থাইল্যাণ্ডে এসে প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছি সুইচে। আমাদের দেশে সুইচের নিচের অংশে চাপ দিয়ে অন করতে হয়। এদের দেশে উল্টো। আজ একমাস হয়ে গেল। হাত ক্রমশই অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও চোখ এখনো ধাক্বা খায় সুইচের এই উল্টো পজিশন দেখলে।
দিন গড়িয়ে মাস হলেও আমার থাই ভাষাজ্ঞান এখনো কয়েকটা বাক্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আসলে কোন থাইয়ের সাথে যোগাযোগ করার দরকার পড়ে নি তেমন। সারাদিন তো ট্রেনিংয়েই কেটে যায়। আর থাইরা তো কথা বলে না, রীতিমত গান গায়। সুর করে টেনে টেনে কথা বলে।
এবং এই টান আপনাকেও দিতে হবে। টান ছাড়া সমান্তরাল সুরে কথা বলে গেলে ওরা সেটা বুঝবে না। আপনি যদি ভুল জায়গায় ভুল টান দেন তাহলেই বিপদ। অর্থই বদলে যেতে পারে। তাই, ওসব ঝামেলায় জড়ানোর চেষ্টা করি নি।
ওদের ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।
বিপত্তিটা বাধে শখ করে কখনো রেস্টুরেণ্টে খেতে গেলে। খাবার অর্ডার করার সময় ছোটখাট একটা কমিক ফিল্ম হয়ে যায়। এই কয়দিনে আবিষ্কার করে ফেললাম, মূকাভিনয়ে আমাদের সবারই ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল। থাই ধ্বনি উৎপাদনে এক জিহ্বার নির্লজ্জ অক্ষমতার কারণে হাত, পা মাথা সহ গোটা শরীরটাকে এখন ঝাঁকাতে হচ্ছে।
যে কোন রেষ্টুরেণ্টে গিয়ে আমরা বিদেশীরা আগেই খাবারের ছবি খুঁজি। তারপর সেই ছবির উপরে হাত রেখে সেটা আনার ইশারা করি।
বেটারা এমন হাড় বজ্জাত! আমাদের সাথে নিজেরাও গা,মাথা দুলিয়ে গলদঘর্ম হবে যোগাযোগ করতে গিয়ে তবু দুই লাইন ইংরেজি শিখবে না। এমনকি চিকেন, বিফ জাতীয় শব্দগুলোও ওরা বোঝে না। চিকেন-এর থাই হল গাই।
গাই বললে বুঝবে কিন্তু চিকেন বলে মুখে ফেনা তুললেও কোন লাভ হবে না। ওদের ভাবটা এমন যে, তুমি আমার দেশে এসেছ, সুতরাং আমার ভাষা শিখে আমার সাথে কথা বলতে আস। ওদের এই মনোভাবের প্রশংসা করতাম যদি দেখতাম পোশাকে আশাকেও স্বকীয়তাটা ওরা ধরে রেখেছে। কিন্তু না। ভাষার ব্যাপারে এতখানি জাতীয়তাবাদী, ওদিকে পোশাকে ষোলআনা ওয়েস্টার্ন।
যাহোক, ওদের ভাষা না বোঝার জন্য কোন অনুতাপ এতদিন হয়নি। সগৌরবে একই রকম বীরদর্পে চলে এলাম হাত ইয়াই। আমাদের হোটেল থেকে মাত্র কয়েক পা হাটলেই সাগর।
প্রথম দিন হই হই করে সাগর দেখতে গেলাম। পথে পড়ল ছোট্ট একটা মুদি দোকান।
দোকানদার একটা মহিলা। বিকেল বেলা বলে দোকানের সামনে উচু একটা মাচার মত জায়গায় শুয়ে আছে, আর ছোট্ট একটা মেয়ে তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।
ভীষণ পরিচিত একটা দৃশ্য।
আমরা পাশ দিয়ে যেতেই শোয়া থেকে ওঠার ভঙ্গি করে হাসিমুখে মাথা নোয়াল।
ভীষণ পরিচিত হাসি।
আর একটু এগোতেই দেখি এক লুঙ্গিপরা কৃষক খালি গায়ে বসে সিগারেট টানছে।
ভীষণ পরিচিত ভঙ্গি। কেবল তার পাশের যে বাহনটা আছে, সেটা একটু অন্যরকম। শোলে সিনেমায় অমিতাভ বচ্চন আর ধর্মেন্দ্রর ‘ইয়ে দোস্তি নেহি তোড়েঙ্গ’ ধরণের একটা বাহন। ফসল এবং ওদের বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে চলাচলের জন্য জিনিসটা ভারি উপযোগী।
সাগরে যাওয়ার পুরোটা পথ ধরে নারিকেল গাছ আর কলা গাছ দেখতে পেলাম। রাস্তার ঝোপঝাড় আর গরুগুলোর সাথে বাংলাদশের প্রকৃতির কোন পার্থক্য দেখলাম না। পুরোটা পথ জুড়ে হাঁটতে গিয়ে একবারের জন্যও মনে হল না যে আমি বিদেশের পথ ধরে হাটছি।
পথে একটা ৫-৬ বছরের মেয়েকে দেখলাম দোকানের সামনে সাইকেল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। গায়ে স্কুল ড্রেস।
সাদা হাফ হাতা শার্ট, নেভি ব্লু স্কার্ট- আমাদের সেই চেনা ছোটবেলার অপ্রিয় পোশাক- অথচ এখন কারো পরণে ওই পোশাক দেখলে মনটা নস্টালজিক হয়ে যায়।
হোটেলে ফিরে এলাম। রাতে কাস্টিং করা হবে। তা্ই গ্রামবাসী দল বেধে এসেছে অডিশন দিতে। আমাদের জন্য নারিকেলের একরকম জুস বানিয়ে এনেছে।
ওরা নিজে হাতে আমাদের প্রত্যেকের হাতে তুলে দিচ্ছে সেই জুস।
ভীষণ পরিচিত আপ্যায়ন। সেই মুহুর্তে মনে হল, ভাষাটা ছাড়া ওদের সাথে আমার অন্তরের কোন বিভেদ নেই। আমার দলের অন্যরা আলাদা কারণ ওরা বেশিরভাগই এশিয়ার বাইরের। কিন্তু আমার সাথে এই গ্রামবাসীদের যেটুকু বিভেদ তা আরোপিত।
ওরা যে সরঞ্জামটা ব্যবহার করে সেটুকু আলাদা- শুধু সেটুকুই বিদেশী। কিন্তু ঈশ্বরের দেওয়া মন,হাসি আর অনুভূতির কোন দেশ, কাল সীমানা নেই- তা সর্বজনীন। প্রবীণ যে ভদ্রলোকটি টেবিলের ওপাশে বসে আমার হাতে ড্রিংকস তুলে দিলেন, তাকে বলতে ইচ্ছে হল—আপনি আমার গুরুজন। আপনি কেন এত ব্যস্ত হচ্ছেন? আমাদের বলুন কোথায় কী আছে। আমরা করব সব।
কিন্তু আমার অপদার্থ জিভ আমার অনুভূতির সাথে তাল মেলাতে অক্ষম। এই প্রথম অনুভব করলাম -ভাষা না শিখে আসাটা আসলে আমারই অন্যায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।