সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...
সহিংসতানির্ভর ঢাকাই চলচ্চিত্রের ন্যারেটিভকে ‘ধনীর বিরুদ্ধে গরিবের লড়াই’ বলা যেতে পারে। আপাতভাবে মনে হতে পারে এসব ছবির শ্রেণীচেতনা বেশ প্রখর, এবং বিস্তৃতরূপে চর্চিত -- যেহেতু বেশিরভাগ ছবির বিষয়বস্তুই সেই ধারায় নির্মিত। আর এই ধারা যে একেবারে সা¤প্রতিক, তা নয়। যখন ঢাকাই ছবি সহিংসতা-অশ্লীলতাবর্জিত ছিলো সেই ষাট-সত্তর-আশি দশকের ছবিতেও গরিব নায়কের সঙ্গে ধনীর দুলালী নায়িকা কিংবা রাজপুত্রের সঙ্গে বেদেনীকন্যার প্রেম দেখানো হতো এবং একে ঘিরেই যাবতীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি হতো। তবে তখনকার ছবিতে শ্রেণীবৈষম্য দেখানো হতো নারী-পুরুষের সম্পর্ককে ঘিরে এবং তাদের অবিচল-অটল প্রেমই শেষ পর্যন্ত জয়ী হতো।
আর এখনকার ছবিতে এই শ্রেণীদ্বন্দ্ব দেখানো হয় উচ্চকিত রাজনৈতিক ঘোষণার মাধ্যমে। তবে এখনকার কাহিনীতে ঘটনা একটাই -- গরীবের বন্ধু নায়ক বনাম গডফাদারসমষ্টি। নায়ক কখনও কলেজ-ছাত্র (দাঙ্গা, ত্রাস), কখনও বস্তিবাসী (বাঘের বাচ্চা) অথবা কখনও রবিনহুডের মতো ডাকাত, ধনীর কাছ থেকে লুণ্ঠনকৃত মালামাল গরিবের মাঝে বিলিয়ে দেয়াই যার কাজ (বিদ্রোহী সালাউদ্দিন)। আর ভিলেন-গডফাদার সাধারণত অন্যান্য ক্ষমতাধরদের (রাজনীতিবিদ, মন্দ পুলিশ) সহায়তা পেয়ে থাকে। শ্রেণীদ্বন্দ্বের আদর্শ প্লট!
কিন্তু এইসব ছবি দেখতে দেখতে সচেতন দর্শকের মনে হবে, হ্যাঁ শ্রেণীসংগ্রাম বটে, তবে বড়ো অচেনা, বড়ো একরৈখিক, অজটিল এবং অবাস্তবও।
সোভিয়েতপূর্ব সময় থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর নানা দেশে শ্রেণীসংগ্রামের যে-ইতিহাস তার কিছুর সঙ্গেই এই দ্বন্দ্ব মেলে না। তবে এধরনের অবাস্তব ন্যারেটিভ নির্মাণের উদ্দেশ্য কী, যৌক্তিকতা কোথায়? আমরা আরও খানিকটা নিঃসন্দেহ হবো যদি জানি যে এইসব ছবির পরিচালক-প্রযোজকদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই, কোনো বাম সংগঠনের সঙ্গে এরা কখনোই জড়িত ছিলো না, এবিষয়ে পড়াশুনা বা আগ্রহ আছে, এদের কেউ এরকমও কখনও প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। প্রসঙ্গত, এই অধ্যায়টির আদি খসড়া একটি সম্মেলনে প্রবন্ধ আকারে উপস্থাপিত হয়েছিলো এবং সেই সম্মেলনে এধরনের ছবির প্রবক্তা কাজী হায়াৎ দাবি করেছিলেন, সমাজের এত এত অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করেনা, আমার নায়ক করে।
এখন দু’টি বিষয় সামনে আসছে, এসব ছবি কেন নির্মাণ করা হয়, এবং এই প্রতিবাদের চূড়ান্ত অর্থ কী দাঁড়ায়? একথা অনস্বীকার্য যে বাংলা ছবির দর্শকের একটা বিরাট অংশই শ্রমজীবী শ্রেণী এবং বর্তমানে তারাই দর্শক হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। নায়ককে গরিবের বন্ধু পরিচয় দেবার মাধ্যমে আসলে এই দর্শকশ্রেণীর প্রাথমিক সহানুভূতি আদায় করা হয়।
আর শিা, শ্রেণী-অবস্থান ইত্যাদি কারণে চলচ্চিত্রের মতো জটিল ও আধুনিক মাধ্যমের অর্থবিশ্লেষণের ক্ষমতা যেহেতু তাদের থাকে না, তাই এই প্রাথমিক সহানুভূতি বা আত্মপরিচয় দর্শককে আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট হয়। এরপর স্থূল যৌনতা বা বীভৎস ভায়োলেন্স তাদের পয়সা উসুল করবে বলে মনে করা হয়। আর যে-প্রতিবাদ একা-নায়ক করে, এই প্রতিবাদ বাস্তবতা থেকে যোজন দূরে অবস্থান করে। যে-পদ্ধতিতে নায়ক প্রতিবাদ করে থাকে তা এতটাই বাস্তবতাবিবর্জিত যে তা দর্শকের মনে এরকম ভ্রান্ত ধারণাও তৈরি করে যে, কেবল সুপারহিরো হওয়া ছাড়া সমাজ থেকে অবিচার দূর করা সম্ভব নয়। তাই প্রতিটি মানুষের মনের হিরো হবার বাসনার ক্যাথারসিস ঘটাতে গিয়ে আসলে এসব ছবির সুপার হিরোরা সমাজের প্রকৃত হিরো সৃষ্টি হবার সম্ভবনাগুলোকে কমিয়ে দেয়।
শ্রেণীসংগ্রাম সম্পর্কে বরং এসব ছবি ভ্রান্ত ধারণা দেয়, লড়াইয়ের যে-পদ্ধতির কোনো অস্তিত্ব নেই, কখনো ছিলো না -- তাকে সমাধান হিসেবে হাজির করে। প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর যেক্ষেত্রে একত্রিত হবার কথা, শ্রেণীশত্র“কে মোকাবেলা করার জন্য, এখানে সেরকম কোনো সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়াই সবকিছু সমাধানের জন্য একা নায়ককে দায়িত্ব দেয়া হয়।
বাংলা ছবির শ্রেণীচেতনা তাই ভুয়া, অসার, অবাস্তব; প্রকৃত শ্রেণীচেতনা বিকাশের প্রতিকূলে তা কাজ করে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।