জাদুনগরের কড়চা
১
মামু, অর্থাৎ আইন-শৃংখলা রক্ষী পুলিশ বাহিনীর সম্পর্কে বাঙালি হওয়ার সুবাদে মনে মনে একটা ভীতি জন্মগত ভাবেই প্রোথিত হয়ে গেছে ... তাই নীল-জামা, কালো-জামা দেখলেই একটু আঁতকে উঠে ভিজা বিড়াল সেজে রই। এহেন এই মামুর সংস্পর্শে দেশে পড়তে হয়নি বেশি, একবার এরশাদ মিঞার লটবহরের গার্ডের তাড়া খাওয়া বাদে।
তবে চোরের দশদিন, গৃহস্তের/মামুর শেষদিন। কপালে সেই মামুদের মুখোমুখি হওয়া লেখা ছিলো, বিদেশ বিভুঁইয়ে এসেই তা হতে হলো। তাও আবার পিস্তল হাতে রীতিমত ধাওয়া।
নাহ, ভিজা বেড়ালের মতো শান্ত-শিষ্ট লেজ-বিশিষ্ট এখানেও আমি, তবে ধাওয়া খাওয়ার কাহিনীটাও বিচিত্র। সদ্য দেশ থেকে এসে তখন ক্যাম্পাসের মধ্যে এক দেশী আর এক পাকির সাথে বাসা ভাড়া নিয়েছি। গাড়ি-টাড়ি কিছুই নাই, চলা ফেরার জন্য কিনলাম এক সাইকেল। কিন্তু যেই বান্দার কাছ থেকে কেনা, আমাকে আবুল পেয়ে ধরিয়ে দিলো এক রদ্দি মার্কা মাউন্টেইন বাইক। মাস দুয়েকের মধ্যে চাকার টিউবের রফাদফা।
দেশে থাকতেও আমার সাইকেল ছিলো, কিন্তু দেশের মতো মোড়ে মোড়ে তো আর সাইকেলের চাকা মেরামতের দোকান আর ৫টাকায় পাংচার মেরামত করা পিচ্চি নাই। নিজে মেরামত করতে গিয়ে ধরা খেয়ে তাই বিরক্ত হয়ে পেছনের চাকাটা খুলে নিয়ে মাইলখানেক হেঁটে সাইকেল বিক্রির দোকানে নিয়ে ঠিক করালাম।
মার্চ মাস ... স্প্রিং ব্রেক এর বন্ধ ... ক্যাম্পাসের সব চ্যাংড়া পোলাপাইন ফুর্তি করতে বীচ টাইপের জায়গায় কেটে পড়েছে। বিদেশ থেকে আসা "খ্যাত" গ্র্যাড স্টুডেন্টরাই পড়ে আছে ... সেই তালিকায় নাম লেখানো আমি চাকা ঘাড়ে করে বাসায় ফিরে, অ্যাপার্টমেন্টের বাইরের রাস্তায় বসে সাইকেলে চাকা ফিট করা শুরু করলাম। খোলা যতটা সহজ, লাগানো ততোটা না, তাই প্লায়ার্স আর রেঞ্চ হাতে প্যাঁচ দিতে দিতে নাভিশ্বাস উঠার দশা।
এমন করে চাকায় প্যাঁচ মারতে কখন আমি ব্যস্ত, সামনে কার যেনো ছায়া পড়লো। ফিরে তাকিয়ে তো হার্টফেলের দশা ... রীতিমতো পিস্তল হাতে RAB স্টাইলে পোজ মেরে এক কালো-পোষাকের বিশালদেহী মামু দাঁড়িয়ে। বাজখাই কণ্ঠে আমাকে জিজ্ঞেস করে, "এই, তুমি কী করো?"
এমনিতেই মামুকে ভয়, তায় আবার পিস্তল হাতে! কাপড় চোপড় নষ্ট হয়নি, কিন্তু খাবি খাওয়ার জোগাড়। আজ অবধি ইংরেজি বলি প্রথমে বাংলাতে বাক্য বানিয়ে তারপরে ট্রান্সলেট করে। পিস্তলের মুখে তো আর তা সহজে হয়না ... আমতা আমতা করতে করতে মুখ থেকে সাইকেল মেরামতি সংক্রান্ত জগাখিচুড়ি কিছু বেরুলো বলে টের পেলাম।
আমার অশ্বেতাঙ্গ চেহারা, আর মার্চ মাসের অল্প শীতেও বঙ্গের বিশাল জ্যাকেট গায়ে জবুথবু হয়ে থাকা দেখে মামুর সন্দেহ আরো বাড়লো। ক্যাম্পাস আবার সাইকেল চোরের আড্ডা খানা। পরিচিত সবারই সাইকেল চুরি একবার হলেও গেছে। ব্যাটা তাই পিস্তল আরো বাগিয়ে ধরে প্রশ্ন করলো, "কই থাকো তুমি?"
পাশের অ্যাপার্টমেন্টটা দেখিয়ে কাজ হলোনা ... আর গোদের উপরে বিষফোড়ার মতো আমার দুই রুমমেটও ঐ সময় বাসার বাইরে ... আমার কাছে চাবিও নাই। ভাগ্য ভালো, দিন দুয়েক আগেই ঠিকানা সহ স্টেট আইডি বানিয়ে এনেছিলাম।
গ্রীজমাখা হাতে তড়ি ঘড়ি করে মানিব্যাগ খুলে ওটাই বাড়িয়ে ধরলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক দেখে মামু ব্যাটা একটু আশ্বস্ত হলো, আমি পাশের অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা।
পিস্তলটা নেমে আসলো, আর দেখি, মামু ওয়াকি টকি বের করে বলে, "Cancel the alert, I don't need backup" !!!! মানে আমার জাব্বা জোব্বা অশ্বেতাঙ্গ চেহারা আর হাতে রেঞ্চ দেখে মামু আমাকে শহরের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বা নিদেনপক্ষে সাইকেল-চোর পার্টির নেতা বলে মনে করেছিলো, আর গোটা কয়েক মামু-গাড়ি ডেকে ফেলেছিলো কাছে আসার আগে!
যাওয়ার সময় মামু রীতিমত ঝাড়ি দিয়ে গেলো, spring break এর সময়ে বীচে মাস্তি না করে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে আছি কেনো, এই ব্যাপারে। নাকে খত দিয়ে আমিও প্রায় মুচলেকা দিলাম, আর সাইকেল মেরামতির কাজে নামবোনা ... দরকার হলে ঘাড়ে করে নিয়ে যাবো দোকানে।
২
পরের সপ্তাহেই আবারো মামু দর্শন হলো, তবে সে আরেক কাহিনী।
এও ঐ সাইকেল নিয়েই। সাইকেল-চোর-চক্রকে ধরার জন্য মামু পিস্তল নিয়ে টহল দিচ্ছে এলাকাতে, আগের সপ্তাহে হাতে নাতে তার প্রমাণ পেয়ে আমি বিগলিত, তাই সাইকেলের ইউলকের বদলে কেবল লক (তারের) দিয়ে বাড়ির খুঁটিতে বাইরে বেঁধে রেখেছিলাম। দু'দিনের মাথায় সাইকেল গায়েব! এবার মামু ডাকার পালা আমার ... কোনোদিন আর সাইকেলের দেখা পাবো না যেনেও মনের কষ্টে মামুর কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে বিশাল এক রিপোর্ট লিখালাম। এক "মামী" এসে সরেজমিন তদন্তও করে গেলো, আর জানালো, ক্যাম্পাসে কোথাও সাইকেলটা দেখতে পেলেই যাতে মামু ডাকি। ওরা আবার RAB এর মতো তৎপর না ... বিষ্ণুমুর্তির মতো নিজে থেকে কিছু খুঁজে নাকি দেখাটা ওদের কাজ না।
৩
একই সপ্তাহে হলো দুইবার মামু দর্শন, আর ঘটনার কেন্দ্রে থাকা সেই সাইকেলটার বিদায়। এর পরেও একবার মামু দর্শন হয়েছে, অবশ্য তা হাইওয়েতে টিকেট দিয়ে কমিশন পাওয়ার আনন্দে উদ্বেল ছোট শহরের মামুর সাথে। বেকুব চেহারা করে সদ্য আম্রিকা আগত ভাব দেখিয়ে ঐবার নিস্তার পেয়েছি। সাইকেল এখন কঠিন মোটা ইউলকে বেঁধে রাখি, আর রাডার ডিটেক্টর দিয়ে মামুর শনি দৃষ্টি খেয়াল করে রাস্তায় চলি। হাজার হোক, মামু বলে কথা ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।