আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জিহাদ নিয়ে বিভ্রান্তির উৎস ও তার সমাধান

যে ব্যক্তি সত্কর্মপরায়ণ হয়ে স্বীয় মুখমন্ডলকে আল্লাহ্ অভিমূখী করে. সে এক মজবুত হাতল ধারন করে. সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর দিকে।

“আমরা ছোট জিহাদ থেকে পত্যাবর্তন করে বড় জিহাদের প্রতি ধাবিত হয়েছি। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন হে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বড় জিহাদ কোনটি ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, অন্তরের জিহাদ। ’’ এই হাদিসটি দ্বারাই সাধারণত বিভ্রান্তির ছড়ানো হয়ে থাকে। তাই এই হাদিস সর্ম্পকে ওলামায়ে কেরামদের বক্তব্য নিম্মে তুলে ধরা হলো: মোল্লা আলী ক্বারী (রহ) এর অভিমতঃ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (রহ তার রচিত প্রসিদ্ধগ্রন্থ “মাওযুআতে কুবরা” -এর ১২৭ প্রষ্ঠায় উল্ল্যেখিত বাক্য--- উল্ল্যেখ করে, আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ) -এর বরাত দিয়ে বলেন, বর্তমানে উল্ল্যেখিত বাক্যটি মানুষের মুখে মুখে হাদিস হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়েছে অথচ এটা কোন হাদিস নয়।

এটা ইবরাহিম ইবনে আবলাহ নামক ব্যক্তির একটি উক্তি মাত্র। তানজীমূল আশতাত এর বক্তব্য: মিশকাত শরীফের প্রসিদ্ধ ব্যখ্যাগ্রন্থ, উর্দূ শরাহ ‘তানজীমূল আশতাত’ নামক কিতাবে ‘আত তা’লীকুস সাবীহ’ ও ‘তাফসীরে বাইযাবী’র উদ্ধৃতি দিয়ে উল্ল্যেখ করা হয় যে, আল্লামা ইবনে তাইমীয়া (রহ) বলেছেন যে, এ হাদিসের কোন ভিত্তি নেই। (তানযীমূল আশতাত প্রথম খন্ড ৬৯ পৃষ্ঠা) আল্লামা ইবনে নুহহাছ (রহ) এর বক্তব্য: ইমামূল মাগাজী আল্লাম ইবনে নুহহাছ (রহ) তার প্রসিদ্ধ জিহাদগ্রন্থ “মাশারীউল আশওয়াক্ব ইলা মাসারীউল উশশাক্ব” কিতাবের ভূমিকায় উল্ল্যেখ করেন, ইসলামের চির দুশমন কাফির-মুশরিকরা যখন দেখলো যে, মুসলমানরা তাদের আত্মারক্ষার জন্য এবং আল্লাহর যমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদকে মূল হাতিয়ার হিসেবে অবলম্বন করেছে । যতদিন পর্যন্ত দুনিয়ার বুকে জিহাদ প্রতিষ্ঠিত থাকবে ততদিন ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমন কোথাও তাটুগেড়ে বসার সুযোগ পাবে না। কেননা জিহাদের বরকতে ও আল্লাহর সাহায্যে মুসলমান মাত্র কম সময়ে অর্ধদুনিয়াকে বিজয় করে নিয়েছে।

ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইসলামের দুশমনরা কয়েক বছর গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হল যে, জিহাদের মিশনকে ভেঙ্গে দিতে পারলে বা কোন ভাবে তা কমজোর করতে পারলেই সফলতায় পৌছে যাবে। তারা এই অসাধ্য সাধনে মরিয়া হয়ে উঠলো, তারা সর্বশক্তি বির্সজন দিয়ে নিজেদের মিশনে সফলতা লাভ করতে চাইল। কিন্তু সকল প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তারা এক নতুন সুক্ষ ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করল। আর তাহলো, মুসলমানদের মাঝে প্রবেশ করে জিহাদকে “আসগার” বা ছোট জিহাদ ও “আকবার” বা বড় জিহাদ রুপে বিভক্ত করে দিল। নফসের সাথে জিহাদকে বড় জিহাদ ও দুশমনের মোকাবিলায় যুদ্ধ করাকে ছোট জিহাদ হিসেবে সাব্যস্ত করল।

ইসলামের দুশমনরা তাদের এ মিশনে পরিপূর্ণ সফলতা লাভের জন্য এ বাক্যটিকে হাদীস বলে চালিয়ে দিল এবং এর নিসবত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দিকে করে দিল। কারণ তারা জানে মুসলমানদের নিকট অতি সহজে একটি বিষয়ে গ্রহণযোগ্যতা লাভের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দিকে নিসবত করাই সর্বাধিক সহজ পথ। বাক্যটিকে হাদীস হিসেবে দাঁড় করালো। অথচ এ বাক্যটিকে বাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দিকে নিসবত করা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তাছাড়া হাদীসের কোন কিতাবে এই বাক্যটি সরাসরি হাদীস হিসেবে উল্ল্যেখ নেই।

ইবরাহীম ইবনে আবলাহ (রহ) -এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয় যে, এটি তার বাক্য। যদিও তিনি একজন গ্রহণযোগ্য রাবী। তথাপী আল্লামা দারাকুতনী বলেন, ইবরাহীম ইবনে আবলাহ (রহ) -এর নিসবত করারও কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ উল্লেখ নেই। ভিত্তিহীন এ হাদীসের প্রভাব সাধারণ মুসলমানদের উপর এমন ভাবে পড়েছে যে, তারা নফস ও শয়তানের সাথে মোকাবিলাকে বড় জিহাদ হিসাবে আঁকড়ে ধরেছে, এবং কাফেরদের সাথে কৃত ছোট জিহাদকে পরিত্যাগ করে পার্শ্ব অবলম্বন করে নিয়েছে। যিকির –ফিকিরের সাথে তাসবীহ হাতে নিয়ে ইবাদতে এমন মশগুল হয়েছে যে, দুনিয়া কাফেরদের জন্য খালি করে দিয়েছে আর এ যুগে সমস্ত কুফরী শক্তি দুনিয়ার মসনদ গুলো দখন করে নিয়েছে।

মুসলমান আবদ্ধ হয়েছে গোলামীর জিজ্ঞিরে। শাহ আব্দুল আজিজ (রহ) এর বর্ণনাঃ শাহ আব্দুল আজিজ (রহ) কতৃক রচিত প্রসিদ্ধ ফাতওয়ার কিতাব ফাতওয়ায়ে আজিজীর ১০২ পৃষ্ঠায় এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, এ বাক্যটি সুফিদের কিতাব সমূহে ব্যপকভাবে পাওয়া যায়। তাদের নিকটই এ বাক্যটি হাদীসে নববী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিসাবে গ্রহণযোগ্য। পীর-সূফীদের দ্বারা প্রভাবিত কিছূ সংখ্যক মুহাদ্দেসগণও কোন কোন কিতাবে এ বাক্যটিকে হাদীস বলে উল্ল্যেখ করেছেন। যদিও তার কোন ভিত্তি নেই।

যা হোক যদি বাক্যটিকে তার আসল অর্থে ধরা হয় তবে তার উদ্দেশ্য এই হয়না যে, জিহাদে আকবারের অর্থ যুদ্ধের ময়দানে কাফিরের সাথে মোকাবেলাকে সম্পূর্ন রুপে পরিহার করে বসে যাবে। বরং নফস ও শয়তানের বিরুদ্ধে অধিক মুজাহাদা করবে সুফিদের সুস্পষ্ট অভিমত। আল্লামা ফজল মুহাম্মদ সাহেব (মহাদ্দীস বিন নূরী টাউন করাচী (দা:বা বলেন শাহ সাহেব (রহ) এর বক্তব্যে একথা সুস্পষ্ট যে, “এ বাক্যটি সুফিদের হতে পারে ” কোন হাদীস নয়। খতীবে বাগদাদী (রহ) এর বর্ণনাঃ খতীবে বাগদাদী ও কিছু সংখ্যক ওলামায়ে কিরাম পূর্বোক্ত বাক্যের ন্যায় ভিন্ন হাদীস বর্ণনা করেন যার অর্থ হল, “যাবের রা. বর্ণনা করেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করে সাহাবায়ে কিরামদেরকে লক্ষ করে বললেন, সুসংবাদ তোমাদের জন্য! সুসংবাদ! তোমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের প্রতি প্রত্যাবর্র্তন করেছ, সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন, বড় জিহাদ কোনটি? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, খাহেশাত ও প্রবৃত্তির মুজাহাদা করাই বড় জিহাদ। এ হাদীসের বর্ণনাকারীদের ক্ষেত্রে বিজ্ঞ মুহাদ্দীসিনে কিরামদের যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে।

এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী “খলফ ইবনে মুহাম্মদ খিয়াম” যার সম্পর্কে আসমায়ে রিজালের বিশেষজ্ঞ ইমাম হাকেম (রহ) বর্ণনা করেন যে, এ ব্যক্তির বর্ণনাকৃত হাদীস গ্রহনযোগ্য নয়। অপর একজন আসমায়ে রিজালের বিজ্ঞ ইমাম আবু ইয়ালী খলীলি (রহ) বর্ণনা করেন, এ বর্ণনাকারী অত্যন্ত দূর্বল, মাঝে মাঝে তার নিজেরই সন্দেহ সৃষ্টি হত। কখনো কখনো এমনও হাদীস বর্ণনা করতেন যা অন্য কারো নিকট ও তার কোন সন্ধান ছিল না। অপর বিজ্ঞ আলেম আল্লামা আবু যুরা’আহ (রহ) এ বর্ণনাকারীর হাদীস থেকে সকলকে বিরত থাকার জন্য প্রকাশ্যে ঘোষনা দিয়েছে। উল্ল্যেখিত হাদীসের অপর একজন বর্ণনাকারী ইয়াহইয়া ইবনে আ’লা যার সম্পর্কে ইমাম আহমেদ ইবনে হাম্বল (রহ) বলেন, এ লোকটি বড় মিথ্যাবাদী।

সে হাদীসকে মনগড়া ভাবে বর্ণনা করত। ইমাম ইবনে আদী (রহ) বর্ণনা করেন এ ব্যক্তির সমস্ত হাদীস মনগড়া, জাল ও ভিত্তিহীন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ) বলেন: অর্থ কিছূ সংখ্যক মানুষ যারা বর্ণনা করে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাবুক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন কালে বর্ণনা করেন- ‘আমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছি’। এই হাদীসের কোন ভিত্তি নেই। কোন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস এই হাদীসকে রাসূলের কথা বা কাজ হিসাবে উল্ল্যেখ করেননি।

কেননা কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই সবচেয়ে বড় আমল বরং মানুষ যত আমল করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে চায় জিহাদ তার মধ্যে সর্বোত্তম। আল্লাহ তা‘য়ালা ইরশাদ করেন: বসে থাকা মুমিনগণ, যারা ওযরগ্রস্ত নয় এবং নিজেদের জান ও মাল দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীগণ এক সমান নয়। নিজেদের জান ও মাল দ্বারা জিহাদকারীদের মর্যাদা আল্লাহ বসে থাকাদের উপর অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং আল্লাহ জিহাদকারীদেরকে বসে থাকাদের উপর অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর আল্লাহ প্রত্যেককেই কল্যাণের প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন এবং আল্লাহ জিহাদকারীদেরকে বসে থাকাদের উপর মহা পুরস্কার দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। (মাজমূউল ফাতাওয়া ১১ খন্ড ১৯৭ পৃষ্ঠা) ইবনে হাজার আসকালানী (রহ)ঃ প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামাহ ইবনে হাজার আসকালানী (রহ) তার কিতাব “ তাসদীদুল কাউস” নামক কিতাবে এ হাদীসের ব্যাপারে বলেন: এটা লোক মুখে প্রসিদ্ধ।

এটা ইবরাহী ইবনে আবি আ’বলাহ এর নিজের কথা ( কোন হাদীস নয়)। (আদ্দুরারুল মুনতাছির: ১/১১, আল আহাদীস লা তাসিহহু, ১/৫, কাশফুল খিফা ১/৪ ২৪)। আল্লামা তাহের আল হিন্দিঃ তিনি “তাযকেরাতুল মাউজুআত” নামক কিতাবে উল্লেখ করেন: ‘আমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করলাম’ এ হাদীসটির কোন ভিত্তি নেই। ( মিয়াতু হাদীস মিনাল আহাদীসিদ দয়িফা ১খন্ড ৪ পৃষ্ঠা) সুতরাং এই জাতীয় একটি ভিত্তিহীন, জাল হাদীস দ্বারা দলীল দিয়ে পীর-সূফীগণ মূলত: মুসলিম জাতিকে জিহাদ থেকে বিরত রেখে কাফের-মুশরিক, ইয়াহুদী-খৃষ্টান, হিন্দু-বৌদ্বসহ সকল কুফফারদেরকেই সাহায্য করে যাচ্ছে। নতুবা যে জিহাদ আল্লাহ নিজে করেছেন, ফেরেশতারা করেছেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন।

যে জিহাদ করতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহুদের যুদ্ধে দান্দান শহীদ করলেন। সত্তর জন সাহাবী শহীদ হলেন। হুনাইনের যুদ্ধে মাথা ভেঙ্গে রক্তাক্ত হলেন। বদরের যুদ্ধে চোঁদ্দজন সাহাবী শহীদ হলেন। যে যুদ্ধ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশী প্রিয়।

সেই যুদ্ধকে ছোট জিহাদ বলা আর নফসের জিহাদকে বড় জিহাদ বলা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে ধৃষ্টতা দেখানো ছাড়া আর কিছুই নয়। *** তাওহীদের মূল শিক্ষা***

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.