আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভালোবাসা আজকাল : ঢাকাই ট্যাঙ্গেলড

‘ভালোবাসা আজকাল’-এর প্রযোজক ও পরিবেশক জাজ মাল্টিমিডিয়া। কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেছেন পি এ কাজল। সংলাপ আবদুল্লাহ জহির বাবু। সংগীত পরিচালনা করেছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, ইমন সাহা, ফুয়াদ ও শফিক তুহিন। আবহ সংগীত করেছেন ইমন সাহা।


চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছে ৯ অগাস্ট। ১৪২ মিনিটের ছবিটির শুটিং হয়েছে সিলেট, বান্দরবানের নীলগিরি, নীলাচল ও মেঘলাসহ বিভিন্ন লোকেশনে।

সিনেমাতে নায়ক-নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাকিব খান-মাহিয়া মাহী; নায়ক-নায়িকা চরিত্রদ্বয়ের নাম যথাক্রমে রানা ও ডানা। অন্যান্য চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন, তাদের মধ্যে আছেন-- মিশা সওদাগর, আলীরাজ, কাবিলা, সুব্রত, জামিল, রেহানা জলি, সানু শিবা, রেবেকা, গুলশান আরা, কালা আজিজ প্রমুখ।
চলচ্চিত্রটির নাম ‘ভালোবাসা আজকাল’ বটে, কিন্তু এই ‘আজকাল’-এর সময়কাল যে কবেকার, তা তর্কসাপেক্ষ।

আজকালও যে মায়ের মাথায় হাত দিয়ে করানো প্রতিজ্ঞার জেরে এতকিছু করিয়ে নেওয়া যায়, তা জানলে আজকালকার অপরাধীদের কাজকারবার অনেক সহজ হয়ে যেত। আর আজকালকার ভালোবাসা বলতে যেসব অনুষঙ্গের কথা সবার মাথায় আসে, অন্তত মোবাইল-ইন্টারনেট, সেগুলোও সম্পূর্ণরূপেই ছবিতে অনুপস্থিত। একটু ভেবে চলচ্চিত্রটির অন্য কোনো নামও চিন্তা করা যেত।
‘টাইটেল’ অংশটি, অর্থাৎ শুরুতে কলাকুশলী ও সিনেমার নাম প্রদর্শিত হয় যে অংশে, তাও যুৎসই হয়নি। এই অংশে কিছু বানান-বিভ্রাট বেশ দৃষ্টিকটু।



‘ভালোবাসা আজকাল’-এর কাহিনিতে খানিকটা নতুনত্ব আছে স্বীকার করতেই হবে; তবে তা ভাবগত অর্থে নয়। কাহিনির প্যাটার্ন-ধরন না পাল্টে কেবল প্রেমে পড়ার উপায়, নায়ক-নায়িকার আবাস, বিরল দূরারোগ্য ব্যাধি সংযোজন প্রভৃতিকে যদি কাহিনিতে নতুনত্ব আনয়ন বলা হয়, তবে কাহিনিতে নতুনত্ব এসেছে বলা যেতেই পারে।
তবে বাংলা চলচ্চিত্রের কাহিনিতে নতুনত্ব লাগবে বলে অনেক দিন ধরেই যে রব চলছে, সে নতুনত্ব সম্ভবত এই নতুনত্ব নয়। একই কাহিনিতে কিছু রোমান্স, কিছু অ্যাকশন, কিছু ট্র্যাজেডি, কিছু আবেগ, কিছু গোঁজামিল প্রভৃতি মিশিয়ে ‘সামাজিক ছবি’ বানানোর ইতি ঘটানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
কাহিনিতে শাকিবের আবির্ভাব বেশ আকর্ষণীয়, নতুনত্বেও ভাস্বর।

প্রথমে শাকিবের শরীরের যে অংশটি দেখা যায়, তা হল তার পদযুগল, দৌড়ে যাচ্ছে। পিছে আরও কয়েক যুগল পদ, তাড়া করছে। না, তাড়া করা পদযুগলগুলো দুশমনদের নয়; গ্রামের মেয়েদের। শাকিবের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে গ্রামের মেয়েরা সারাদিন তাড়া করে বেড়ায় শাকিবকে; শাকিব পালিয়ে পালিয়ে বেড়ান। এমনকি শাকিব মেয়েদের জ্বালায় পড়াশোনাও শেষ করতে পারেননি।

শাকিবের এই আবির্ভাবনামা আকর্ষণীয় হলেও, তা একটু বেশিই স্থূল হয়ে গেল কিনা, একটু বিবেচনা করা উচিত ছিল।
কাহিনির বেশ কিছু ঘটনা আবার জার্মান লোককাহিনি ‘রাপুনজেল’-এর কথাও মনে করিয়ে দেয়; সম্প্রতি যে কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয়েছে ডিজনির চমৎকার অ্যানিমেডেট চলচ্চিত্র ‘ট্যাঙ্গেলড’। নায়িকার একটি ঘরে গৃহবন্দি থাকা, আঠার বছর হলে বাবার বাংলাদেশে আসতে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা ও প্রতিজ্ঞাভঙ্গ, স্বপ্নপূরণে পালিয়ে আসা, স্বপ্নপূরণের পথে ঘটনাচক্রে অপরাধী নায়কের সাক্ষাৎ ও সহায়তা লাভ, পুরস্কারের লোভে ট্রাকচালকদের নায়ক-নায়িকাকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে যাওয়া ও পরে নায়িকার স্বপ্নের কথা শুনে উল্টো সহায়তা করা, স্বপ্নের বাড়িতে গিয়ে নায়িকার আবিষ্কার করা যে উত্তরাধিকারসূত্রে বাড়িটি তারই-- কাহিনির এমনি অনেক অংশ ধারাবাহিকভাবেই মিলে যায় ট্যাঙ্গেলড-এর সঙ্গে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, পুরো বিষয়টি কাকতালীয় হোক না হোক, তার যে এক রকম দেশীয় রূপান্তর ঘটানো হয়েছে, তা সত্য; এবং রূপান্তরটি সম্পূর্ণ দুর্বলও হয়নি (কিছু অংশের রূপান্তর অবশ্য ভীষণ দুর্বল)। তবে কাহিনির চূড়ান্ত প্যাঁচটি পি এ কাজল ভালোই কষেছেন।



সিনেমার কাহিনিতে কিছু নাটকীয়তা থাকেই। ‘ভালোবাসা আজকাল’-এর এই নাটকীয় পর্যায়ের অনেকগুলোই পরিচালক প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। বিশেষ করে ট্রাকস্ট্যান্ডে সুন্দরী নায়িকার দুটো গদগদ কথাতেই ট্রাকচালক-হেল্পার-শ্রমিকদের তিরিশ লাখ টাকার ইনাম ভুলে, রীতিমতো মারামারি করে তাদের ‘বোন’-এর স্বপ্নপূরণে ঝাঁপিয়ে পড়াটা নিতান্ত বাতুলতা।
শুধু তাই নয়, পরে আবার তারা সেই দুটো গদগদ কথা মনে রেখেই পুলিশ ঠেকাতে নকল আন্দোলনও করে ফেলে! অবশ্য পুলিশ ঠেকাতে নকল আন্দোলনের ভাবনাটা বেশ নতুন, উপভোগ্যও বটে।
একই ব্যর্থতা মায়ের মৃত্যুসংবাদ প্রাপ্তির সিকোয়েন্সেও।

এমনকি দুঃস্বপ্ন দেখে হঠাৎ এক দৌড়ে দুর্গম পাহাড় থেকে নায়কের সমতলে অবস্থিত নিজগ্রামে পৌঁছানোটাও একটু অবাস্তব বলেই বোধ হয়। এমনি বেশ কিছু জায়গায় কাহিনি-সংলাপের যৌথ দুর্বলতা এবং তা ঢেকে দিতে পরিচালকের কুশলতার অভাব দর্শককে পীড়া দিতে পারে।
সিনেমার লোকেশন নির্বাচনও বেশ অদ্ভুত; বান্দরবানের পাহাড়, পাহাড়ি জঙ্গল কেন সিনেমার লোকেশন হল তা বোধগম্য নয়। কাহিনিতে এখানে পাহাড়ের কোনোই প্রয়োজন নেই।
বিশেষত, বান্দরবানের পাহাড়ি জঙ্গলে এক বাঙালির জমিদারবাড়ি থাকাটা এক রকম অসম্ভব কল্পনাই বটে।

এর বাইরে সিনেমার আখ্যানেও এমন কোনো উপাদান নেই, যার জন্য লোকেশন হিসেবে বান্দরবান বেছে নিতে হবে; তবে উল্টোটা আছে। বান্দরবানের সপক্ষে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়; কবিরাজ পিতার উত্তরাধিকারসূত্রে-প্রাপ্ত জ্ঞানের ব্যবহারের মাধ্যমে শাকিব কর্তৃক মাহীর দূরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা করা। তবে সে পাতা যে কেবল বান্দরবানের পাহাড়ি জঙ্গলেই পাওয়া যেতে হবে, তাও নয়; সে পাতা বাংলাদেশের যে কোনো জঙ্গলেই পাওয়া যেতে পারে। আর সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হল, বান্দরবান দেখিয়ে সেখানে কেবল বাঙালি দেখানো শুধু সত্যের অপলাপই নয়, বড়সড় একটি রাজনৈতিক ভণ্ডামিও বটে। সিনেমার লোকেশন নির্বাচনে পি এ কাজলের মতো একজন পুরনো পরিচালকের কাছ থেকে আরও একটু সতর্কতা প্রার্থনীয় ছিল।



নায়ক চরিত্রে শাকিব খানের অভিনয় এক রকম উৎরে গেছে। ‘শাকিব খানীয়’ স্টাইল বিদ্যমান বটে; তবে তার ভক্তকুল বিবেচনায় তাও দরকার। দর্শক-প্রতিক্রিয়াই তার যথার্থতা প্রমাণ করে। নায়িকা চরিত্রে মাহিয়া মাহীর অভিনয়ও মন্দ হয়নি। তবে, আদুরে মেয়ের ন্যাকামি করতে গিয়ে ন্যাকামোটা বোধহয় একটু বেশিই হয়ে গেছে।

মামা চরিত্রে কাবিলা তার গতানুগতিক অভিনয়ই করেছেন। অল্প সময়ে মীরাক্কেলের জামিল (বিতর্কিত জামিল নয়, তার আগের এপিসোডের প্রতিযোগী) খারাপ করেননি। সব মিলিয়ে বাংলা সিনেমার প্রচলিত ধারার গতানুগতিক অভিনয়ের ধারাটি রক্ষিত হয়েছে।
সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্যগুলোর রূপায়ন বেশ ভালো হয়েছে। কেবল চ‚ড়ান্ত লড়াইয়ে শাকিব যে দুশমনদের কুড়ুল দিয়ে সমানে কোপালেন, সেই কোপগুলো সব দুশমনের শরীরের একই জায়গায় লাগাটা একটু বেশি কাকতালীয় হয়ে যায়।

তবে কোপাকুপিতে কোনো প্রাণনাশ না ঘটিয়ে ‘মানবিকতা’ রক্ষা করায় পরিচালককে ধন্যবাদ।
সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফি চলনসই। আর্ট ডিরেকশনও গতানুগতিক। ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য কস্টিউম ডিজাইনারের ছোট্ট ধন্যবাদ পাওনা। তবে নায়িকার পোশাকে গোলাপির আধিক্য আকর্ষণীয় হলেও, নায়কের পোশাকে ও সেটে হলুদের আধিক্য একটু চোখে লাগে।


সিনেমায় ব্যবহৃত গান পাঁচটি চলনসই। সিনেমার শুরুতেই চটুল ‘মামু ভাইগ্না গুডলাক’ গানটি বেশ উপভোগ্য, কোরিওগ্রাফিও বেশ ভালো। বাকি চারটি গান অবশ্য গড়পরতা। গানগুলোর কোরিওগ্রাফিও তাই।
ইন্ডাস্ট্রিতে সিনেমার চূড়ান্ত যোগ্যতা ব্যবসাসফল হওয়া।

‘ভালোবাসা আজকাল’ ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র হওয়ার পথেই আছে। চলচ্চিত্রটি ব্যবসাসফল হোক, জাজ আরও ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র প্রযোজনা করুক, তা দেশীয় চলচ্চিত্রের সকল শুভাকাক্সক্ষীরই কাম্য। সঙ্গে এও মনে রাখা জরুরি, কেবল ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র দিয়েই আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নতি হবে না। চলচ্চিত্রের মানও অনেক উন্নত করতে হবে। এ দুয়ের মেলবন্ধনই আসলে চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য প্রয়োজন; বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের তো খুবই প্রয়োজন।


সোর্স: http://bangla.bdnews24.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.