লড়াই করে জিততে চাই
কলকাতা হাইকোর্ট সম্প্রতি ঈমাম-মোয়াজ্জীনদের বেতন-ভাতা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। নির্দেশে হাইকোর্ট বলেছে, রাজ্য সরকার কর্তৃক ঈমাম-মোয়াজ্জীনদের বেতন-ভাতা দেয়া অসাংবিধানিক। ভারতের সংবিধানের ১৪, ১৫ক এবং ২৮৩ ধারা মতে ধর্মের ভিত্তিতে সরকারি অনুদান নিষিদ্ধ।
বাংলাদেশের ৭২’এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূল নীতির একটি। পরে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গা দখল করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম।
আবার ২০১১ সালে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখেও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হয়েছে সংবিধানে। অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ এটা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন যে, রাষ্ট্রধর্ম রেখে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা যোগ করলে এর কোন অর্থ হয় কি না!
কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান কি কখনও সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে ছিলো? মানুষকে ধর্মের পথে নিয়ে আসতে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে অর্থব্যায়ের বিরুদ্ধে সেখানে কি কোন শব্দ কখনও লেখা হয়েছে?? ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কি ধর্মীয় কাজে উৎসাহ দিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি বুঝায়? একটা রাষ্ট্র যখন মসজিদ-মন্দির তৈরীর টাকা দেয়, পূজা-মাহফিলের যৌলুস বাড়াতে অর্থ সহায়তা করে তখন কি সেই রাষ্ট্রের আর কোন ধর্মনিরপেক্ষতা থাকে? অনেক দেশেই ধর্ম আর রাষ্ট্র সম্পূর্ণ আলাদা দুইটি বিষয়। ধর্ম পালন করা এবং ধর্ম পালন না করা, দুটোই মানুষের অধিকার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা চিন্তার স্বাধীনতা বললেও বিষয়টি একই। ধর্ম একজন ধার্মিকের ইহজগত ও পরজগতের সুখের কথা বলে।
বাংলাদেশ তো আর স্বর্গ বা বেহেস্তে যাবে না? বা কোন ধার্মিক বেহেস্তকে বাংদেশের মতো করে গড়ে তোলার চিন্তাও করেন না! বা বাংলাদেশকে বেহস্তের আদলে গড়ে তোলার কথাও ধার্মীকরা কখনও চিন্তা করেন না। তাহলে রাষ্ট্র কেন ধার্মিকের বেহেস্ত চিন্তার শরীক হবে? বা রাষ্ট্র কেন গরীবের হক কেড়ে নিয়ে জনগণের তহবিল থেকে ধর্মীয় কাজে অর্থ ব্যয় করবে? ধর্ম তো হয় মানুষের! রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কি? রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্র গঠনের যে চারটি মূল উপাদানের কথা বলা হয়েছে সেখানে ধর্মের কোন অস্তিত্ব নাই। জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখন্ড, সরকার আর স্বার্বভৌমত্ব- এই চারটি উপাদান নিশ্চিত হলেই সেটা একটা যথাযথ রাষ্ট্র। সাম্যবাদী রাষ্ট্র বলেন, কল্যাণমুলক রাষ্ট্র বলেন, শান্তিকামী রাষ্ট্র বলেন, সুখ সমৃদ্ধ রাষ্ট্র বলেন! যে ধরণেরই রাষ্ট্ গঠনের চিন্তা করেন না কেন সেখানে ধর্মের কোন প্রয়োজনীয়তা নাই।
ধর্মের বহুবিধ অপব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
তারমধ্যে রাষ্ট্রের ঘাড়ের উপর ধর্মের বোঝা চাঁপিয়ে দেওয়াটা ধর্মের অন্যতম অপব্যবহার। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিরও একটা ধর্ম আছে। ধর্মব্যবসায়ী আর ক্ষমতালোভীরা মিলে-মিশে তাদের ব্যবসা এবং মসনদ রক্ষার্থে রাষ্ট্রের মাথায় টুপি পরিয়ে দিয়েছেন! মোটেও ধার্মিকদের সুবিধার কথা চিন্তা করে তারা একাজ করেন নি। জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় দেশের কোটি কোটি গরীব মানুষের হক মেরে ধর্মকে সম্পূর্ণ নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছেন তারা এবং এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য যারপরনাই চেষ্টাও করে যাচ্ছে সাম্প্রদায়ীক-ধর্মব্যবসায়ী শাসকশ্রেণী।
বাংলাদেশে বরাবরই ধর্মীয় গোষ্ঠীসমূহ রাষ্ট্রীয় নানাবিধ সুবিধা ভোগ করছে।
রাষ্ট্রকর্তৃক ধর্মপালনে উৎসাহিত করা হচ্ছে। যে কাজ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর, রাষ্ট্রের নয়! রাষ্ট্র ধর্মখাতে বিশাল আকারের বাজেট ঘোষণা করছে! ঈমাম-মোয়াজ্জীনরা এখানে সরকারী বেতনভোগী! দেশের উন্নয়নের স্বার্থে যারা উদয়-অস্ত শ্রম দিতে প্রস্তুত সরকার সেইসব বেকারদের কাজ দিতে পারে না। অথচ দেশের উন্নয়নে, জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে যাদের অবদান একেবারেই শূন্য! সম্পদ ধ্বংস ছাড়া যাদের অন্য কোন কাজ নেই! রাষ্ট্র তাদের চাকরী দিয়ে বসে আছে।
চরম সাম্প্রদায়ীক একটা রাষ্ট্রকে এখানে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে জনগণের সামনে হাজির করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগী গোষ্ঠীসমূহ মিলেমিশে যাই করুক না কেন সংবিধানে বারকয়েক ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি লিখেই তাদের সব কাজ শেষ।
হয়ে গেলো ধর্মনিরপেক্ষতা!
বিশ্বে যেগুলো মার্কামারা সাম্প্রদায়িক দেশ তাদের সাথে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হানাহানির তেমন কোন পার্থক্য নেই। সেই সব দেশসমূহেও সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত। বাংলাদেশেও! তারা সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্থাপনায় হামলা করে! বাংলাদেশেও সেটা হরহামেশা ঘটে! সাম্প্রদায়িক দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরাও বরাবর চোদ্দগোষ্ঠীর ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে পালিয়ে যাচ্ছে অন্য দেশে। তারপরেও বাংলাদেশকে হেড়ে গলায় অসাম্প্রদায়ীক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে প্রমাণ করে চলেছে শাসকগোষ্ঠী! ঐ যে সংবিধানে আছে...!
ধর্মানুভূতি এখানে শুধু সংখ্যাগুরু মুসলমানদেরই একচেটিয়া সম্পত্তি! সংখ্যালঘুদের ধর্মানুভূতিতে তাই কখনও আঘাত লাগে না, লাগার সুযোগও নেই! কারণ একটাই- রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও দেশটা ধর্মনিরপেক্ষ!!
সাম্প্রদায়ীক, ধর্মব্যবসায়ী শাসকশ্রেণীর পক্ষে তাই কখনই সম্ভব নয় প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা করা! রাষ্ট্রীয় অর্থে ধর্ম এবং ধার্মিক না পুষে জনগণের কল্যাণে অর্থগুলো কাজে লাগানো, বেহেস্তের কেনা-ব্যাচায় রাষ্ট্র জড়িত না হয়ে বরং বাংলাদেশকে কিভাবে বেহেস্তের আদলে গড়ে তোলা যায় সেই চিন্তা করার জন্য কোন অসাম্প্রদায়ীক-ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক দল বা গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসা প্রয়োজন। তাহলেই কেবল প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা হতে পারে বাংলাদেশে।
নিশ্চয়ই এদেশের শোষিত-নির্যাতিত শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষ একদিন ধর্মনিরপেক্ষতার স্বাদ পাবে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।