ভালোবাসার ঊর্বশী বুকে লেখা আছে এক নাম- সে আমার দেশ, আলগ্ন সুন্দর ভূমি- বিমূর্ত অঙ্গনে প্রতিদিন প্রতিরাত জেগে ওঠে তার উদ্ভাসিত মুখ
দ্বিতীয় জায়গীর জীবন শুরু হয় ক্লাস সেভেনের শেষ দিকে। এবার আমাদের গ্রামের আরও কাছাকাছি চলে আসি। খায়েরপাড়া গ্রামের মুইচা সরকারের বাড়ি। মুইচা সরকার আমাদের ইউনিয়নের এলাহি চেয়ারম্যানের চাচা। গ্রামের অনেকে তাকে মুইচা কানাও বলতো।
তবে সামনাসামনি নয়, আড়ালে আবডালে। কারণ তার এক চোখ কানা ছিলো। প্রথম দর্শন থেকেই লোকটিকে আমি ভয় পেতাম। বেশিক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারতাম না। তাকে দেখলে আমার রূপকথার এক চক্ষু ডাকাত সর্দারের কথা মনে হতো।
এবার আর কামলাঝমালদের সাথে থকতে হলো না আমাকে। তখনকার দিনে গ্রামের স্কুলে ভালো লেখাপড়ার জন্য বোর্ডিং-এর ব্যবস্থা ছিলো। আমাদের প্রিয় জয়নূল স্যার রাতে বোর্ডিং-এ পড়াতেন। তিনি প্রাইমারি স্কুলের চাকুরী থেকে রিটায়ার্ড করে হাই স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। আমাদের স্কুলটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো স্বাধীনতার পরপরই।
শহীদ সালাম হাই স্কুল তখন নতুন। মাত্র ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ানো হতো। গ্রামের লোকেরা বলতো আপগ্রেড স্কুল। প্রাইমারি স্কুলের ভালো রেজাল্টের সুবাদে আমি চেয়েছিলাম দূরের কোনো ভালো স্কুলে পড়ি। কিন্তু একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামের স্মৃতিতে স্কুল।
বড়ো ভাই জোর করে আমাকে রেখে দিলেন শহীদ সালাম স্কুলে।
আমাদের জয়নূল স্যার ছিলেন বেশ পরহেজগার। ছাত্রদের নামায রোজার ব্যাপারেও বেশ কঠোর। প্রতি ওয়াক্ত নামাযের সময়ে আযান দিতে হতো। সবাইকে জামায়াতে নামায পড়তে হতো।
আমরা ঘুমাতাম স্কুল রুমে। খুব সকালে উঠতে হতো ফজরের নামাযের জন্য। একদিন ঘুম থেকে উঠে শুনি জয়নূল স্যারের চিল্লাচিল্লি। বারান্দায় নামাযের জায়গায় কে যেন পেশাব করে রেখেছে। স্যার পানি ঢেলে ধুয়ে ফেলছেন আর গালাগাল করছেন।
হঠাৎ মনে হলো আমার- গত রাতে এ কাজ তো আমিই করেছি! পেশাবের তাড়নায় ঘুম ভাঙলে ভয়ে আর বাইরে যাবার সাহস পাইনি। দরজায় নিচ দিয়ে বারান্দায় দিয়েছিলাম চালান করে। আমি চুপ মেরে যাই, জয়নূল স্যারের গালাগাল শুনি বিছানায় শুয়ে।
স্কুলের বোর্ডি-এ থাকি। খাবার সময় হলে জায়গীর বাড়ি থেকে খেয়ে আসি।
সকাল-দুপর-রাত মিলে তিনবেলা। কোনো কোনোদিন শুধু স্কুলে যাবার আগে সকাল দশটায় আর রাতে। তবে বিকেলবেলা চলে যেতে হতো জায়গীর বাড়িতে। রোযার সময় বেশ বেকায়দায় পড়ে গেলাম। জয়নূর স্যারের নির্দেশ- সবাইকে রোযা রাখতে হবে।
ভোররাতে জায়গীর বাড়িতে খেয়ে আসার বেশ ঝামেলা। একা একা রাতে খাবার খেতে যেতে ভয় হতো। আমার বন্ধুরা প্রায়ই মুইচা সরকারের বাড়ির পেছনের আমগাছে একজনের ফাঁসি দিয়ে মরে যাবার ঘটনা বলতো। আমাকে আবার সে পথ দিয়েই যেতে হতো। সারা রমযান ভয়ে ভয়ে সে গাছের নিচ দিয়ে যাতায়াত করেছি।
বোধ হয় ভূতও আমার প্রতি সদয় ছিলো, চোখের সামনে ভূতরাজা কোনোদিন দেখা দেয়নি সেসব রাতে।
মুইচা সরকারের বাড়িতেও নানান ফুটফরমাস করতে হতো। গরুর চারিতে ঘাস-খড় কেটে দেয়া, পানি দেয়া। মাঝে মাঝে সকালে কামলাদের জন্য মাঠে খাবার নিয়ে যাওয়া। তবে এ বাড়িতে আরও এক বাড়তি কাজ ছিলো।
তার বড়ো ছেলের ঘরের নাতনি শিউলীকে কোলে রাখা। কারণ একেবারে ছোটো নাতনিটিও ছিলো কোলে। তাই আড়াই বছরের নাতনিকে কোলে রাখার ভার পড়তো আমার উপর। সন্ধ্যার আগে চলে যেতাম রাতের খাবারের জন্য। ঘন্টাখানেক কোলে নিয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরতাম শিউলীকে নিয়ে।
আমি নিজে যে গায়েপায়ে খুব সবল ছিলাম তা নয়। আমার পক্ষে মোটাসোটা শিউলীকে কোলে রাখা তাই কষ্টকর ছিলো। মাঝেমধ্যে যখন কুলাতে পারতাম না তখন আস্তে করে চিমটি কেটে দিতাম তাকে। শিউলী কাঁদতো, আর ওর মা তখন এসে তাড়াতাড়ি আমার কোল থেকে নিয়ে যেতো ওকে।
হঠাৎ হঠাৎ বেশ শক্ত কাজও করতে হতো আমাকে।
যেমন মাথায় করে জিনিসপত্র নিয়ে হাটে বিক্রি করা, বাজার করা। একদিন মুইচা সরকার যাবেন সয়ার হাটে। এক বস্তা ধান তুলে দিলেন আমার মাথায়- চলো, হাঁটে যাই।
আমি তাকে খুব ভয় পেতাম। ওজন বেশি, না আমার জন্য ঠিক ছিলো খেয়াল না করেই মাথায় নিয়ে তার পিছে হাঁটা ধরলাম।
বাড়ি থেকে খুব বেশি দূর যেতে পারলাম না। আধা মাইল রাস্তা পেরুনের পরপরই মনে হলো আমার মাথা ঘাড়সহ নিচের দিকে ডেবে যাচ্ছে। মুইচা সরকার হাটুরেদের সাথে আলাপে আলাপে বেশ দূরে চলে গিয়েছিলেন। এদিকে পেছনে আমার অবস্থা একেবারে গুরুতর। জেলাবোর্ডের রাস্তার উপর ধপাস করে ফেলে দিলাম বস্তা।
শব্দে খেয়াল হলো মুইচা সরকারের। ফিরে এসে এক ঝটকায় বস্তা মাথায় তুলে বললেন- যাও, বাড়ি যাও। শুধু খাইতে জানো, কাজের বেলায় ফাঁকিবাজ!
নিয়মমাফিক পরদিন সন্ধ্যার আগে গেলাম জায়গীর বাড়িতে খেতে। আমাকে কাছে পেয়ে মুইচা সরকার বকাঝকা শুরু করলেন। আগের দিন সয়ার হাটে আমার বোঝা নিয়ে না যাবার কারণে তিনি রেগে গেছেন।
বোধহয় আমার বোঝা নিজে নিয়ে যাওয়ায় তার মানহানিও হয়েছে। তিনি জানিয়ে দিলেন- আর জায়গীর রাখবেন না আমাকে। আমি মন খারাপ করে ঘরের কোণের চৌকিতে বসে আছি। পাশে এক চক্ষু দানব মুইচা সরকার বকবক করছেন। চিল্লাচিল্লিতে এ ঘরে ছুটে এলেন তার বড়ো ছেলের বউ অর্থাৎ শিউলীর মা।
শ্বশুড়কে বোঝাতে লাগলেন চুপ থাকতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা?
বকায় বকায় আমার মাথা হচ্ছে নিচু, চোখ ছলছল। আমার কিছুই বলার নেই- কারণ আমি অপরাধী। নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে- একটা বস্তা নেবার মতো শক্তি কেন নেই আমার গায়ে! এমন সময় হঠাৎ কোত্থেকে যেন ছুটে এলো ফিরোজা, এলাহি চেয়ারম্যানের ভাতিজি। এমন রুদ্রমূর্তি আমি আগে কখনো দেখিনি ওর।
ও বলতে লাগলো- দাদা, আপনের কুনো লজ্জাশরম নাই? তিনবেলা ভাতের লাইগাই তো ও জায়গীর থাকে। আপনের কি ঘরে ধান-চাইলের অভাব? আমোগো স্কুলে সবচে' ভালা ছাত্র অইলো ও। এইডা আপনের কপাল যে ও আপনের বাড়িতে থাকে। গেরামে কতো মানুষ আছে জায়গীর রাখার!
এই প্রথম ফিরোজাকে ভালো করে দেখলাম আমি। আমার এক ক্লাস নিচে পড়তো ও।
কিন্তু গায়েপায়ে ছিলো আমার চেয়ে বেশ বড়ো এবং সুন্দরীও বটে। ওর প্রতি মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম আমি। ফিরোজার রোষানলে পড়ে মুইচা সরকার একটি কথাও বললেন না আর। চুপ করে চলে গেলেন অন্য ঘরে। তারপর শিউলীর মা আমার হাত ধরে নিয়ে গেলো ভাত খাওয়ানোর জন্য।
বছর দুয়েক পর ফিরোজার বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো। ওর স্বামী ছিলো রোডস এন্ড হাইওয়ের বড়ো কন্ট্রাক্টর। উচ্চ শিক্ষার্থে আমি যখন ময়মনসিংহ যাই ততোদিনে ফিরোজারা শহরে বাড়ি করেছে। গুলকিবাড়িতে ওদের বাড়িতে যখন বেড়াতে যেতাম ভালোমন্দ রেঁধে খাওয়াতে আমাকে। এদিকে মুইচা সরকারের বড়ো নাতনি শিউলীও ততোদিনে বড়ো হয়েছে।
এলাকার গরীব মেধাবী ছাত্র ছিলাম আমি। পড়ার খরচ দেবার বিনিময়ে শিউলীর সাথে বিয়ের প্রস্তাবও দেয় আমার গার্জিয়ানের কাছে। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি ছিলাম একরোখা,ছাত্রজীবনে বিয়ে করতে রাজি হইনি কখনো!
০৭.০৩.২০০৮
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।