খেয়াল করেছেন নিশ্চয়, যতবারই আপনার মনে পড়েছে যে আপনার দাদার দাদার বাবা প্রায়ই আলীবর্দি খাঁয়ের কাছ থেকে ডিনারের দাওয়াত পেতেন, অথবা আপনাদের বাসায় রবীন্দ্রনাথের গা ঘেঁসে বসা আপনার দাদার একখানা বাঁধাই করা ফটোগ্রাফ দেয়ালে ঝুলছে ততবারই আপনার শিনাটা কেমন ফুলে ফেঁপে উঠে সার্টের বোতাম ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। অথবা যখনই কেউ আপনার দিকে আঙ্গুল তুলে বলেছে, “তুমি অমুক প্রিন্সিপালের ছেলে না?” তখনই কি আপনার মনে হয়নি, ইস আকামটা না করলেই পারতাম। আসলে আমরা কে কোন অতীতকে উত্তরাধিকার সূত্রে ধারণ করছি, সাদা বাংলায় আমাদের বংশ পরিচয় কি, এটা নিজেদের অজান্তেই আমাদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে। তাই ঢাকাই সিনেমার বর্তমান সেনসেশন অনন্ত জলিলের কর্মকান্ড ও এফডিসির বর্তমান এমডির এদেশে কোন ভাল সিনেমাই নেই জাতীয় দাবীর প্রেক্ষিতে ইতিহাসের মত রসকষহীন অথচ গুরত্বপূর্ণ এই বিষয়টির অবতারনা। দেখা যাক এটা পড়ে কারো সার্টের বোতাম ছিঁড়ে কিনা?
১৮৯৫- (২৮ ডিসেম্বর) বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র প্রর্দশনী হয়।
স্থানঃ প্যারিস, ফ্রান্স। র্নিমাতা লুমিয়ের ব্রাদার্স। এটি কোন কাহিনি চিত্র ছিল না। অনেকটা ডকুমেন্টারীর মত কিছু খন্ড চিত্র ছিল।
১৮৯৬- (ফেব্রুয়ারী) একই ছবির প্রর্দশনী।
স্থানঃ লন্ডন।
১৮৯৬- (৭ জুলাই) অবিভক্ত ভারতে প্রথম চলচ্চিত্র প্রর্দশনী হয়। স্থানঃ ওয়ার্ডসন হোটেল, বোম্বে। ভারত সম্ভবতঃ বিশ্বের ৩য় রাষ্ট্র যেখানে এই চলচ্চিত্রগুলোর প্রর্দশনীর ব্যবস্থা হয়।
১৮৯৬- (নভেম্বর/ডিসেম্বর) অবিভক্ত বাংলায় প্রথম চলচ্চিত্র প্রর্দশনী হয়।
স্থানঃ স্টার থিয়েটার, হাতিবাগান, কলকাতা। ইংরেজরা এই দেশে আসার পরে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে কোলকাতায় স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে ঢাকার গুরুত্ব কমে যায় ও কোলকাতা বাংলার প্রাণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। অতএব তর্কের খাতিরে এটুকু বোধহয় ধরে নেয়া যেতেই পারে যে বাংলার রাজধানী স্থানান্তরিত না হলে এই প্রর্দশনীটি ঢাকাতেই হত।
১৮৯৮- (৪ এপ্রিল) অবিভক্ত ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র র্নিমান প্রতিষ্ঠান “রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানী” প্রতিষ্ঠা করেন মানিকগঞ্জের বগজুরি গ্রামের হীরা লাল সেন। সে সময় বাংলায় স্টিল ফটোগ্রাফীর ব্যাপক বিকাশ ঘটেছিল।
ঢাকায় হীরালালের ফটো বাঁধাইয়ের একটা দোকান ছিল (১৮৬৪ সন)। পরে তিনি ও তার ভাই মতিলাল মিলে নিজের গ্রামের বাড়িতেও একটা ফটো স্টুডিও স্থাপন করেন (১৮৯০)।
১৮৯৮- (১৭ এপ্রিল) বাংলাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র প্রর্দশনী হয়। স্থানঃ ক্রাউন থিয়েটার, ঢাকা। আয়োজকঃ হীরালাল সেনের রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানী।
১৯০১- (৯ ফেব্রুয়ারী) হীরালাল সেন র্নিমিত প্রথম চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শনী। স্থানঃ ক্লাসিক থিয়েটার কোলকাতা। এটিও কাহিনী চিত্র ছিল না। মঞ্চ নাটকের কিছু দৃশ্য তিনি ধারণ করেন। পরে তিনি আরো অনেক চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বিজ্ঞাপন চিত্রও র্নিমান করেন।
তিনি এই উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপন চিত্র র্নিমাতা। তার ভাগ্নে ভোলানাথ গুপ্তকে তিনি চলচ্চিত্র সংক্রান্ত যন্ত্রপাতির ব্যবহার শেখান। ভোলানাথ এদেশের প্রথম বাঙ্গালী সিনেমা অপারেটর।
এরপর থেকে ১ম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত অবিভক্ত ভারতে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও র্নিমানের ব্যবসা বেশ জমে ওঠে। যুদ্ধের কারণে তাতে কিছুটা ভাটা পড়লেও যুদ্ধের পরে এই শিল্পটিতে নুতন মাত্রা যুক্ত হয়।
শুরু হয় পূর্ন দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের যুগ।
১৯১৯- (৮ নভেম্বর) মুক্তি পায় র্পূনাঙ্গ র্নিবাক বাংলা চলচ্চিত্র ‘বিল্বমঙ্গল’। স্থানঃ কলকাতা।
১৯২১- (২৬ ফেব্রুয়ারী) বাংগালী মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত ২য় প্রতিষ্ঠান “ইনডো ব্রিটিশ ফিল্ম কোম্পানী” থেকে মুক্তি পায় পূর্নাঙ্গ চলচ্চিত্র ‘বিলেত ফেরত’। স্থানঃ কলকাতা।
সিনেমাটির কাহিনীকার, পরিচালক ও নায়ক বরিশালের ধীরেন্দ্র নাথ গাঙ্গুলী। এই ছবির সমস্ত পাত্র পাত্রী বাংগালী ছিল। সে সময় ছেলেরা মেয়ে চরিত্রে অভিনয় করত। কিন্তু এই সিনেমায় নায়িকা চরিত্রে মেয়ে শিল্পী অভিনয় করে। মেয়ে অভিনেত্রীদের সিনেমায় আনার ব্যাপারে ধীরেন্দ্র নাথ গাঙ্গুলী যুগান্তকারী ভুমিকা পালন করেন।
তিনি অন্যান্য মেয়েদের উৎসাহীত করার জন্যে প্রথমে নিজের স্ত্রীকে ও পরে মেয়েকেও সিনেমায় নিয়ে আসেন। তার র্নিমিত ছবি সংখ্যা প্রায় ৫০টি। ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম যুগের অন্যতম প্রাণ পুরুষ প্রমথেশ বড়ুয়া তার শিষ্য ছিল। ধীরেন্দ্র নাথ গাঙ্গুলীর কার্যক্রম কোলকাতা ভিত্তিক ছিল।
১৯২৫/২৬- (আনুমানিক- আমার কাছে সঠিক তথ্য নেই) সবাক চলচ্চিত্র র্নিমানের প্রযুক্তি আবিস্কৃত হয়।
১৯২৭/২৮- (আনুমানিক-সঠিক তথ্যটি সংরক্ষিত হয়নি) নবাব পরিবারের খাজা আজমলের চিত্রগ্রহণে ও অম্বুজ গুপ্তের পরিচালনায় ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্রের নাম “কুসুম কুমারী”। ৩/৪ রিলের এই ছবিটি ছিল পরীক্ষামূলক একটি প্রয়াশ যার পর্দশনী শুধু মাত্র নবাব পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এটি র্নিবাক ছবি ছিল। এবং নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন খাজা আদেল।
১৯২৯-(অক্টোবর) বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র “দ্য লাস্ট কিস” এর সুটিং শুরু হয়।
এটিও র্নিবাক চলচ্চিত্র ছিল। এক বছর ধরে এটার র্নিমানের কাজ চলে। এখানে নায়িকা হিসাবে মেয়েদের ব্যবহার করা হয়। নায়িকা লোলিটা (আসল নাম বুড়ি)কে পতিতালয় থেকে সংগ্রহ করা হয়। অন্য দুই অভিনেত্রী দেব বালা ও হরিমতিকেও পতিতালয় থেকে আনা হয়।
সে সময় থিয়েটারে যে সমস্ত মেয়েরা অভিনয় করত তারাও পতিতালয় থেকেই আসত। এই তিন নারীকে পরে আর কোন সিনেমায় দেখা যায়নি। ছবির পরিচালক-অম্বুজ গুপ্ত, ক্যামেরাম্যন-খাজা আজমল, সহকারী ক্যামেরাম্যান-খাজা জহির, নায়ক-খাজা আজমল। সম্পাদনা- অম্বুজ গুপ্ত ও খাজা আজমল। সম্পাদনা কোলকাতায় করা হয়।
সুটিং করা হয় মতিঝিলের দিলকুশা গার্ডেন, শাহবাগ ও নীলক্ষেত বাগিচা এলাকায়। ১২ রিলের এই ছবিটি বানাতে খরচ হয় ১২,০০০ টাকা। বাংলা ইংলিশ ও উর্দুতে ছবিটির সাব টাইটেল করা হয়।
১৯৩১- (১৪ মার্চ) অবিভক্ত ভারতের প্রথম টকি(সবাক) চলচ্চিত্র “আলম আরা” মুক্তি পায়। স্থানঃ ম্যাজেস্টিক সিনেমা, বোম্বে।
সিনেমাটি ভাষা ছিল হিন্দিও পার্সী মেশানো উর্দু।
১৯৩১- (১১ এপ্রিল) প্রথম সবাক বাংলা চলচ্চিত্র “জামাই ষষ্ঠি” মুক্তি পায়। স্থানঃ ক্রাউন সিনেমা, কোলকাতা। ১৯৩৪ সালের পরে আর কোন র্নিবাক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি।
১৯৩১- (শেষের দিকে, সঠিক তারিখ সংরক্ষিত নেই) বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র “দ্য লাস্ট কিস” এর প্রর্দশনী চলে পুরো এক মাস ধরে।
স্থানঃ মুকুল (বর্তমানে আজাদ) সিনেমা হল, ঢাকা। ছবিটির একটি মাত্র প্রিন্ট করা হয়েছিল। আরো কিছু কপি বানানোর জন্যে আহসান মঞ্জিলের সৈয়দ সাহেবে আলম কোলকাতার অরোরা ফিল্ম কোম্পানীর কাছে যান। অরোরা কোম্পানী কৌশলে মাত্র ১ হাজার টাকায় সেই এক মাত্র প্রিন্টটি কিনে নেন। তারপর এই ছবির আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এমন কি এই ছবির কোন ফটোগ্রাফ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। ছবির কাহিনী- দুটি পরিবারের মাঝে সখ্যতা গড়ে ওঠে। বিভিন্ন ঘটনার এক পর্যায়ে পরিবার দুটির মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে। এসময় দুই পরিবারের দুই শিশু পরস্পরকে চুমু দিয়ে বিদায় জানায়। আর একারনেই ছবির নাম “দ্য লাস্ট কিস”।
১৯৩৪- (১ জানুয়ারী) কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম বাংগালী মুসলমান পরিচালক হিসাবে আত্ম প্রকাশ করেন। নজরুল ও সত্যেন্দ্রনাথ দে-র যৌথ ভাবে পরিচালিত ছবিটির নাম “ধ্রুব”। এই ছবিতে নজরুল সুরকার গায়ক ও অভিনেতা হিসেবেও কাজ করেন।
১৯৪১- সিনেমা কোম্পানী “বেঙ্গল টাইগার পিকচার” প্রতিষ্ঠিত হয়। শেরে বাংলার নাম অনুসারে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানীটি গঠনে মূখ্য উদ্যেক্তা ছিলেন আব্বাস উদ্দীন আহমেদ, কাজী নজরুল ইসলাম ও আরো কয়েকজন।
১৯৪৫- নির্মিত হয় “দুঃখে যাদের জীবন গড়া”। বাংলাদেশ অবজারভারের সম্পাদক ওবায়েদ-উল-হক ছিলেন এই সিনেমার র্নিমাতা। সেই হিসাবে তিনিই প্রথম একক বাংগালী মুসলমান পরিচালক। তার জন্ম স্থান ফেনী জেলায়। এই ছবিতে সুরকার ছিলেন আব্দুল আহাদ (প্রথম বাঙগালী মুসলমান সুরকার)।
১৯৪৬- (২০ ডিসেম্বর) “দুঃখে যাদের জীবন গড়া” মুক্তি পায়। তবে মাত্র ঘটে যাওয়া সম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে পরিবেশকরা কোন মুসলমানের ছবি রিলিজ করতে রাজী না হওয়ায় পরিচলক ও প্রযোজক ওবায়েদ-উল-হক ছদ্ম নাম গ্রহন করেন হিমাদ্রী চৌধুরী। এবং অভিনেতা ফতে লোহানীর নাম হয় কিরণ কুমার।
১৯৫৬- বাংলাদেশের প্রথম সবাক ও পূর্ণ দৈর্ঘ চলচ্চিত্র “মুখ ও মুখোশ” নির্মিত হয়। নির্মাতাঃ আব্দুল জব্বার খান।
নাজির আহমেদ ও আব্দুল জব্বার খান দুজনেই মুখ ও মুখোশের আগে বেশ কিছু ডকুমেন্টারী ও স্বল্প র্দৈঘ্য সবাক সিনেমা বানালেও পূর্নদৈর্ঘ সবাক সিনেমা এটাই প্রথম।
দেশ বিভাগের পরে লাহোর হয়ে ওঠে পাকিস্থানের সিনেমার কেন্দ্রবিন্দু। এবং বলা হয় বাংলাদেশ সিনেমা বানানোর উপযোগী নয়। অনেকটা চ্যালেঞ্জ হিসেবেই আব্দুল জব্বার খান এই সিনেমা বানানোর উদ্যোগ নেন। এই ছবিটি র্নিমানের পরই ঢাকায় সরকারী ভাবে চলচ্চিত্রে পৃষ্ঠপোষকতার দাবী ওঠে।
যার ফলশ্রুতিতে নির্মিত হয় বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভলপমেন্ট করপোরেশন বা বি এফ ডি সি, সংক্ষেপে এফ ডি সি। শুনেছি এফ ডি সি যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন যে সমস্ত যন্ত্রপাতি এই প্রতিষ্ঠানটির জন্যে কেনা হয় তা তৎকালীন বোম্বে ফিল্ম ইনডাস্ট্রিতেও ছিল না। তারপরের ঘটনা আপনারা মোটামোটি সবাই জানেন।
সত্যজিৎ রায় ও বোম্বে সিনেমার সুরের দিকপাল এস ডি বর্মন বা শচিন দেব র্বমনের শেকড় এই বাংলাদেশেই। যারা এসডি বর্মনের গান শুনেছেন তারা নিশ্চয় খেয়াল করেছেন তার গানে আমাদের ভাটিয়ালী সুরের ছোঁয়া রয়েছে।
কারো শার্টের বোতাম ছিঁড়েছে কি?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।