আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্ষুধার্তের দেশে গুরুত্বহীন দেশজ ও ফলজ গাছ এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠা বাহারী বিদেশী বৃক্ষ: বৃক্ষরোপনের তামাশা নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ



ক্ষুধার্তের দেশে গুরুত্বহীন দেশজ ও ফলজ গাছ এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠা বাহারী বিদেশী বৃক্ষ: বৃক্ষরোপনের তামাশা নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ নাদিমূল হক মন্ডল নাদিম* কার্বন ডাই-অক্সাইডের বিষাক্ত মেঘের চাদরে ক্রমশ ঢেকে যাওয়া ধরিত্রীকে বাচাতে রাষ্ট্র, সিভিল সোসাইটি, বেসরকারী সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্দ্যোগে বৃরোপন কর্মসূচি ব্যাপকভাবে পালন করা হচ্ছে, খুবই সুখের বিষয়। এই সক্রিয় তৎপরতায় দেশের অনেক অংশ আবার নতুন করে সবুজ হতে শুরু করেছে, যান্ত্রিক নগরের ইট, সুরকী, পাথর, পিচের সাম্রাজ্যে ঘন হতে শুরু করা গাছের মৃদু হাওয়া আমি নিশ্চিত জানি আমার মত আপনাদেরও উতলা করে, প্রশান্তির কাছাকাছি নিয়ে যায়। কিন্তু যেসব গাছ নির্বাচন করা হচ্ছে, লাগানোর জন্য উৎসাহ দেয়া হচ্ছে এবং অবশেষে সরকারী-বেসরকারী উদ্দ্যোগে রোপিত হচ্ছে জমিতে তার সামগ্রিক চিত্রে তাকালে প্রশান্তির সে অনুভব আর টিকে থাকেনা বরং ভয়াবহ বাস্তবতা চোখের সামনে দেখতে পেয়ে প্রথমে আতঙ্ক ও পরে বুকের ভেতর হাহাকারের স্রোত উঠে। পুরো আশি নব্বইয়ের দশকে যে বৃপ্রজাতিটিকে বাংলাদেশের পুরো মানচিত্রজুড়ে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে তার নাম ইউক্যালিপটাস। ষ্টেবিংস এর বিখ্যাত বই ঞযব ঋড়ৎবংঃং ড়ভ ওহফরধ (১৯২৬) ঘেটে ইউক্যালিপটাসের নাম পাওয়া না গেলেও এখন অনেক গ্রামকে দুর হতে পাশের গ্রাম থেকে আলাদা করে চেনা যায় দেশীয় গাছগুলোকে অনেক নিুে রেখে মাথা উচু করে থাকা ইউক্যালিপটাস গাছ দেখে।

কথিত স্মার্ট গাছ ইউক্যালিপটাসের নানান তিকারক দিক আছে এবং সবমিলে এটি ভয়ংকর। একটি ইউক্যালিপটাস দিনে আশি গ্যালনের বেশী পানি শুষে নেয়, যা একদিনে দশটি শাল গাছের শোষিত পানির সমান। ইউক্যালিপটাস সেই বৃ যা কোন জায়গায় অনেক থাকলে টিওবওয়েলে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যায় এবং কুয়ার পানি স্তর অনেক নিচে নেমে যায়। বছরের একটা সময় আমাদের দেশের গাছপালা পানির অভাবে এমনিতেই ধুকে মরতে থাকে, তাই সহজেই অনুমান করে এই সিদ্ধান্তে পৌছা যায় যে গাছটি আমাদের দেশোপযোগী নয়। শুধু আমাদের দেশের জন্যই যে অনুপযোগী তা নয়, এমনকি যে দেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে সেই অষ্ট্রেলিয়াতেও কিছু শৌখিন বাগান ছাড়া অন্য কোন জায়গায় ইউক্যালিপটাস লাগানোর মূর্খতা অষ্ট্রেলিয়ানরা প্রদর্শন করেনি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্য হল বৃক্ষপ্রেমী সাধারন মানুষের উপর একসময় ইউক্যালিপটাস চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল তিকারক দিকটি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র না জানিয়ে, পুরোপুরি অন্ধ রেখে। আমরা চাইনা একই ধরনের ঘটনার আবার পুনরাবৃত্তি ঘটুক। আর এখন চলছে সবুজ নগরী তৈরীর মহান প্রজেক্ট। নগরের বিশাল অংশজুড়ে লাগানো হচ্ছে গাছপালা, নানা রঙ্গের, নানা বর্ণের, বিচিত্র সব প্রজাতির । আপাত অর্থে খুবই খুশীর সংবাদ।

কিন্তু বিমানবন্দর থেকে বনানী, মহাখালী, জাহাঙ্গীর গেট, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনের সড়ক পার হয়ে ফার্মগেট, বিজয় সরনী, মানিক মিয়া এভিনিউ ধরে যেতে যেতে আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করেছি চারপাশে যত জায়গায় যত গাছ সবই প্রধানত, বিদেশী, দ্বিতীয়ত, নিছক বাহারি, শোভাবর্ধক। কোথাও উদ্দ্যোগ নিয়ে দেশজ ও ফলজ উদ্ভিদকে লাগানো হয়নি, হচ্ছেনা। সবচে ভয়াবহ হল যেসব বিশাল দেশজ ও ফলজ গাছ সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারক হয়ে টিকে ছিল, কখনো রাস্তা স¤প্রসারন আবার কখনো সৌন্দর্য বর্ধনের অজুহাতে সেগুলোকে কেটে ফেলা হয়েছে। ঐতিহাসিক পরিক্রমায় বন, অরণ্য ছিল জীবনের সাথে যুক্ত, সমাজ সভ্যতা টিকেই ছিল অরণ্য নির্ভরতায়। ুধার্তের অবলম্বনই তো ছিল সামাজিক অরণ্য।

কিন্তু এখন যে বৃরোপণ চলছে তা কোন সমাজের স্বার্থে? কার বা কাদের লাভ হচ্ছে আর কার বা কাদের তি হচ্ছে? নিশ্চিত করেই বলা যায় দেশজ ও ফলজ গাছ গাছগাছরার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য অস্বীকার করে ইউক্যালিপটাস ও সৌন্দর্য বর্ধনের নানা রঙ্গের, নানা বর্ণের, বিচিত্র সব প্রজাতির বিস্তারে যারা উপকৃত তারা নিুবিত্তের, প্রান্তিক, দরিদ্র মানুষ জন নয় বরং শহুরে, নাগরিক, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত। ব্যাপক ুধার্ত জনগোষ্ঠির কী কাজে লাগবে বাহারি গাছ? আমার বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্র, তাদের জমি নেই, ভূমিহীন, এমনকি কারো কারো বাড়ী ভিটা পর্যন্ত নেই, উত্তরবঙ্গে তারা প্রতিবছর ুধায় মরে । এখনও দুবেলা ভাতের জন্য রাস্তায় নামতে হয় অবুঝ শিশুকে। ওদেরকে কি বাহারি গাছগুলো সাহায্য করবে? উদোম গায়ে যে মানুষেরা তপ্ত দুপুরে ঘুমায় আসাদ গেটের ওভার ব্রিজের তলে, মানিক মিয়া এভিনিউ জুড়ে বি¯তৃত শৌখিন গাছের সারি কি তাদের নিরন্ন মুখে একটা ফল তুলে দিতে পারবে ? উত্তরটা আমরা জানি, পারবেনা। একদিকে, দেশজ অরণ্যর প্রতি ধারাবাহিক অবহেলা, মধুপুরের মত সমৃদ্ধ অরণ্য ও ুদ্র জাতিসত্তা কে ধ্বংস করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় উদ্দ্যোগে ইকোপার্ক ইত্যাদির নামে, অন্যদিকে চলছে বনায়ন ও সবুজ নগরী তৈরীর প্রজেক্ট।

সত্য হল: দেশজ বৃ হুমকির মুখে বিদেশী প্রজাতির আগ্রাসনে এবং পরিস্থিতি দেশের সামগ্রিক প্রতিবেশের ভারসাম্যের জন্যও ভয়াবহ। বনায়ন ও বৃরোপনের সামগ্রিক নীতিকৌশল দরিদ্র ও প্রান্তিক জনতার স্বার্থবিদ্বেষী, উচ্চবর্গের ক্রমবর্ধমান বিলাসিতার খোরাক। তাই বর্তমান বনায়ন ও বৃরোপন নীতির সক্রিয় বিরোধীতা এবং একটি গণমুখী ও দরিদ্রমুখী নীতির জন্য অ্যাডভোকেসী এখন সময়ের দাবী। সে জন্য সামাজিক আন্দোলন শুরুর দায়িত্ব আমার, আপনার, আমাদের সকলের। তাইনা?????? নাদিমূল হক মন্ডল নাদিম* সামাজিক নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক ইমেইল:


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।