ওই যে বলে না--- দাগ থেকে যদি ভাল কিছু হয়, তবে দাগ ভাল। ঠিক সেই রকম, আমার আহাম্মকি থেকে যদি কৌতুকের জন্ম হয়, তবে আহাম্মকিই ভাল।
হেঁয়ালী না করে ব্যাপারটা খুলে বলি। আজকে আমাদের সবগুলো সেশন ছিল ফাইনাল কাট প্রো-এর উপরে। দশজনের মধ্যে সাতজনেরই এডিটিংয়ের অভিজ্ঞতা আছে এবং ওরা সাতজনই ঈর্ষণীয় একেকটা ম্যাক ল্যাপটপের মালিক।
তো, আমরা যারা এডিটিংয়ে এক্কবারে আনাড়ি তাদেরকে ওই সাতজনের সাথে একসাথে মিশিয়ে বসানো হল। আর আমাদের- মানে যাদের ম্যাক ল্যাপটপ নেই তাদের জন্য একটা করে আইম্যাক দেওয়া হল।
আমার পাশে বসল রিচার্ড। ছেলেটা জন্মসূত্রে আমেরিকান। কিন্তু থাইল্যাণ্ডে বড় হয়েছে বলে মন মানসিকতা এবং মূল্যবোধ এশিয়ানদের মত।
ও নিজেকে থাই হিসেবেই পরিচয় দেয়- যদিও থাই সরকারের চোখে সে নিছকই বিদেশী।
ওকে পাশে পেয়ে আমি খুশিই হলাম। কারণ ওর সাথে আমার খুব জমে। কিন্তু তখন কি আর জানি ও আজ আমার মান-সম্মান নিয়ে 'অপু দশ বিশ' খেলবে!
যাহোক, আমাদের কানেডিয়ান শিক্ষক বললেন, তিন চার লাইনের একটা স্ক্রিপ্ট দিয়ে ছোটখাট একটা মক শুটিং করে ফেলতে। ৩০ মিনিটের মধ্যে শুটিং শেষ করতে হবে।
রব নামের এক আমেরিকান এক পায়ে খাড়া হয়ে গেল পরিচালনা করার জন্য। কিন্ত এবারই বাধল আসল বিপত্তি। শিক্ষক শর্ত জুড়ে দিলেন। বললেন-এমন দুজনকে দিয়ে অভিনয় করাতে হবে যারা ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় যোগাযোগ করতে সক্ষম। আর সেই ভাষাটা হতে হবে পরিচালকের অজানা।
উনি দেখতে চান, অনুবাদকের উপর ভর করে পরিচালক Cross cultural situation মোকাবেলা করতে কতটা সক্ষম।
রব তো ভেবে পায় না, কাদের দিয়ে অভিনয় করাবে। ফস করে রিচার্ড বলে বসল, "শ্যামা আর ওয়াসিম। ওয়াসিম পাকিস্তানী, ও উর্দু বলে আর শ্যামাও ভালই উর্দু বোঝে। ওরাই অভিনয় করুক।
"
আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ছেলে মেয়েকে দিয়ে অভিনয় করালে নিশ্চয় রোমান্স করাবে! হ্যা, আমার আশঙ্কাই সত্যি হল। পরিচালক রব আমাকে সিন দুটো বুঝিয়ে দিল। হাত ধরাধরির কোন ব্যাপার নেই। কেবল দুই লাইন ডায়ালগ।
খুবই সিম্পল। তবু আমি এদের কী করে বোঝাব, আমি প্রাণ খুলে হাসতে পারি, মজা করতে পারি। কিন্তু আমি এসব পারি না! মানুষের সামনে অভিনয় করতে গেলে আমার ভীষণ আড়ষ্ট লাগে। কিন্তু এই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আপত্তি করলে ওরা সবাই হয়তো আমাকে খুব সংকীর্ণ ভাববে! আর রব এবং শিক্ষককে আমি খুব সম্মান করি। আমি ছাড়া আর কেউ তো উর্দু বা হিন্দি বুঝবে না।
চুপ করে বসে থাকলাম। সবাই মহাসমারোহে ক্যামেরা, বুম, লাইট সেট করতে শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎই রিচার্ড ভীড় ঠেলে এসে আমার পাশে বসল। ও বুঝে গেছে, খবর খারাপ! বলল, "Are you okay, Shyama?"
থমথমে মুখে বললাম, "No. It is not."
ও কী বলবে ভেবে না পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, "I'm such an idiot!"
ওর অনুতপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ওর অনুতাপে কোন খাদ নেই। হেসে বললাম, "ইয়েস, ইউ আর।
" ও হেসে উঠল। তারপর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল। একটু রব এসে আমার সাথে কথা বলল। আমাকে জিজ্ঞেস না করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দু:খ প্রকাশ করল।
কিন্তু প্যাচটা লাগল কাস্টিং নিয়ে।
মেয়েরা কেউই উর্দু বা হিন্দি পারে না। এখন ওদেরকে ডায়ালগ মুখস্থ করাতেই সময় পার হয়ে যাবে। কিন্তু রিচার্ড চাইছে না, চাপে পড়ে আমি আর এ ব্যাপারে মাথা গলাই। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ও বলে উঠল, "আরে বাদ দাও, আমিই পারব! মাত্র তো কয়টা লাইন। আমিই হব ওয়াসিমের প্রেমিকা্।
"
সবাই তো হা। কয়েকজন বলে উঠল, "তা কী করে হয়? একে তুই ছেলে, তার উপরে জীবনে কোনদিন উর্দু, হিন্দীর ধারেকাছে ছিলি না। "
ও কিন্তু সিরিয়াস। সোজা আমার পাশে এসে বসল। লাইনগুলো মুখস্থ করার চেষ্টা করল কিন্তু হিন্দী মুখস্থ করা কি চারটি খানি কথা? তাও আবার জিভ যদি হয় আমেরিকান! বুঝতেই পারছেন পাঠক, উচ্চারণের কী হাল হয়েছিল।
যাই হোক, ও ঠিক করল, ডায়ালগ লেখা নোটবুকটা হাতে নিয়েই অভিনয়। করবে।
শুটিংয়ের সময় সবাই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। নিজের দাড়িওয়াআলা মুখ নিয়ে এত সুন্দর করে ও মেয়ের গলা করছে যা আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারি নি, আর অঙ্গ ভঙ্গীও ভীষণ হাস্যকর। আমি লক্ষ্য করলাম, ও অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে, মজাও পাচ্ছে, কিন্তু লজ্জায় ওর পুরো মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে প্রতিটা ডায়ালগের পর।
শুটিং শেষে পরিচালক রব বলল, " আমার জীবনে দেখা সেরা দাড়িওয়ালা নায়িকা তুমি। "
প্যাক আপ হয়ে গেলে, ও আমার কাছ থেকে কলম চেয়ে নিয়ে আমার নোটবুকে কী যেন লিখতে লাগল। ওর মুখে চাপা হাসি।
নোটবুকটা ফিরে পেয়ে দেখলাম, তাতে লেখা-- "মনে রেখো, আজ রিচার্ড তোমার জীবন বাচিয়েছে। "
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।