আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জৈববিবর্তন: দ্বন্দ্ব বিরোধের দেড়শ' বছর/ মনিরুল ইসলাম



জীবজগত এবং এর সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোর উৎপত্তি এবং বিকাশ সম্পর্কে মানুষের যে সকল মৌলিক প্রশ্ন এবং অনুসন্ধিৎসা রয়েছে তা মেটানোর ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের যে শাখাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সফল সেটি হচ্ছে জৈববিবর্তনবাদ বা বিবর্তনমূলক জীববিজ্ঞান। শুধু তাই নয়, জৈব বিবর্তনের তত্ত্বই জীববিজ্ঞানের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা (সময়ের সাথে সাথে জীবের বংশগতির পরিবর্তন) সম্পর্কে বর্ণনা ও ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। তাই অনেক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে জৈব বিবর্তনের ব্যাখ্যা ছাড়া পরিপূর্ণভাবে বোঝা যায় না। আধুনিক প্রায়োগিক জীববিজ্ঞানসমূহের বহু প্রশ্নের সমাধান করা হয়েছে জৈববিবর্তনের তত্ত্বের ভিত্তিতে। এ কারণেই বিখ্যাত বংশগতি বিজ্ঞানী ডবঝন্স্কি বলেছিলেন- জীববিজ্ঞানে কোনো কিছুই অর্থবহ হয় না জৈব বিবর্তনের আলো ছাড়া।

অথচ আমাদের দেশে উচ্চ-শিক্ষিত, এমনকি মুক্তচিন্তার ধারক অধিকাংশ ব্যক্তির মধ্যেই জৈববিবর্তন সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। এদের মধ্যে অনেকেরই ধারণা বিবর্তন একটি বিতর্কিত বিষয় যা এখনো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জৈববিবর্তনের তত্ত্ব আমাদের দেশে সবচেয়ে অপঠিত একটি বিষয়। যাঁরা অল্পবিস্তর এ বিষয়ে পড়েছেন তাঁদের অধিকাংশেরই এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। এমনকি জৈববিজ্ঞান সমূহের উচ্চতর পর্যায়ের পাঠ্যক্রমেও এ বিষয়ে কোনো নিয়মিত চর্চা হয় না।

এ রকম একটি পরিস্থিতিতে অধিকাংশ মানুষই অপেশাদার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধ-যুক্তি এবং অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হবেন সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই বইটি জৈববিবর্তনের মূল বিষয় সম্পর্কিত নয়। বরং বিজ্ঞানের এই প্রয়োজনীয় শাখার বিরোধিতার স্বরুপ উন্মোচন এবং এই তত্ত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে যে সংকট রয়েছে তার বিভিন্ন দিককে তুলে ধরাই এই বইয়ের মূল লক্ষ্য। এ আলোচনা জৈববিবর্তন সম্পর্কিত বিভ্রান্তি কিছুটা দূর করতে পারলেও এ প্রচেষ্টা সার্থক হবে। গত শতকের সত্তর ও আশির দশকে মৌলবাদী গোষ্ঠী পশ্চিমা দেশগুলোতে ‘যৌক্তিকভাবে’ জৈববিবর্তনের বিরোধিতায় বেশ তৎপর হয়ে ওঠে।

তাঁরা এ সময় বেশ কিছু বিবর্তনবাদ-বিরোধী বইও প্রকাশ করেছিলেন। তাদের দেখাদেখি এ দেশেও মৌলবাদীরা ঐ সব বইয়ের অনুসৃতি প্রকাশ করতে থাকে। বিষয়টি এ দেশের প্রগতিশীল ও মুক্তচিন্তার অনুসারীদেরও দৃষ্টি কেড়েছিল। আশির দশকে, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন বাঙলাদেশ লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদক আনু মুহাম্মদ, মৌলানা রহীম রচিত 'বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব’ নামের বইটি আমাকে দেন এর একটি উপযুক্ত সমালোচনা লেখার জন্য। এ কাজটি করতে গিয়ে আমি জৈববিবর্তন এবং এ সংক্রান্ত বিতর্কগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের চেষ্টা করি।

নব্বই এর দশকে এ দেশের উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাক্রম থেকে জৈববিবর্তনকে বাদ দেবার পর এ বিষয়ে অস্পষ্টতা এবং বিভ্রান্তি দূর করার জোর তাগিদ অনুভব করি। এ সময়ে লেখক শিবিরের পত্রিকা তৃণমূল-এ প্রকাশিত ‘বিজ্ঞানের মৌলবাদী ব্যবহার’ প্রবন্ধে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করি। এ বিষয়ে সম্যক ধারণার জন্য ঐ আলোচনা যথেষ্ট ছিল না। তাই প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অনেকেই এ বিষয়ে আরো বিস্তৃতভাবে লিখতে অনুরোধ করেন। বর্তমান প্রবন্ধগুলি পরবর্তীকালে নতুন পাঠ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।

পত্রিকার সম্পাদক আনু মুহাম্মদ, জোনায়েদ সাকি, তাসলিমা আখ্তার, ফিরোজ আহমেদ এবং পাঠকদের অনেকের অব্যাহত তাগিদ ও চাপ ছাড়া আমার মতো অগোছালো মানুষের বই আলোর মুখ দেখত না। বইটি প্রকাশের জন্য সংহতি প্রকাশনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ......... গ্রন্থটির ভূমিকা অংশ বিজ্ঞানের ইতিহাসে যেসব নতুন আবিষ্কারকে পুরনো ধারণা, মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং রাষ্ট্রীয় বিরোধিতার শিকার হতে হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জৈববিবর্তন তত্ত্বের বিরোধিতা। এই বিরোধিতা এত ব্যাপক, বহুমুখী ও সুদীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে, যা ইতিহাসে নজিরবিহীন। একে একমাত্র তুলনা করা চলে কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের মতবাদের সাথে।

কিন্তু কোপার্নিকাস এবং গ্যালিলিওর মতবাদের বিরোধিতা অত্যন্ত তীব্র ও নিষ্ঠুর হলেও তা ছিল মূলত চার্চ এবং রাষ্ট্রের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। মৌলবাদী মূঢ়তার বাইরে জনসাধারণ বা বিজ্ঞানীদের পক্ষ থেকে কোনো উল্লেখযোগ্য যৌক্তিক বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়নি কোপার্নিকাসের তত্ত্বকে। অবশ্য একথাও ঠিক যে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর সমাজ বাস্তবতায় কোনো একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইনের বিখ্যাত গ্রন্থ অরিজিন অব স্পেসিস প্রকাশিত হবার পর অদ্যাবধি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সংগঠিত বা অসংগঠিতভাবে এর বহু ধরনের বিরোধিতা, অপব্যাখ্যা, অপব্যবহার পৃথিবীব্যাপী চলে আসছে। মৌলবাদী ও অযৌক্তিক বিরোধিতার পাশাপাশি অনেক যৌক্তিক বিরোধিতা এবং পদ্ধতিগত বিতর্কের ব্যাপকতাও কম নয়।

জীবজগতের একটি সাধারণ প্রবণতা হিসেবে জীববিজ্ঞানীদের দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে গৃহীত হবার পরও এই ব্যাপক বিরোধিতা দেখে অনুমান করা যায় যে, এই তত্ত্ব সম্পর্কে একদিকে যেমন রয়েছে অস্পষ্ট ও ভ্রান্তধারণা অন্যদিকে এ যুগেও বহু মানুষ এই তত্ত্বের ব্যাখ্যাগুলো গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত নন। এই সুদীর্ঘ ও ব্যাপক বিরোধিতার মধ্য দিয়ে বিবর্তনের তত্ত্ব সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের অবতারণা হয়েছে। প্রকাশ পেয়েছে মৌলবাদী ও পশ্চাৎপদ চেতনার প্রকাশ ও কর্মপদ্ধতি। এই বিরোধিতা ও বিতর্কগুলোকে জানা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে জৈববিবর্তনবাদ এবং এ যুগের মানুষের চিন্তার ওপর এই তত্ত্বের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াকে উপলব্ধি করা সম্ভব। দীর্ঘ দেড়শ’ বছরব্যাপী চলে আসা উল্লেখযোগ্য বিরোধিতাগুলোকে তুলে ধরা এবং এসবের যৌক্তিকতা ও প্রভাবকে উপলব্ধি করা এ যুগের মানুষের মুক্তচিন্তা বিকাশের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় একটি দিক।

দেড়শ’ বছর আগে বিবর্তনের বিজ্ঞানভিত্তিক তত্ত্বের প্রথম অবতারণা যেমন ঐতিহাসিকভাবে সমাজ ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির ধারাবাহিকতার সাথে সম্পর্কিত, তেমনি এ কথাও সত্যি যে বিবর্তনমূলক জীববিজ্ঞানও ১৮৫৯ সালের অবস্থান থেকে অনেকটা পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে গেছে এবং সমৃদ্ধ ও স্পষ্টতর হয়েছে। জৈববিবর্তন নিয়ে দ্বন্দ্ব বিরোধকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে এ বিষয়টাকে অবশ্যই বিবেচনার মধ্যে আনতে হবে। বিরোধিতার ধরনসমূহ জৈববিবর্তনের যেসব বিরোধিতা ও দ্বন্দ্ব বিভিন্ন সময়ে উপস্থিত হয়েছে তার মধ্যে একদিকে যেমন রয়েছে ধর্ম, ধর্মীয় গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান এবং মৌলবাদী বিরোধিতা। অন্যদিকে এ তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা ও অসম্পূর্ণতাকে উপস্থাপন করার মাধ্যমে যৌক্তিক বিরোধিতারও একটা ধারা রয়েছে। এই দুই বিরোধিতার মাঝামাঝি রয়েছেন সমন্বয়বাদীরা, যারা জৈববিবর্তনকে গ্রহণ করেছেন ধর্মীয় ধারণার সাথে মিলিয়ে।

অনেকে একে বর্জন করেছেন কিছুটা ভুল বুঝে এবং কিছুটা আবেগে; এদের মতে বিবর্তনবাদ ‘হৃদয়’ বা ‘মন’কে অস্বীকার করে। অন্য এক ধরনের প্রবণতা হচ্ছে এর সুবিধাবাদী ও বিকৃত ব্যাখ্যা করা, যা সমন্বয়বাদিদের মধ্যেও কিছুটা রয়েছে; কিন্তু সুবিধাবাদী ব্যাখ্যাকারীরা ইতিহাসে পৃথকভাবে চিহ্নিত হয়ে আছে, কারণ এরা তাদের জৈব-নির্ধারণবাদী ব্যাখ্যার মাধ্যমে নিষ্ঠুরতম বর্ণবাদের জন্ম দিয়েছিল। অপর এক ধরনের বিতর্ক হচ্ছে পদ্ধতিগত বিতর্ক। এখানে জৈববিবর্তনের বিরোধিতা নেই, কিন্তু কিভাবে তা ঘটেছে তা নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মতবাদের জোর দ্বন্দ্ব বিরোধ। জৈববিবর্তনের এসব বিরোধিতার ঐতিহাসিক, সামাজিক ও মানসিক মাত্রাকে বুঝতে না পারলে এসব বিরোধিতার গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

তাই আমাদের আলোচনায় বিরোধিতার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এসব মাত্রাকে যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্যই অনেক প্রাসঙ্গিক ঘটনা ও আলোচনার অবতারণা করা হয়েছে। মনিরুল ইসলাম ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ ঢাকা ফেব্রুয়ারি ২০০৮ এ সংহতি কর্তৃক প্রকাশিত এই বইটির দাম ১০০ টাকা

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।