে “লা ম্যাহা দেসনুদা” ছবিটি দিয়ে দু’প্রস্থ ষ্ট্যাম্প তৈরী করা হলে স্পেনের ডাকবিভাগ তাকে অনুমোদন দেন ।
একই বছর যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই ষ্ট্যাম্প সম্বলিত যে কোনও চিঠিকে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারী করেন এমোনকি সেখানে আসা চিঠিগত্রগুলিকেও ফেরত পাঠান স্পেনে । ইতিহাসে এটাই প্রথম
ষ্ট্যাম্প যেখানে একটি বিবসনা নারীর ছবি রয়েছে ।
প্রথম এ ছবিটি সম্পর্কে জানা যায় পেদ্রো গণজালেস দ্য সেপুলভেদা নামের একজনের ডায়েরীতে যিনি ১৮০০ সালের নভেম্বরে ম্যানুয়েল দ্য গোডয় এর প্রাসাদ দেখতে গিয়েছিলেন । সেখানের অন্দর মহলের একটি কেবিনেট থেকে নগ্ন ভেনাসের অনেকগুলো ছবির মাঝে মিলেছে এই ছবিটিও । যদিও তার ডায়েরীতে “ক্লোথড ম্যাহা”র কোন উল্লেখ নেই ।
এর অর্থ, সম্ভবত সেটি ওখানে ছিলোনা বা এই ছবিটি পরে আঁকা হয়েছে । ম্যানুয়েল দ্য গোডয় এর পদমর্য্যাদা আর বিবসনা নারীর ছবির প্রতি তার তীব্র আগ্রহের কারনে মনে করা হয় “লা ম্যাহা দেসনুদা ” তার জন্যেই এঁকেছিলেন শিল্পী । আবার কেউ বলেন , ম্যানুয়েল দ্য গোডয় নয় , ছবি দু’টি প্রথমে ডাচেস অব এ্যালবা’র সংগ্রহে ছিলো । ডাচেস এর মৃত্যুর পরে তা গোডয় এর হাতে আসে । এ সন্দেহের কারন, গ্যঁয়ার সাথে ডাচেস অব এ্যালবা’র ঘনিষ্টতা , ডাচেস এর কান্ট্রি এষ্টেট এ তার অবাধ যাতায়াত আর সেখান থেকে তার অনেকগুলি প্রতিকৃতি উদ্ধার হওয়া ।
ছবির মুখের সাথে তবে ডাচেস এর হবহু মিলটি নেই কেন ? সম্ভবত ডাচেসকে নিরাপদ রাখতে চেয়েছিলেন শিল্পী ।
ডাচেস অব এ্যালবা লোকচক্ষুর আড়ালে ঢাকা পড়লেও ছবিতে মাথার পেছনে হাত রেখে , শরীরটাকে খানিকটা বাঁকিয়ে, মুখে স্মিত হাসি নিয়ে যে নারীটি আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন পুরো ছবিটি জুড়ে, তার শৈল্পিক সৌন্দর্য্য আপনি আড়াল করবেন কি করে ?
না পেড়েছেন গ্যঁয়া , না পেড়েছেন এ পর্য্যন্ত পৃথিবী জুড়ে তার অগনিত দর্শক ।
দু’টো ছবি পাশাপাশি। মাদ্রিদের ম্যুজিয় দেল প্রাদো’র দেয়াল জুড়ে । বসনাবৃত আর বিবসনা ।
দ্য ডেথ অব মারাত / জ্যাকুইস-লুইস ডেভিড ।
The Death of Marat / Jacques-Louis David.
আপতদৃষ্টিতে ছবিটিতে দৃশ্যমান কোনও নগ্নতা নেই , অশ্লীল কিছুর ছোঁয়া নেই , কিম্ভুতকিমাকার ও নয়, বিভৎসও নয় ছবিটি । আপনি কোনও বিচ্যুতি খুঁজে পাবেন না এখানে । তারপরেও ছবিটি বিতর্কিত । কেন ? আঁকা একটি ছবির দৃশ্যটিই আসল নয় ।
ছবির ইতিহাস জানতে হয় । শিল্পীর মেজাজ বুঝতে হয় । এসব জেনে যদি একটি ছবির দিকে আপনি তাকান তবে বুঝতে হবে আপনি ছবি ভালোবাসেন ।
বেলজিয়মের রয়্যাল মিয়্যুজিয়ম অব ফাইন আর্টসের দেয়ালে ঝোলানো ৬৪ বাই ৫০ ইঞ্চির ক্যানভাসে তেল রংয়ের এই ছবিটি এককালে ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলিউশানের সময় তোলপাড় তুলেছিলো রহস্যময়তা নিয়ে , ঠিক যেন গোয়েন্দা গল্পের মতো । বিতর্কিত , এই ছাপ লেগেছিলো তার গায়ে ।
১৭৯৩ সালের তেরই জুলাইয়ের একটি হত্যাকান্ডের তথাকথিত সুরতহাল যেন ছবিটি । এক সাংবাদিকের মৃত্যু রহস্য নিয়ে যেন আরেক শিল্পীর সংবাদচিত্র । ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলিউশানের র্যাডিকেল গ্রুপের প্রথম সারির নেতা জিন-পল মারাত এর নিথর দেহ শুয়ে আছে তারই ঘরের বাথটাবের ভেতর । বেঁচে থাকতে যে লোক গিলোটিনে শতশত মানুষের ধড় থেকে মাথা আলাদা করেছেন তার এমোন করে নিহত হয়ে পড়ে থাকা অনেক রাজনৈতিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে আর রাজনৈতিক আদর্শের স্বচ্ছতার দিকে আঙুল তুলেছে বলেই এই তোলপাড় ।
একটি ঐতিহাসিক ছবি এটি ।
ইতিহাসের সত্য মিথ্যা দিয়ে নিজের মতবাদটিকে তুলিতে তুলে এনেছেন একাধারে শিল্পী ও ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলিউশানে অংশগ্রহনকারী জ্যাকুইস-লুইস ডেভিড । একাধারে গ্রীক ও রোমান ঐতিহাসিক আর মিথোলজিক্যাল ছবি ধারাবাহিক ভাবে এঁকে এঁকে যিনি চেনামুখ হয়ে উঠেছিলেন তার সময়ে । সেখান থেকেই কি তার রাজনৈতিক চেতনার জন্ম ? তাই কি তিনি হয়ে উঠেছিলেন ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলিউশানের বিপ্লবী এক শিল্পী ? নইলে তার পরবর্তী সব ঐতিহাসিক ছবিতে তার মতাদর্শের ছাপ পড়বে কেন ?
এই ছবিটিতেও তাই । সত্য একটি হত্যাকান্ডের ছবিটি এঁকেছেন নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদে । আর তাই ছবিটি হয়েছে বিতর্কিত ।
১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্য্যন্ত চলা ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলিউশানের বহুদল বহুমতবাদের সাথে যাদের পরিচয় আছে তারা হয়তো জানেন কি ভয়ঙ্কর ছিলো সেদিন গুলিতে তাদের আত্মকলহ । মৃত্যুর থাবা চারদিকে । বিরুদ্ধবাদীদের তেমনিই এক প্রতিহিংসার শিকার
ছবির চরিত্র ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলিউশানের নেতা ও সাংবাদিক জিন-পল মারাত । ছবির শিল্পী ডেভিডের বন্ধু । শিল্পীর মতো মারাত ও ছিলেন একজন মন্টাগনার্ড কর্মী আর রেভ্যুলিউশনারী কমিটি অব জেনারেল সিকিউরিটির সক্রিয় সদস্য ।
থার্মিডোরিয়ান প্রতিবিপ্লবের আগ পর্য্যন্ত যে নৃশংসতা আর গিলোটিনে হত্যার হোলিখেলা চলছিলো তারই একজন রূপকার । ১৭৯৩ সালের তেরই জুলাই রেভ্যুলিউশনারী কমিটি অব জেনারেল সিকিউরিটির রাজনৈতিক শত্রু “জিরোনডিন” গ্রুপের মহিলা সদস্য “চার্লোটি কর্ডে”র হাতে ছুরিকাঘাতে নিহত হন মারাত । বিপ্লবের মাঝে “সেপ্টেম্বর ম্যাসাকার” এর মতো নৃশংস হত্যাকান্ডের জন্যে দায়ী মারাতের উপর প্রতিশোধ নিতেই চার্লোটি কর্ড খুন করেন তাকে ।
তার হত্যাকান্ডের পরেপরেই দৃশ্যটি আঁকার ভার পরে শিল্পীর উপর । নিজের মৃত বন্ধুর শেষ ছবিটি আঁকতে হবে তাকে ।
কি এঁকেছেন তিনি ? কেনই বা ছবিটি বিতর্কিত ?
এটা জানার আগে আপনাদের জেনে রাখা ভালো, হত্যাকান্ডের দৃশ্যপট । হন্তারক চার্লোটি
কি করে এলেন মারাতের ঘরে ? স্বয়ং মারাতই ডেকেছিলেন তার মৃত্যুকে । “সায়েন শহরের প্রতিবিপ্লবী চক্রটির যাবতীয় তথ্য নিয়ে আপনার কাছে একজনকে পাঠানো হলো....”, এমোন একটি চিঠি পেয়ে মারাত নিজ ঘরে ঢুকতে দিয়েছেলেন তার ঘাতক চার্লোটি কর্ডকে । শরীরে জটিল একটি চর্মরোগের যন্ত্রনার কারনে মারাতকে বেশীর ভাগ সময়টাতে থাকতে হচ্ছিলো তার বেডরুমের বাথটাবে । বাথটাবে বসেই সারতেন তার বিপ্লবী কাজ ।
অন্তপুরে প্রবেশের অনুমতি পেয়ে সেখানেই, সেই অবস্থায় চার্লোটি কর্ড তার বুকে ছুরি বিদ্ধ করেন । পালিয়ে যাননি চার্লোটি । ধরা দেন কর্তৃপক্ষের কাছে । পরে বিচারে তাকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হয় ।
ছবিটির বিষয়বস্তু - মারা যাচ্ছেন মারাত ।
চোখের পাতা তার বুঁজে এসেছে, কাঁধের উপর তার মাথাটি ভারী হয়ে চেপে আছে, ডান হাত যেন পিছলে পড়তে চাইছে মাটিতে । মৃত্যুকালে তার যা বয়স তার চেয়ে ঢের তরুন দেখাচ্ছে তাকে । গায়ে তার চর্মরোগের কোনও লক্ষন নেই । বাম হাতে ধরা সেই চিঠি । চিঠিতে চার্লোটি কর্ডের নাম আর ১৩ই জুলাই তারিখটি লেখা ।
সামনে রয়েছে কালি-কলম-কাগজ । ছুরিটি পড়ে আছে মাটিতে । বুক থেকে বেরুচ্ছে রক্ত ।
এর মধ্যে বিতর্কের কি আছে ? যারা ইতিহাস আর তখনকার ঘটনা প্রবাহ জানেন তাদের কাছে আছে , অনেক আছে । মারাতের বিরূদ্ধবাদীরা তো আছেনই ।
তার রাজনৈতিক দলটি ঘটনার পরের দিন মারাতের মৃতদেহের সৎকারের ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন তারই বন্ধু ছবিটির শিল্পী ডেভিডকে । সাথে এই দায়িত্বটুকুও দিয়েছিলেন যেন ডেভিড মারাতের মৃত্যুদৃশ্যটি আকেঁন ইতিহাসের স্বাক্ষ্য হিসেবে । ডেভিড তা করেছিলেন । কিন্তু হত্যাকান্ডের সময়কালের চিত্রটি তুলে ধরেননি ঠিক মতো । মৃত্যুর ঠিক আগের দিন শিল্পী স্বয়ং তার রাজনৈতিক দলের কয়েকজন সদস্যের সাথে মারাতকে দেখতে গিয়েছিলেন ।
ঘরের আসবাবপত্র তিনি সেদিন যেমনটা দেখেছিলেন তেমনটাই স্পষ্ট দেখিয়েছেন ছবিতে । বাথটাব, একখানি চাদর , সবুজ কম্বলখানি, কাঠের প্যাকিং বক্স আর সবার উপরে কাগজ আর একখানি কলম । ইতিহাস বলে মারাতের বুকে ছুরি মেরে চার্লোটি পালিয়ে যাননি । ছিলেন সেখানেই যতোক্ষন পর্য্যন্ত না যথাযথ কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেফতার করেন । ছবিটি যারা কাছ থেকে দেখেছেন, তারা দেখেছেন মারাতের চোখ বুঁজে আসছে অর্থাৎ মরনের সন্ধিক্ষনে তিনি ।
তাহলে চার্লোটি এই ছবিতে নেই কেন ? তার তো থাকার কথা সে সময় ! চিঠিতে তো তার নাম আর তারিখটি দেয়া আছে ! ছুরিটিই বা যেভাবে বুকে গাঁথা ছিলো সেটাকে সেখানে না দেখিয়ে নীচে পড়ে আছে দেখালেন কেন শিল্পী ? মধ্যবয়স্ক বিপ্লবী মারাতকে তিনি কেন আঁকলেন অপেক্ষাকৃত নবীন করে ? তার শরীরের চর্মরোগের লক্ষন নেই, কি উদ্দেশ্যে ? মারাতকে হত্যা করা হয়েছে তারই বাথরুমে । অথচ দৃশ্যপট কোনও বাথরুমের নয় । শুধু বাথটাবটিই দেখানো হয়েছে, কেন ?
ছবিতে খুব নিঃস্তরঙ্গ আবহ তৈরী আর হাতে ধরে রাখা চিঠি আর ছুরিটি যেন মারাতকে করে তুলেছে নিস্পাপ আর মহান কিছু , ঘাতককে তুলেছে বিশ্বাসঘাতিনী করে ।
তবে কি শিল্পী তার বিপ্লবী বন্ধুর রাজনৈতিক হত্যাকান্ডটিকে মহিমান্বিত করতে চেয়েছেন ?
এ যেন “ডিসেন্ট ফ্রম দ্য ক্রস” ছবিটিকে মনে করিয়ে দেয়া ।
ছবি - “Descent from the cross” by Van der Weyden
দ্য ডেথ অব মারাত ছবিটিতেও মারাতের উর্দ্ধদেহখানি যেশাশের মতোই নিরাবরন ।
মাথা আর কাঁধ নেতিয়ে আছে যেন আর এক যেশাশ । শিল্পী মারাতের দেহ আর মুখখানাকে এঁকেছেন মৃদু কিন্তু জোতির্ময় আলোয় উদ্ভাসিত করে যেমনটা যেশাশেরও (উপরের ছবি) । সবুজ কম্বল আর ছড়ানো লাল লাল রক্ত রংয়ের মাঝে মারাতের মৃত দেহটিকে শিল্পী কালো পশ্চাৎভুমিতে ফুঁটিয়ে তুলেছেন যা মারাতকে দিয়েছে পরিষ্কার একটি “বলি”র আর স্বর্গীয় দেবতার ছাপ । মারাতের দেহখানির অংশ বিশেষ আলোকিত করা হয়েছে মৃদু আলোর আভায় । স্বর্গীয় একটি ছাপ মেরে দেয়ার চেষ্টা ?
“শহীদ বিপ্লবী” এই ছাপটি জনগণের মাঝে বদ্ধমূল করে দেয়াই হয়তো শিল্পীর অভিপ্রায় ছিলো ।
শিল্পী নিজে যে বিতর্কিত রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী , তার ভ্রান্ত দিক থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে সে রাজনৈতিক আদর্শকেই মহীয়ান হিসেবে তুলে ধরতেই কি ছবিটি এভাবে আঁকা হয়েছে ? সমালোচকরা বলছেন তেমনটাই ।
আর্ট হিষ্টোরিয়ান টি, জে, ক্লার্ক বলেছেন – এটিই প্রথম মডার্নিষ্ট পেইন্টিং যেখানে রাজনীতিকে এমোনভাবে বিষয়বস্তু করা হয়েছে যে তা আর অন্যকোনও ভাবের প্রকাশ ঘটাচ্ছে না ।
শিল্পী, বিপ্লবের ভয়াবহতার চেয়েও সম্ভবত আরো বেশী কিছু তুলে ধরতে চেয়েছেন । তাই মারাতের নিহত হবার চার মাসের মধ্যেই ছবিটি আঁকা শেষ করে ফেলেন তিনি । শুরু থেকেই তাই খুব হিসেব করে ছবিটিকে একটি মহান দলিল বানানোর চেষ্টা করে গেছেন শিল্পী ।
রাজনৈতিক মতাদর্শের সংঘাতে নিহত মারাতকে দেখাতে চেয়েছেন আর এক নতুন যেশাশ হিসেবে যিনি মানুষের কল্যানে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন । তার দল এমোন ধারনার প্রচারে ছবিটির অনেকগুলি কপিও করিয়ে নেন । যা করে দেয় শিল্পীর ছাত্রেরাই ।
তাই সমালোচকেরা বলছেন – “ যতো সাধারন একটি ছবি এটাকে মনে করা হোক না কেন আসলে ছবিটি “বিস্ময়কর ভাবে সুন্দর একটি মিথ্যে” ।
সংঘাতময় বিপ্লব যতো দ্রুততার সাথে যে পথ ধরে চলে তেমন পথেই যখোন ১৭৯৪ এর ফ্রেঞ্চ বিপ্লব হাটতে শুরু করে, তখোন ফ্রেঞ্চবাসীর শত্রু এ্যারিষ্টোক্রাট মানুষগুলিকে যেমন গিলোটিনে মাথা পেতে দিতে হয় তেমনি দিতে হয় বিরূদ্ধবাদী বিপ্লবীদের ও ।
এরই পথ ধরে শিল্পী জ্যাকুইস-লুইস ডেভিডের দলনেতা রোবসপিয়্যেরী সহ অধিকাংশ বিপ্লবী সদস্যকেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয় । বাকীদের কাটাতে হয় বন্দিদশায় । ডেভিড বেচেঁ যান নিজের কৃতকর্মের ভুল স্বীকার করে । বন্দি হয়ে থাকেন যতোদিন পর্য্যন্ত না নেপোলিয়ন বোনাপার্ট হাজির হন ফ্রান্সের ক্ষমতার মসনদে । মুক্তির পরেই তার অনুরোধে ছবিটি তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয় ।
মৃত্যুর আগ পর্য্যন্ত ছবিটি শিল্পীর কাছেই নিস্তেজ অবস্থায় অন্ধকারে পড়ে থাকে। বেলজিয়মে শিল্পীর নির্বাসনকালে ছবিটি থেকে যায় ফ্রান্সের কোথাও তার প্রিয় ছাত্র এ্যান্টোনী গ্রসের কাছে । ১৮২৬ সালের পর থেকে তার পরিবার ছবিটি বিক্রীর চেষ্টা করেও সুবিধা করতে পারেননি । উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ছবিটি আবার পুনরুদ্ধার করেন বিখ্যাত কবি ও শিল্পী চার্লস ব্যোঁদলেয়ার । ছবিটি সম্পর্কে যার মন্তব্য শিল্পী আর চিত্র-গবেষকদের নতুন করে ভাবিয়ে তোলে ছবিটি সম্পর্কে ।
বিংশ শতাব্দীর পিকাসো আর মাঞ্চ এর মতো চিত্রকররাও তা এড়াতে পারনেনি বলে এঁকেছেন ছবিটির নিজ নিজ ভার্সান । কবিরাও পিছিয়ে ছিলেন না । আলেসান্দ্রো মোজাম্বিনীর মতো কবিও কবিতা লিখেছেন । বিখ্যাত লেখক পিটার ওয়েজ রচনা করেছেন নাটক ।
ব্রাসেলস এর রয়্যাল মিয়্যুজিঅ্যাম অব ফাইন আর্টস এ আপনি দেখতে পাবেন ছবিটিকে ।
আর যে চিঠিটির বদৌলতে এই বিতর্কিত ছবিটির জন্ম, রক্তের ছাপ আর পানির দাগ নিয়ে সেই চিঠিটিও যেমনটি ছিলো তেমনই দেখতে পাবেন আপনি উনত্রিশ আর্ল অব ক্রফোর্ড এর জিম্মায় ।
মারাতের নিহত হবার অনেক পরে অন্যান্য শিল্পীরাও এঁকেছেন ডেভিডের মাস্টারপীস এই ছবিটির থীম নিয়ে । তবে অন্য ভাবে । সেসব ছবিতে মারাতকে দেখানো হয়েছে রক্তের পিপাসায় অতৃপ্ত এক দানব হিসেবে । ফ্রান্সের হিরোইন হিসেবে চার্লোটি কর্ডকে চিত্রিত করা হয়েছে সেখানে ।
তরুন প্রজন্মের কাছে যাকে তুলে ধরা হয়েছে নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে ।
Charlotte Corday by Paul Jacques Aimé Baudry, painted 1860.
রাজনীতির খেলা বোঝা বড় ভার । সুবিধাবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারে দানবকে তুলে ধরা হয় যেমন দেবতা রূপে আবার দেবতাকেও তেমনি দানবরূপী করে ।
আঠারো শতকের ফ্রেঞ্চ বিপ্লবের রাজনৈতিক বাতাস যে ভাবে কোনও ব্যক্তি বিশেষকে উর্দ্ধে তুলে অতিমানব করেছে আবার ব্যক্তি বিশেষকে নামিয়েও এনেছে ধরাতলে, তেমনি আমাদের আকাশেও কি সে বাতাস খেলা করে গেছে ?
প্রথম পর্ব দেখুন
Click This Link
দ্বিতীয় পর্ব দেখুন
Click This Link
সূত্র / সাহায্য : বিভিন্ন ইন্টারনেট সাইট ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।