ভালোবাসার ঊর্বশী বুকে লেখা আছে এক নাম- সে আমার দেশ, আলগ্ন সুন্দর ভূমি- বিমূর্ত অঙ্গনে প্রতিদিন প্রতিরাত জেগে ওঠে তার উদ্ভাসিত মুখ
পরিবেশ পরিস্থিতির কারণেই মানুষ পরবাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। আমিও আমার জায়গীর জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছি ধীরে ধীরে। আগে মা-বাবা, ভাই-বোনদের জন্য হৃদয়টা যেরকম আকুপাকু করতো এখন আর তেমন করে না। আমার তৃতীয় জায়গীর জীবন শুরু হয় ক্লাস নাইনে উঠে। এর মধ্যে আপগ্রেড হাইস্কুল ছাড়তে হলো।
আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরের এক স্কুলে। অতএব জায়গীর থাকা আমার জন্য অবধারিত। নতুন স্কুলে যেতে পেরে আমিও গর্বিত। যদিও আগের স্কুলে ক্লাস এইটে আমিই একমাত্র বৃত্তি পেয়েছিলাম তথাপি প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্টের মতো সেটা উজ্জ্বল ছিলো না। এক্ষেত্রে বাড়ি ছেড়ে বারবার জায়গীর বদল যেমন দায়ী তেমনি দায়ী ছিলো ঐ শহীদ সালাম স্কুলটিও।
আমার বর্তমান স্কুলের নাম ব্রাহ্মণশাসন হাই স্কুল। ঘাটাইল থানার মধ্যে নামকরা স্কুল। প্রতি বছর বেশ ক'জন করে প্রথম বিভাগে পাস করে এই স্কুল থেকে। বাবা সাথে করে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন। যেহেতু আমি প্রতিবার বৃত্তি পাই তাই কোনো স্কুলেই আমার কোনো মাসিক বেতন দিতে হয় না।
আমার মতো গরীব ছাত্রের জন্য এ ছিলো বিরাট সহায়। এলাকায় আমার নাম ছড়িয়েছিলো প্রাইমারি বৃত্তির কারণেই। তাই ব্রাহ্মণশাসন স্কুলের হেড স্যার, বিএসসি স্যার আমাকে একটু ঝালিয়ে নিলেন। জীবনে প্রথম ইন্টারভিউয়ে মনে হলো ভালোভাবেই উতরে গেলাম। বাবা আমার জন্য ধারেকাছে কোথাও থাকা-খাওয়ার আবেদন করলেন স্যারদের কাছে।
তারা বললেন- খুব তাড়াতাড়ি আমার জায়গীরের ব্যবস্থা করবেন।
জায়গীরের ব্যবস্থা হলো হরিপুর গ্রামে। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ রোডের পাশে ছোট্ট একটি গ্রাম। কাছেই ঘাটাইল থানা শহর। হরিপুর থেকে স্কুল এক-দেড় মাইল দূরে।
আমি হেঁটে হেঁটে ক্লাস করতে যাই। সাথে উপর নিচের ক্লাসের আরও অনেকেই যায়। আমার লজিং মাস্টারের নাম হাতেম আলী আকন্দ। নানা বলে ডাকি তাকে। বেশ বয়স্ক, সাদাসিদে অমায়িক লোক।
প্রথম দর্শনেই মনে ধরে যায় লোকটিকে। হাতেম নানার ছয় ছেলে, দুই মেয়ে। ছয় ছেলেমেয়ে বড়ো বড়ো, বিয়ে শাদী করেছে। ছেলেদের মামা বলে ডাকি। নানার ছোট ছেলে মোখলেস আমার সমবয়সী।
আমার এক ক্লাস নিচে পড়ে।
হরিপুর আমার জায়গীর জীবনের সবচেয়ে মধুরতম স্থান। ওখানকার মধুর স্মৃতি বেশ আনন্দ দেয় এখনও। তথাকথিত জায়গীর বাড়ির মতো কাজকর্ম করতে হতো না। ও বাড়ির ছেলের মতোই আমাকে দেখতো তারা।
এর কারণে বেশ বন্ধুবান্ধব জুটে গেলো তাড়াতাড়ি। শরীর-স্বাস্থ্য ফিরে আসতে শুরু করেছে। শরীরে পরিবর্তন বুঝতে পারছি বেশ। দাড়ি-গোঁফ যদিও ওঠেনি তবে গলার স্বরে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে। নতুন বন্ধুত্বে মনটা উচ্ছল থাকে সবসময়।
সবার সাথে খেলাধূলা করা, বনেবাদাড়ে ঘোরাঘুরি আর সিনেমা দেখা আমার প্রিয় কাজ হয়ে গেলো। তবে স্কুলে যাওয়া, পড়াশোনায়ও নিয়মিত ছিলাম আমি।
হরিপুর গ্রামে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু রউফ। ও হাতেম নানার পাশের বাড়ির, আমার এক ক্লাস নিচে পড়ে। মোখলেস মামা এবং রউফ দুজনে যদিও পড়াশোনায় আমার জুনিয়র তবে শরীর-স্বাস্থ্যে আমার চেয়ে বেশ পোক্ত ছিলো।
ওদের পরিপক্ক চলনবলনে আমার উৎসাহ বাড়তে লাগলো। শারীরিক পরিবর্তনের অনেক কিছু ওদের কাছে জানতে চাই। রউফ একটু খোলামেলা বলে তবে মোখলেস মামা আমাকে কিছু বলে না। সিনেমার নায়ক নায়িকাদের রূপ-যৌবন, পাড়ার মেয়েরা কে কেমন এগুলো ছিলো আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু। রউফের কাছে আমি মাঝে মাঝে ধোপাজানীর ঝুনুর কথা বলি।
আজ কতোক্ষণ চোখাচোখি হলো, স্কুলে যাওয়ার পথে কতোক্ষণ একসাথে ছিলাম। ঝুনু রউফদের কেমন যেন আত্মীয়া। ব্রাহ্মণশাসন স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ে। শ্যামাবরণ মেয়েটিকে আমার খুব ভালো লাগতো। আমার সাথে গল্পে রউফ খুব মজা পেতো।
ঘাটাইলে তখন নতুন একটি সিনেমা হল খুলেছে। নাম কনক সিনেমা। আমরা দল বেঁধে নিয়মিত সিনেমা দেখি। কোনো নতুন ছবি দু'বার করেও দেখি। আমি আবার দেখা সিনেমাগুলোর নাম বাঁধাই করা খাতায় লিখে রাখি সময়-তারিখ দিয়ে।
লক্ষ্য- মোট কতোগুলো সিনেমা দেখলাম তার হিসেব থাকবে আজীবন। বেশিরভাগ সময় রাতে পড়াশোনা শেষে চুপি চুপি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে যাই লাস্ট শো দেখতে। আমার টিকেটের টাকা জোগায় রউফ অথবা মোখলেস মামা।
ক'দিন আর টাকার জোগাড় হয় এভাবে! আমাদের এখন মাসে চার-পাঁচবার সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করে। খুব ভাবনায় পড়ে গেলাম পাঁচজনের দলটি।
বড়ো রাস্তার ওপারে বেশ কিছু ইটের ভাটা ছিলো। নিজেরা শলাপরামর্শ করে বুদ্ধি বের করলাম এক ইট ভাটার কাঠ অন্য ভাটায় নিয়ে বিক্রি করবো। একরাতে পাঁচজনের দলের সাথে অপারেশনে আমিও সামিল হলাম। আঁধার রাতে বেশ কিছু কাঠ চুরি করলাম ভাটা থেকে। তারপর সেগুলোকে নিরাপদ দূরত্বে এক জায়গায় জড়ো করলাম।
সবাই মিলে সকালে উঠে অন্য ভাটায় বিক্রি করে এলাম। ইটখোলার ম্যানেজার কিছুটা সন্দেহের চোখে তাকালো বোধ হয়। তবে রউফের যুক্তিতে দাম দিয়ে দিলো শেষে। তবে পুরোটা নয়,আধাআধি দাম। এতেই আমাদের সে রাতের সিনেমা দেখা ও নাস্তার টাকা উঠে এলো।
অপারেশন ইটভাটা শেষে আমরা খুউব মউজে আছি। নতুন শলাপরার্শ করি কিভাবে আরও সিনেমা দেখার টাকা জোগাড় করা যায়। কিন্তু এর মধ্যেই আসল খবর হয়ে গেছে। ইটভাটার ম্যানেজার সব বলে দিয়েছে। হরিপুর গ্রামের পাঁচজন ছেলে ইটখোলার কাঠ চুরি করে বিক্রি করেছে।
সবার গার্জিয়ানের কাছে বিচার এলো। হাতেম নানা, বড়ো মামাদের কানেও গেলো। মোখলেস মামা আবার নানীর ছোটো ছেলে এবং আদরের। নানী তার অন্য ছেলেদের কাছে বলতে লাগলো- ঐ কালকুটাই বুদ্ধি দিয়া মোখলেছরে নিয়া গেছে। আমার পোলা এই কাম করার না!
আমি বিস্মিত! করলে সবাই মিলে চুরি করেছি।
আমি তো একা করি নাই। রউফ আমাকে আশ্বস্ত করলো। কারণ ইটভাটার মালিক পাশের গ্রামের এবং তাদের আত্মীয়। সামান্য কিছু কাঠ এবং নিজেদের ছেলেপেলে কাজটা করেছে বলে জায়গীর হয়েও আমি সে যাত্রা রেহাই পেলাম।
কৈশোর বয়সে যে কোনো অজানা জিনিসেই উৎসাহ থাকে বেশি।
আমারও তাই। নিজের ভেতরের পরিবর্তন এবং অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করে শরীরে। বিশেষ করে ঘুমাতে গেলে। রাতে ঠিকমত ঘুম হয় না আমার। একসাথে পড়ালেখার পর মোখলেস মামার সাথে ঘুমাই।
বিরাট চৌকি, এক পাশে আমি অন্য পাশে মোখলেস মামা। বেশ ক'দিন ধরে খেয়াল করছি বেশি রাতে চৌকি নড়ে। একমাত্র মোখলেস মামা ছাড়া ওপাশে আর কেউই তো নেই। আমার ঘুমে ব্যাঘাত হয়। বিষয়টি নিয়ে রউফের সাথে আলাপ করি একদিন।
ও-ই প্রথম ছেলেদের হাত চালানোর বিষয়টি সম্পর্কে আমাকে জ্ঞান দেয়। এরপর রাতে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাই। মোখলেস মামা কী করে আমি তো সব বুঝি!
বোধ হয় রউফ মোখলেস মামাকেও রাতের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলে থাকবে। মোখলেস মামার অজানা গোমড় ফাঁস হওয়াতে মনে খুব ব্যথা পেলো। ক'দিন ধরে আমার সাথে কথা বলে না সে।
নানীর কাছে নালিশ করেছে- আমাকে আর জায়গীর রাখার দরকার নেই। নানী ছোটো ছেলে অন্তঃপ্রাণ। নানার কাছে বলেন। তবে নানা গা করেন না। কারণ মোখলেস মামা কেন আমাকে রাখতে চায় না সেকথা খুলে বলেনি কারও কাছে।
এবার মোখলেস মামা হুমকি দেয়- আমি থাকলে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। নানী বিপদে পড়ে। তার ছোটো ছেলে না আবার দেশান্তরী হয়ে যায়!
একদিন মধুপুর থেকে বেলায়েত মামা বাড়িতে এসেছেন। বেলায়েত মামা ছিলেন সবার বড়ো। বাড়িতে তার কথার আলাদা একটা ওজন আছে।
মামী তার কাছে নালিশ করলেন আমার ব্যাপারে। সত্যমিথ্যা নানান দোষত্রুটিসহ মোখলেস মামার সাথে যে আমার বনছে না সে কথাটি বললেন। মামা ডাকালেন আমাকে। সেই প্রথম বড়ো মামার সাথে আমার কথা হলো। আমার নাম, বাড়িঘর জিজ্ঞেস করার পর এলেন স্কুলের পড়ালেখায়।
সবেমাত্র আমি ক্লাস টেনে উঠেছি। আমার রোল নম্বর এক। সব সেকশন মিলিয়ে আমিই ক্লাসের প্রথম। ধীরে ধীরে আমার পূর্বের কীর্তির কথাও শুনলেন। সব ক্লাসেই আমি প্রথম হতাম।
এমন কি স্কুল পরিবর্তনের পর ব্রাহ্মণশাসন স্কুলের ভর্তি রোল একাশি-কে এক বানিয়েছিলাম নিজের অধ্যবসায়েই। বেলায়েত মামা সব শুনে বললেন- এ জয়গীরকেই আমার দরকার। মা, তোমার ছোটো ছেলেকে বলো ভালো না লাগলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাক। এরপর নানী আর কাউকেই বিচার দেননি। আর মোখলেস মামাও বাড়ি ছেড়ে যায়নি কখনো।
প্রাইভেট পড়তে পারতাম না বলে স্কুলে স্যারদের খুব একটা সুনজরে ছিলাম না। হেড স্যার তো আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা করতেন। বিশেষ করে ফার্স্ট বয় হিসেবে আমার চলাফেরা, কাজকর্মে মনে হয় উনি খুশি হতেন না। কারণ ভালো ছাত্র হয়েও আমি গানবাজনা, নাটক নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। একবার 'পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ' নাটকের রাজপুত্রের অভিনয় করে গোবিন্দ স্যারের কাছে থেকে প্রাইজও নিয়েছিলাম।
তখন হেড স্যার বলতেন- এ ব্যাচটা পড়াশোনায় ভালো না হলেও নাটকে বেশ নাম করেছে।
ঊনিশ শ' আশি সাল। আমি এসএসসি পরীক্ষায় পাস করি। স্টারমার্কসহ প্রথম বিভাগ। ঊনিশ শ' বাহাত্তর সালে আমাদের স্কুলের কদ্দুস স্যার স্টার মার্ক পাবার পর আমিই সেই রেকর্ড ভাঙি।
পাসের পর স্কুলের স্যাররা আফসোস করতেন আমাকে দেখলেই। আরও একটু যত্ন নিলে আমি নাকি বোর্ডে স্টান্ড করতে পারতাম! রেজাল্ট শেষে হরিপুর এলাকায় যখন ঘুরতাম একবার হলেও আমার মুখটি অনেকে দেখতে চাইতো। ভাবতাম আমি আবার কোন্ চিড়িয়াখানার জীব! পরে জানলাম- হাতেম নানার বাড়িতে ইতিপূর্বে যারা জায়গীর থেকেছে তারা নাকি একবারে পাস করতে পারেনি, অনেকবার লেগেছে!
০৯.০৩.২০০৮
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।