আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদ্রোহের রাস্তায় : ওরহান পামুক ( পর্ব ১ )

বাস্তবতা ফেরী করে বেড়াচ্ছে আমার সহজ শর্তের সময়গুলোকে

আমরা তেহরান শহরের দক্ষিণ প্রান্তের দরিদ্র অঞ্চলটি দিয়ে ড্রাইভিং করে যাচ্ছিলাম। গাড়িতে বসে আমি সারি সারি বাইসাইকেল গাড়ি মেরামতের দোকান দেখতে পেলাম। দিনটি ছিল শুক্রবার। প্রায় সবগুলো দোকানই তাই বন্ধ ছিল। রাস্তা, ফুটপাথ, এমনকি কফি হাউজগুলোও ছিল ঠিক মরুভূমির মতো শূন্য।

তখন আমরা বড় এবং জনশূন্য স্কোয়ারটির দিকে যাচ্ছিলাম। স্কোয়ারটির চারদিকে ঘোরানো প্যাচানো সব রাস্তা। এ রকম বিষয় আমি সারা শহর জুড়েই দেখেছি। মূল রাস্তাটি ছিল আমাদের ঠিক বামে। তবে সেখানে যেতে হলে প্রথমে আমাদের ডানে মোড় নিতে হবে, তারপর সবটুকু পথ ঘুরে আসতে হবে।

ঠিক তখনই আমি দেখতে পেলাম আমাদের চালক কেমন যেন দ্বিধান্বিত। সে তখনই বামে মোড় নিবে কি না ভাবছিল। দুপাশেই ভালো করে লক্ষ করে দেখছিল স্কোয়ারটিতে কোন গাড়ি প্রবেশ করে কিনা। সে আইন মানবে, না কি রাস্তা খুঁজে পেতে নিজের বুদ্ধির প্রয়োগ করবে-এই নিয়ে দ্বিধান্বিত। চালকটি জীবনে অপ্রত্যাাশিত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলে হয়তো এভাবেই চিন্তা করে নেয়।

আমি তখন নস্টালজিক। মনে পড়ে গেল, যুবক বয়সে ইস্তাম্বুলের পথে গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় আমিও ঠিক এই অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলাম। শহরটির প্রধান এভিনিউয়ে আমি ছিলাম আদর্শ চালকের মতো (সাংবাদিকরা এভিনিউটিকে ট্রাফিক অরাজকতার মোহনা হিসেবে বর্ণনা করতে পছন্দ করে)। কিন্তু আমার পিতার গাড়িটি নিয়ে পাথর দিয়ে বাধানো খালি রাস্তাটিতে প্রবেশ করতেই নিয়ম কানুনের কথা সব ভুলে গেলাম। আমি এতে আনন্দিত হয়েছিলাম।

দৃষ্টিসীমায় অন্য কোন গাড়ি না থাকলেও পিছনের রাস্তার ‘নো লেফট টার্ন’ সাইন মানা, মধ্যরাতে স্কোয়ারের বাইরের রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা, অথবা লাইট গৃন হওয়ার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে কর্তৃপক্ষকে সম্মান জানানো আমার কাছে প্রয়োগবাদীদের হালকা কাজ বলে মনে হয়। সেই সময়টিতে যারা আইনের ধারা মেনে পথ চলতো আমরা তাদের খুব কমই সম্মান করতাম। আমরা ভাবতাম, যাদের বুদ্ধি ও কল্পনাশক্তিতে ঘাটতি আছে তারাই কেবল এমনটি করতে পারে। আপনি যদি খালি ক্রসিং-এ লালবাতির জন্য দাড়িয়ে থাকেন, তাহলে বোধহয় যারা টুথপেস্ট টিউবে একদম নিচ থেকে চাপ দেয় সেই দলের মানুষ। অথবা যারা লেভেলের সবকিছু ভালোভাবে না পড়ে ঔষুধ গ্রহণ করেন না সেই প্রকৃতির।

জীবনের এই গতিপ্রকৃতি নিয়ে আমাদের সন্দেহগুলো একটি কার্টুনের মাধ্যমে বেশ ভালো করে ফুটে উঠেছিল। আমার মনে পড়ছে ১৯৬০ সালের দিকে পশ্চিমের কোন একটি ম্যাগাজিনে এটি দেখেছিলাম। একজন ড্রাইভার আমেরিকান একটি মরুভূমির মাঝামাঝিতে গৃন লাইটের জন্য অপেক্ষারত। অথচ তার সামনের রাস্তার যতটুকু দেখা যায় সবই ফাঁকা। যখন আমি ইস্তাম্বুল থেকে ফিরে আসার চিন্তা করি, তখন আমার কাছে মনে হয়েছিল হাইওয়ে রোডের জন্য আমার চিন্তাচেতনা সাধারণ আকাক্সিক্ষত বিশৃংখল অবস্থা থেকে বেশি।

এ বিষয়ে বলা যায়, তা ছিল অ্যাংলো ওয়েস্টার্ন জাতীয়তাবাদের সূক্ষ্ম অবস্থা। যখন আমরা নিজেরা নিজেরা থাকি, অর্থাৎ কোন অপরিচিত লোক আমাদের মধ্যে থাকে না, তখন পুরনো আদেশটিই আগে আসে। তখন আমরা আমাদের পুরনো কৌশলটির কাছেই ফিরে যাই। ১৯৬০ এবং ৭০ সালের মধ্যে একজন লোক জাতীয়তার গর্বের উচ্ছ্বাস অনুভব করতো ; যেমন একটি সাড়ানো অনুপযুক্ত জার্মান রেডিও পেয়ে তা মুঠো দিয়ে ঘুষি দিয়ে উচ্ছ্বাস,রকেটি ফোন হাতে পেয়ে উচ্ছ্বাস। কৃতিত্বপূর্ণ কাজগুলো আমাদের পশ্চিমাদের থেকে ভিন্ন অনুভূতি এনে দিত।

তাদেও টেকনোলজি এবং কালচারের নিয়মকানুনগুলোর প্রতি সংমাননা রয়েছে। তারা আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা কেমন বৈশ্বিক আর কেমন ধূর্ত। আমি তেহরানের প্রান্তদেশের স্কোয়ারটিতে দেখেছিলাম আমাদের ড্রাইভারটি সন্দেহের দোলাচলে ভুগছিল। সেই সময়ের মধ্যে লোকটি সম্পর্কে আমি বেশ ভালোই জেনে ফেলেছিলাম। লোকটি সমন্ধে বলতে পারি তার জাতীয়তাবাদের বক্তব্য তৈরীতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না।

তার সমস্যাটি ছিল আরো বেশি বৈশ্বিক। আমরা ছিলাম তাড়াহুড়োর মধ্যে। ঘোরানো পথটির সবটুকু ঘুরে যাওয়া আমাদের অনেক সময়ের অপচয় বলে মনে হয়েছিল। চালকটি তখনই চিন্তিতমনে চকিতদৃষ্টি সমগ্র দেখে নিল। সে জানতো, সে যদি সীমান্তে বেপরোয়া হয় তাহলে হয়তো শেষে গিয়ে অন্য একটি গাড়ির সঙ্গে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসবে।

অনুবাদ : একরামুল হক শামীম

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.