কষ্ট হলেও সত্য বলা বা স্বীকার করার সাহসই সবচেয়ে বড় সততা।
ইসলাম শুধু নিজেকে সৎ হিসেবে গড়ে তোলার শিক্ষা দেয় না, অন্যকেও সংশোধনের তাগিদ দেয়। মানুষকে ভাল কাজের আদেশ দেয়া ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখা প্রচেষ্টাকে এ কারণে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাই প্রত্যেক মুসলমানকে তার সামর্থ অনুযায়ী ইসলাম প্রচারের কাজে অংশ নিতে হবে। এ জন্যে কুরআনে বলা হয়েছেঃ “তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো।
”··· (১৬: ১২৫)
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রত্যেক সাহাবী ছিলেন ইসলাম প্রচারক (দাইয়া)। কুরআন আরো বলছেঃ “বল, এটাই আমার পথঃ আল্লাহর প্রতি মানুষকে আমি আহ্বান করি সজ্ঞানে। আমি ও আমার অনুসারীগণ। ” (১২: ১০৮)
অতএব সংস্ড়্গার কর্মীদের লক্ষ্য হচ্ছেঃ “নিজে সৎ হও, অপরকে সৎ করো। ” আলকুরআনের ভাষায়ঃ “কে উত্তম যে আল্লাহ্র দিকে মানুষকে ডাকে, সৎ কর্ম করে এবং বলে, আমি তো আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত।
” (৪১: ৩৩)
ইসলাম চায় না যে, একজন মুসলমান একাই কাজ করুক। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ “আল্লাহ্র (সাহায্যের) হাত জামা’তের সাথেই থাকে। ” তিনি আরো বলেনঃ “একজন ঈমানদার আরেকজন ঈমানদারের কাছে সেই ইমারতের মতো যার বিভিন্ন অংশ একে অপরের সাথে সংযুক্ত। ” (বুখারী)
নিজেদের মধ্যে সহৃদয় সহযোগিতা এবং সৎ কাজের আদেশ কেবল একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নয়, বরং একটি অপরিহার্য শর্ত। অতএব দাওয়াতী ক্ষেত্রে সামষ্টিক কাজ বাধ্যতামূলক ৈএছাড়া দায়িত্ব অপূর্ণ থাকে।
বাস্তব কথা হচ্ছে ইসলাম বিরোধী শক্তি বিভিন্নভাবে সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করছে, অতএব মুসলমানদেরকেও সংঘবদ্ধ হয়েই ঐ শক্তির মোকাবিলা করতে হবে। অন্যথায় আমরা পিছিয়ে পড়তে থাকবো যখন অন্যরা এগুতে থাকবে। অতএব যেসব মুসলিম দেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পরিচালিত দাওয়াতী কাজের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়, সরকারীভাবে এমনকি সেন্সরশীপের মাধ্যমে তারা মস্ত বড় গুনাহ করে। দাওয়াতী কাজে ভীতি প্রদান ও বাধা সৃষ্টিও চরমপন্থী মনোভাব সৃষ্টির প্রধান কারণ, বিশেষ করে যখন ধর্মনিরপেক্ষতা ও মার্ক্সবাদ প্রচারে কোনো বাধা দেয়া হয় না; বরং সকল সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয় তখন এটাকে কিছুতেই সহজভাবে মেনে নেয়া যায় না। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এ কারণে যে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলামী বিপ্লবের কাজে বাধা দেয়ার অধিকার কারো নেই, কোনো সরকারেরও থাকতে পারে না।
বস্তুত মুসলিম দেশগুলোতেই ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে গিয়ে সেন্সরশীপ ও নানা রকম দলনের শিকার হতে হচ্ছে। সেখানে কেবল দরবেশ মার্কা ইসলাম ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের সুযোগ দেয়া হয়। এদের ইসলামের চেহারা হচ্ছে পশ্চাদপদতা ও অবজ্ঞায় এবং আচার-অনুষ্ঠান, বিদাতী কাজ কাম, শাসক-তোষণ এবং শাসকদের গদী বহাল রাখার দোয়ার মধ্যে সীমিত। আর দুর্নীতিপরায়ণ শাসকরাও এ ধরনের ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতায় অতি উৎসাহী। এভাবে অন্যায়-অবিচার শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিহাদকে তারা স্যাবোটাজ করার অপচেষ্টা চালায়।
মার্কস সম্ভবত এই অর্থে দাবী করেছিলেন, “ধর্ম জনগণের জন্যে আফিম। ”
কিন্তু কুরআনুল করীম, সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন যে ইসলাম রেখে গেছেন তা হচ্ছে সত্য, শক্তি, সম্মান-মর্যাদা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও জিহাদের প্রতিভূ। আর শাসকরা এই ইসলামকে ভয় পায়; কারণ তাদের অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে কী জানি কখন বিদ্রোহ দেখা দেয়! পক্ষান্তরে এই ইসলাম তার অনুসারীদেরকে বলেঃ “তারা আল্লাহর বাণী প্রচার করতো এবং তাঁকে ভয় করতো, আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করতো না। ” (৩৩: ৩৯)
এই পরিচ্ছন্ন বিশ্বাসের আলোকে ঈমানদাররা মনে করে যেহেতু জীবনের মেয়াদ আল্লাহ্ কতৃêক নির্ধারিত, অতএব কাউকে ভয় করার দরকার নেই, আর তিনি ছাড়া কারো কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনারও দরকার নেই। সমসাময়িক তুরস্ড়্গের একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
একবার একজন উপপ্রধান মন্ত্রীকে মন্ত্রণালয় থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি একটি দলেরও নেতা। তাদের বিরুদ্ধে শরীয়ত প্রবর্তন করার দাবী জানানোর অভিযোগ আনা হয়। অথচ তুরস্ড়্গের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান! উক্ত নেতা ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ১৫টি অভিযোগ খাড়া করা হয়। অভিযোগগুলোর মূল বিষয় ছিলো তারা ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ড়্গকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান।
ধর্মনিরপেক্ষ আতাতুর্কের অনুসারী তুরস্ড়্গের তদানীন্তন সামরিক সরকার শরীয়ত তথা ইসলামী জীবন বিধান পুনঃপ্রবর্তনের যে কোন প্রচেষ্টাকে অপরাধ বলে গণ্য করে। অথচ উক্ত গ্রুপ সর্বসম্মত আইনানুগ পন্থায় গণতান্ত্রিক পরিবেশে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা শক্তি প্রয়োগ করে সহিংস পন্থায় সরকার উৎখাত করতে চাননি। সামরিক কৌশুলী তাদের বিরুদ্ধে নানা আপত্তিকর শ্লোগান তোলার অভিযোগও উত্থাপন করে। শ্লোগানগুলো
হচ্ছে ঃ ‘ইসলামই হচ্ছে একমাত্র পথ’, ‘হযরত মুহাম্মদ (সা) একমাত্র নেতা’, ‘আশশারীয়াহ এবং ইসলাম এক ও অভিন্ন’ এবং ‘আলকুরআনই হচ্ছে সংবিধান।
’
প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো মুসলমানই যিনি আল্লাহকে প্রভু, ইসলামকে দ্বীন ও হযরত মুহাম্মদ (সা)কে রাসূল হিসেবে স্বীকার করেন তার পক্ষে কী এগুলো অস্বীকার করা সম্ভব? যখন ঈমানের পরিবর্তে কুফর এবং হারামকে হালাল করা হয় তখন মুসলমানদের কী করা উচিত? এসব অস্বাভাবিক পরিস্থিতি কী বাড়াবাড়ি ও চরমপন্থার মূল কারণ নয়? একটি আফ্রো-আরব দেশে কম্যুনিস্ট তৎপরতার জন্যে সাংবিধানিক সুযোগ ও নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইসলামী ভাবধারা জাগ্রত করার সকল প্রচেষ্টা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ ঐ দেশটি নিজেকে তথাকথিত “স্বাধীন বিশ্বের অংশ” বলে বিবেচনা করে। আরো মারাত্মক হচ্ছে ঐ দেশটির মুসলিম নেতা-কর্মীদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধেও একমাত্র অভিযোগ, তারা আল্লাহ্কে প্রভু, সত্যকে লক্ষ্য, ইসলামকে একমাত্র পথ, কথাকে অস্ত্র এবং জ্ঞানকে তাদের একমাত্র খোরাক বলে ঘোষণা করেছিলো।
অতএব, হেকমত ও সুন্দর ভাষণের মাধ্যমে ইসলাম প্রচারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তরুণরা যদি শক্তিকে ও সহিংসতাকে সহিংসতা দিয়ে মোকাবিলা করতে চায় তাহলে কি তাদের দোষ দেয়া যায়? এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। ইন্শাআল্লাহ ইসলাম যেভাবে হোক সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে যাবে। তাদেরকে
সুস্থ ও স্বাধীন পরিবেশে কাজ করতে দেয়া উচিত। অন্যথায় ঘটনাবলী অবাঞ্ছিত বিপরীত খাতে প্রবাহিত হতে পারে। খোলাখুলি কাজ করতে না দিলে দাওয়াতী কাজ বিভ্রান্তিকর গোপন সহিংসতা কিংবা চরমপন্থার রূপ নিতে পারে।
ক্ষমতাসীন কতৃêপক্ষের মারাত্মক ভুল হচ্ছে তারা ইসলামী আন্দোলন দমনে বন্দী শিবিরে সহিংস মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের আশ্রয় নেয়। বন্দীশিবিরগুলোতে মানুষের সাথে পশুর মতো আচরণ করা হয়। এ প্রসঙ্গে ১৯৫৪ ও ১৯৬৫ সালের মিসরের ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে। সামরিক কারাগারে ইসলামী বিপ্লবের নেতা ও কর্মীদেরকে লোমহর্ষক ও অবিশ্বাস্য পন্থায় শাস্তি দেয়া হয়। এখনো এসব কথা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়।
তাদের দেহে আগুন ও সিগারেটের ছঁ্যাক দেয়া হয়, নারী ও পুরুষ বন্দীকে জবাই করা পশুর মতো ঝুলিয়ে রাখা হয়, কারারক্ষীরা পালাক্রমে রক্ত ও পুঁজ জমে না ওঠা পর্যন্ত বন্দীদেরকে আগুনে ঝলসাতে থাকে। এই পাশবিক আচরণে অনেকেই শাহাদত বরণ করেন। কিন্তু শাস্তিদাতাদের দিল আল্লাহর ভয়ে এতোটুকু কেঁপে ওঠেনি। নাৎসীবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সমাজবাদের উদ্ভাবিত সকল নির্যাতন কৌশল তারা নির্বিচারে আল্লাহ্র পথের মুজাহিদদের ওপর প্রয়োগ করে।
এই বন্দীশালায় চরমপন্থা ও তাকফীরের প্রবণতা জন্ম নেয়।
বন্দীদের মনে প্রশ্ন জাগেঃ আমরা কি অপরাধে নির্যাতিত হচ্ছি? আমরা আল্লাহর কালামের কথা ছাড়া আর কিছুতো বলিনি? আল্লাহর পথে জিহাদে আমরা কেবল আল্লাহ্রই সাহায্য চেয়েছি, অন্য কারো কাছে তো পুরস্ড়্গার বা প্রশংসা চাইনি? এই প্রশ্ন আরো প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই পশুরা কে যারা আমাদের নির্যাতন করে, আমাদের মানব সত্তাকে অপমানিত করে, আমাদের ধর্মকে অভিশাপ দেয়, আমাদের পবিত্র ঈমানকে অমর্যাদা করে; আমাদের ইবাদতকে ঠাট্টা করে, এমনকি আমাদের প্রভুরও অমর্যাদা করার মতো ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে! একজন পদস্থ কর্মকর্তা একদিন বলেঃ ‘তোমাদের প্রভুকে আমার কাছে হাযির করো, তাকে আমি জেলে পুরব। ” এই পশুগুলোকে কি মুসলমান বলা চলে? এরা যদি মুসলমান হয় তাহলে কুফরী কী? এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এরাই হচ্ছে কাফির, এদেরকে ইসলামের আওতা থেকে বিতাড়িত করতেই হবে। এরপর আরো প্রশ্নের উদয়
হয়ঃ এদের সম্পর্কে এই যদি হয় আমাদের বিচার, তাহলে এদের মনিব সম্পর্কে আমরা কি সিদ্ধান্ত নেবো? ক্ষমতার আসনে বসে যেসব নেতা ও শাসক ইসলামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাদেরকেই বা কিভাবে বিচার করা উচিত? তুলনামূলক বিচারে তাদের অপরাধ অধিকতর মারাত্মক এবং তাদের রিদ্দাহ আরো স্পষ্ট ৈযে সম্পর্কে কুরআনুল করীমে বলা হয়েছেঃ “আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারা সত্যত্যাগী। ” (৫: ৪৭)
এই সিদ্ধান্তে আসার পর ঐ নির্যাতিত মুসলমানরা তাদের সহবন্দীদের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ঃ যেসব শাসক আল্লাহ্র বিধান মোতাবেক বিচার করে না এবং যারা শরীয়তের বাস্তবায়নে সংগ্রামরত তাদের ওপর নির্যাতন চালায়, এসব শাসকদের তোমরা কি মনে করো? বন্দীদের মধ্যে যারা তাদের সাথে একমত হলো তাদেরকে তারা বন্ধু এবং যারা দ্বিমত পোষণ করলো তাদেরকে শত্রু গণ্য করলো।
এমনকি কাফিরও মনে করলো, কেননা কাফিরের কুফরী সম্পর্কে যে সন্দেহ পোষণ করে সে নিজেই কাফির। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। যেসব লোক ঐরূপ শাসকের আনুগত্য করে তাদের সম্পর্কেও প্রশ্ন উঠলো। জবাব তৈরি
ছিলোঃ তাদের শাসকদের মতো তারাও কাফির, কেননা দাবী করা হয় ৈযে কাফিরের আনুগত্য করে সে নিজেও কাফির।
এভাবে ব্যক্তি গ্রুপ বিশেষকে কুফরী ফতোয়া দেয়ার প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।
লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, সহিংসতা শুধু সহিংসতার জন্ম দেয় না, সুস্থ
চিন্তাকেও দূষিত করে এবং ঐ দলন-দমন অনিবার্য বিদ্রোহের জন্ম দেয়।
(ড. ইউসুফ আল কারযাভীর- ইসলামী পুনর্জাগরণঃ সমস্যা ও সম্ভাবনা বই থেকে নেয়া)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।