বিভিন্ন জটিল রোগের নাম করে ইউনানি, হারবাল, কবিরাজি, তদবির, দাওয়াখানা ইত্যাদি নানা স্টাইলে চিকিৎসার নামে চলছে চরম প্রতারণা। এসব কথিত চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে রোগ নিরাময় দূরের কথা উল্টো রোগীরা নানারকম শারীরিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই এসব প্রতারকের একচ্ছত্র বাণিজ্যিক দাপট। যেখানে-সেখানে খোলা হয়েছে কথিত চিকিৎসা কেন্দ্র। এগুলোর নেই কোনো স্বীকৃতি, নেই কোনো লাইসেন্স।
অথচ এসব কেন্দ্রেই যৌনরোগ, পাইলস, অ্যাজমা, গ্যাস্টিক ও ক্যান্সারসহ জটিল, কঠিন বহুবিধ রোগ নিরাময়ের শতভাগ গ্যারান্টি দেওয়া হচ্ছে অহরহ।
স্বাস্থ্য বিধি লঙ্ঘন করে রীতিমতো প্রকাশ্যেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইউনানি ও হারবাল চিকিৎসালয় নামের প্রতিষ্ঠান। তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা, কেবল অপারেটরদের চ্যানেলে অশালীন ভাষায় বিজ্ঞাপন প্রচার করে রোগীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়ে থাকে। বিজ্ঞাপন ও লিফলেট পড়ে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সচেতন মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন। দেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী ওষুধের যে কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠান কীভাবে প্রচার-প্রচারণার ঢাকঢোল বাজাচ্ছে তা বোধগম্য নয়।
৪২ রোগের অব্যর্থ চ্যালেঞ্জ : মডার্ন হারবাল, রোমান হারবাল, ভারত হারবাল, ইবনেসিনা হারবাল, চৌমোহনী হারবাল, ইউনানি চিকিৎসা, আধ্যাত্দিক দাওয়াখানা ইত্যাদি নানা নামে শত শত প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে। বিভিন্ন জেলা-উপজেলা পর্যায়েও তাদের শাখা, উপশাখা রয়েছে। এমএলএম পদ্ধতি ব্যবহার করে বাড়ি বাড়ি চলছে কথিত ওষুধপত্র বেচাকেনার রমরমা বাণিজ্য। দেশের ওষুধ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যে অনুমোদনহীন ওষুধ না কেনার প্রচারণা চালিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করে। কিন্তু কথিত ওষুধের বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান বা উৎপাদকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো নজির নেই।
এসব ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানে যৌন, চর্ম রোগের পাশাপাশি হাঁপানি, বাতব্যথা, ডায়াবেটিস, লিভার সমস্যা, নারী-পুরুষের বিভিন্ন কঠিন ও গোপন রোগসহ ৪২ প্রকার রোগের অব্যর্থ চিকিৎসার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে। রোগের নয়, রোগীর অবস্থা বুঝে ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা দেন তারা। তবে রোগ নিরাময়ের 'গ্যারান্টি প্যাকেজের' আওতায় চিকিৎসা পেতে ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হয়। এদিকে চিকন দেহ মোটাতাজা করতে 'স্টেরয়েড' নামের যে ওষুধ সেবন করানো হয় তাতে যে কারোর লিভার ও কিডনি বিকল হওয়াসহ ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চর্ম ও যৌন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সুশীল দেব জানান, ২৪ ঘণ্টায় যৌন রোগ সারিয়ে তোলার মতো বিজ্ঞানসম্মত কোনো ওষুধ এখনো পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয়নি।
অথচ অপচিকিৎসায় নিয়োজিত প্রতারকরা যৌন রোগ দ্রুত নিরাময়ের আশ্বাস দিয়েই হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
সরেজমিন একদিন : সম্প্র্রতি এ প্রতিবেদক রাজধানীর শান্তিনগরে একটি ছয় তলা ভবনের তৃতীয় তলায় অবস্থিত কবিরাজি হারবাল সেন্টার নামের একটি প্রতিষ্ঠানে যান। সেখানে স্বঘোষিত হারবাল বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সন্ধান করতেই একজন মহিলা রিসেপশনিস্ট বলেন, 'ডাক্তারের দরকার নেই, কী সমস্যা নিয়ে এসেছেন- আমাকে বলুন। ' যৌন বিষয়ক চিকিৎসা নেওয়ার কথা জানাতেই তিনি নিজেদের ছাপানো হেলথ কার্ডে এ প্রতিবেদকের নাম-ঠিকানা, বয়স, রক্তের গ্রুপ ইত্যাদি লিখেন। নিজেই অনুমান নির্ভর উচ্চতা ও ওজনের পরিমাণ লিখে হেলথ কার্ডটি আরেকটি কক্ষে পাঠিয়ে দেন।
২০-২২ মিনিট পর ৪র্থ তলায় ডেকে পাঠানো হয় কথিত ডাক্তারের কাছে। হেলথ কার্ড দেখে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ডাক্তার ১৫ দিনের জন্য ৪ ধরনের ওষুধ কেনার ব্যবস্থাপত্র দেন। ওষুধগুলো হলো_ মা'জুন আরদে খোরমা, লিভার কেয়ার (দিনার), এনার্জি প্লাস (নিশাত) এবং কস্তুরি সুপার ট্যাবলেট। ব্যবস্থাপত্র নিয়ে তাদেরই নির্ধারিত ওষুধের দোকানে গেলে সেখান থেকে বলা হয়, ওষুধগুলো কিনতে ২ হাজার ৭০০ টাকা লাগবে। এসব ওষুধ ওই কোম্পানির নিজস্ব এজেন্ট দোকান ছাড়া অন্য কোনো ফার্মেসিতে পাওয়া যায় না।
চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ধর্মীয় রূপ দিতে পারলে তো কথাই নেই। ব্যবসা তখন সোনায় সোহাগা। মতিঝিলের অদূরে উটের দুধ বিক্রি হচ্ছে সর্বরোগের মহৌষধ হিসেবে। ১০০ মিলিলিটার পরিমাণ উটের দুধের দাম রাখা হয় ১০১ টাকা, এরপরও নিজের খুশিতে কিছু টাকা হুজুরের দানবাক্সে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয়। উটের দুধের মাহাত্ম বর্ণনা দিতে গিয়ে টুপি ও হাজী রুমাল পরিহিত হাফেজ হাবিবুর রহমান বলেন, 'দুনিয়ার যে কোনো রোগ-বালাই, বিপদ-আপদ-মসিবত থেকে রক্ষা পেতে এ দুধ পানের বিকল্প নেই।
সহি নিয়তে পবিত্র অবস্থায় এ দুধ ওষুধ মনে করে সেবন করতে হবে। '
ভেষজ চিকিৎসার নামেও প্রতারণা : রাজধানীর মগবাজার মোড়েই পাশাপাশি অবস্থিত ইন্ডিয়া হারবাল ও কলিকাতা হারবাল নামের দুটি কথিত ভেষজ চিকিৎসালয়। দুটিরই মালিক জনৈক হাওলাদার (৩৬)। চকচকে সাইনবোর্ড। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিপাটি কেবিন।
দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সঙ্গে তোলা ছবি। ছবির নিচে লেখা, 'হারবাল চিকিৎসক হিসেবে বিশেষ অবদানের জন্য মন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন হাকিম... হাওলাদার। ' তার টেবিলে থরে থরে সাজানো ডজনখানেক 'শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকের' ট্রফি। দুটি চিকিৎসালয়ের কোনোটিরই চিকিৎসা সেবার নূ্যনতম অনুমোদন ও সরঞ্জাম নেই। চিকিৎসা কেন্দ্র পরিচালনাকারীদেরও নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা।
অথচ তারা মাসের পর মাস ধরে সব 'কঠিন ও জটিল' রোগের চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। অসংখ্য রোগীর সঙ্গে প্রতারণাসহ বহুবিধ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অতিসম্প্রতি র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ওই প্রতিষ্ঠান দুটিতে অভিযান চালায়। সেখানে গোলাম ফারুক হাওলাদারসহ চারজন কথিত ভেষজ চিকিৎসককে হাতেনাতে ধরে দুই বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দণ্ড পাওয়া অন্য তিনজন হলেন সাহেব আলী (৩০), মাসুদ ইসলাম (৩১) ও মশিউর রহমান (৩২)। আদালতের কাছে নিজের দোষ স্বীকার করে কথিত ভেষজ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ গোলাম ফারুক হাওলাদার বলেন, 'আমি অপরাধ করেছি।
মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছি। ১০ টাকার লতাপাতাকে ওষুধ বানিয়ে ১০ হাজার টাকায় বেচেছি। '
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।