এখন থেকে আমি 'মুক্ত মানব' -এই নিক-এ লিখবো। আপনি আমন্ত্রিত।
[এই কাল্পনিক ব্লগপোস্টটি পুর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রিয় ব্লগার, ক্যান্সার গবেষক, ক্রিকেট সাহিত্যিক: মিরাজকে উত্সর্গ করলাম]
নভেম্বর ১৩, ২০০৭
লাহোর
প্রিয় জেমি,
এক বন্ধুর বাসায় লুকিয়ে আছি আজ সাত দিন। আর ভালো লাগছেনা এই পলাতক জীবন। ভাবছি কাল পান্জাব ইউনিভার্সিটিতে সমাবেশে যাবো।
গ্রেপ্তার করলে করবে। এই আঁরশোলার মতো লুকিয়ে আর ক'দিন থাকা যায় বলো?
ভাবলাম তোমাকে একটা চিঠি লিখি।
এই কদিন আমার অখন্ড অবসর যাচ্ছে। তেহরিকের মিটিং নেই, মায়ের নামে গড়া ক্যান্সার হাসপাতালের গাদা গাদা কাগজে সই-স্বাক্ষর করা নেই, ফান্ড রেইজ ক্যাম্পেইন নেই, ক্রিকেট নিয়ে লেখালেখি নেই। শুধু খাও, ঘুমাও, আর ইন্টারনেটে বিবিসি শোনা, আর স্ম্রিতির জাবর কাটা।
আমাদের প্রেম, বিয়ে, সংসারের মধুর সময়গুলো।
প্রিয় জেমি, নিন্দুকেরা ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ এই দশটা বছর ধরে ঘরে-বাইরে কতো বিষোদগারই না করলো আমাদের দুজনকে ঘিরে। আমার দেশের কিছু কুপমন্ডুক বলে বেড়াতো ইহুদীকন্যার রুপের ফাঁদে পড়ে আমিও ইহুদি হয়ে গেছি, পশ্চিমের চর হিসেবে আমি দেশে এসেছি। তোমার দেশের লোক আমাকে বলতো অর্ধেক বয়সী মেয়েকে সম্মোহিত করে তাকে নাচিয়ে বেড়াচ্ছি(তখন তোমার নাম হাইকা, পরনে দেশি পোশাক), তোমার বাবার ধন-সম্পদের লোভে তোমাকে পটিয়েছি ইত্যাদি। তোমাকেও শুনতে হতো অনেকের কান ভাংগানি: সীতা হোয়াইটের সন্তানের পিতা হয়েও আমি সেটা অস্বীকার করেছি, তোমার প্রতি আমি সাত দিনও বিশ্বস্ত থাকতে পারবেো না, ইত্যাদি।
দুর্জনের মুখে ছাই দিয়ে আমরা কিন্তু ভালোবাসার সংসারের এক দশক কাটিয়েছিলাম।
আমাদের দুটো সন্তান এলো। তুমি এদেশের ভাষা শিখলে, কাঠ-কয়লার চুলার ধোঁয়ায় নাকের-পানি চোখের পানির ককটেল বানিয়ে শিক কাবাব বানাতেও শিখলে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য আর একক পরিবারের সভ্যতায় বড় হলেও আমাদের বাসার যৌথপরিবেশে কি চমত্কার মানিয়ে নিলে নিজকে। আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখতাম, আর নিন্দুকদের ছানাবড়া চোখ কল্পনায় দেখে মুচকি হাসতাম।
তারপর কি থেকে কি হয়ে গ্যালো। দেশ উদ্ধারের ভুত চাপলো আমার মাথায়। তুমি জানো খ্যাতির জন্য এপথে আসিনি। ওটা যথেস্টই পেয়েছিলাম ক্রিকেট থেকে, তোমার ভালোবাসা থেকে। মিটিং-মিছিলের জন্য সারাদেশ আর মায়ের নামে গড়া ক্যান্সার হাসপাতালের কাজে সারা দুনিয়া চষে বেড়াতে লাগলাম।
সব সময় ইচ্ছে থাকলেও তোমাকে সাথে নিতে পারতাম না। দুটো ছোট শিশুর পরিচর্যাকারি জননী তুমি তখন, শুধুই আমার বউ নও আর। এ ভাবেই কি বাড়তে থাকলো আমাদের দুরত্ব? জানি না। কিন্তু যখন জানতে চাইলাম, তখন অনেক দেরী হয়ে গ্যাছে। তুমি চাপ দিতে লাগলে লন্ডনে ফিরে যাবার জন্য।
আমি মায়ের নামে গড়া হাসপাতাল ফেলে, নিজের দেশ ফেলে লন্ডনে বাকি জীবন কাটানোর ব্যাপারে মন স্থির করতে পারলাম না। বরং তোমাকে চাপ দিলাম যদি ইটালীর মেয়ে সোনিয়াকে ভারতের মানুষ আপন করে নিতে পারে, বিলেতের মেয়ে জেমীকেও একদিন আমার দেশের মানুষ আপন করে নেবে। আমার জীবদ্দশায় না হলেও মরলে নেবে। তুমি এদেশ কে আপন করে নাও। তুমি ভাবার জন্য সময় চেয়ে লন্ডনে গেলে।
সংগে আমাদের সন্তানেরা। তারপর....। থাক সে কথা। পুরুষের মধ্যরাতের একাকী কান্নার মাচো কস্ট শুনিয়ে তোমাদের শহরের ট্যাবলয়েড পত্রিকার বেচা-কেনা আর কতটুকুই বা বাড়বে বলো? শুধু বলবো, জীবনের কোন সময়ে আমার কাছে আসতে চাইলে জেনো আমার দরজা খোলা। রাজনীতি আমার সম্ভবত: বেশিদিন পোষাবে না।
এই হাসপাতাল কে ঘিরেই কাটবে আমার বাকি জীবন।
প্রিয় জেমি, লাহোরে যেই অনুজপ্রতিম বন্ধুর বাসায় লুকিয়ে থেকে এই ই-চিঠি তোমায় লিখছি , ওর বাবা ছিলেন বাংলাদেশী (সাবেক পুর্ব পাকিস্তান)-মা পান্জাবী। ওর বাবা একাত্তরে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হন। আমার বন্ধুটি বিধবা মায়ের শেষদিনগুলোতে পাশে থাকবে বলে এদেশেই রয়ে যায়। ওর কাছে এই কয়দিনে অনেক বাংলা গান শুনে ভাষাটার প্রেমে পড়ে গেছি আমি।
সেখান থেকেই দুলাইন লিখি: 'আমাকে পড়লে মনে খুঁজো এইখানে, এখানে খুঁজছি আমি জীবনের মানে...'
ভালো থেকো জেমি, সুখী হও।
একদা তোমার-সদা তোমার
ইমরান
পুনশ্চ: আমাকে সম্ভবত: কাল পান্জাব ইউনিভার্সিটির সভা শেষে গ্রেপ্তার করা হবে। অনেকদিন হয়তো আর ইণ্টারনেট, ফোন, খবরের কাগজ কিছুই হাতের কাছে পাবো না। তাই এই বেলা বলে রাখি: তোমাদের দেশে বাংলাদেশের এক মেধাবী ক্যান্সার গবেষক বর্তমানে উচ্চতর গবেষনার কাজে অবস্থান করছেন। তাঁর নাম মিরাজ খন্দকার।
এই তরুণ ছেলেটির সম্পাদিত বাংলাক্রিকেট ওয়েব ম্যাগাজিনেরও আমি একজন মুগ্ধ পাঠক। মিরাজ কে বলো, লেখাপড়া শেষে তিনি যদি আমার মায়ের নামে গড়া ক্যান্সার হাসপাতালের জন্য কিছু শলা-পরামরামর্শ দ্যান খুব ভালো লাগবে। আর বলো, ১৯৭১ সালে আমাদের ভুমিকার জন্য একজন পাকিস্তানী হিসেবে আমি লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাঁকে আমার ভালোবাসা দিও।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।