আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এবেনের স্বপ্নের গল্প (বিশাল সাইজের লেখা)

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

[এই লেখাটা গত বৎসর সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে ছাপা হয়েছিল; যদিও আমি গল্পটার শিরোনাম দিয়েছিলাম 'এবেনের গল্প', কিন্তু গল্পটি ছাপা হয় 'স্ট্যান্ডার্ড' শিরোনামে। এখন মনে হচ্ছে 'এবেনের স্বপ্নের গল্প'নাম দিলে লেখাটা বোধগম্য হবে। গল্প বললেও এটা একটা ঘটনা, ঘটনাটা এবেন নামে এ্যামেরিকান এক যুবককে নিয়ে। মজার ব্যাপার হলো, গল্পটি ছাপা হবার পর প্রায় জনাবিশেক পাঠকের কাছ থেকে আমি ই-মেইল পেয়েছিলাম, তারা তাদের ভাল লাগার কথা বলেছিলেন, এবং একই সাথে এটাও জানতে পারলাম যে এসব পাঠকদের অধিকাংশই কোন না কোনভাবে এবেনকে চেনেন। এটা ছিল আমার জন্য এক চমৎকার অভিজ্ঞতা] ***************************************** ========= এবেনের গল্প ========= ১. প্রতি বছরই বসন্তের ছুটি শেষে যখন দেশ ছাড়ার জন্য আবার প্লেনে উঠি, মনটা ঝিম মেরে থাকে; সম্ভবতঃ সারা বছরে সেই মুহুর্তটা আমার সবচেয়ে বিরক্তিকর সময়, মনে হয় হাতের আশেপাশে যা কিছু আছে সব ছুঁড়ে ফেলি।

অথচ ছুটির শুরুতে যখন দেশে আসি, একই প্লেন, একইরকম ফ্লাইট, একই এয়ারপোর্ট, একই আকাশ-ললনা -- এরাই কত আনন্দের হয়ে ওঠে। আর ফিরে যাবার সময়, উফফ!! অসহ্য! নারিতা-ঢাকা ফ্লাইটটা যতটা আনন্দের হয়, ঢাকা-নারিতা ফ্লাইটটা ঠিক ততটাই বিরক্তিকর হয়ে যেন নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্রকে প্রমাণ করে দেয়। এরকম আনন্দ আর বিরক্তির পালার মধ্যে দিয়েই যেতে হয় আমাকে, বছরে মোটামুটি একবার, আকাশপথে। বিমানের ভ্রমন আমার কখনই কোনভাবে ভাল লাগেনি, বাইরে তাকালে শুধু সাদা মেঘ, একদম বৈচিত্র্যহীন। আর ভেতরে খুব ছোট্ট একটা এলাকার মাঝে নিজেকে গুটিয়ে রাখা; কিছু করার তো নেই -- ইকনমি ক্লাসই আমাদের ভরসা বলে কথা! প্রতিবারের মতো ২০০০ সালের মার্চেও বসন্তের ছুটি শেষে আবার দেশ ছাড়ছিলাম, এবেনের গল্পটা সেই সময়কার।

এবেনের সাথে আমার পরিচয় প্লেনের ভেতর, পাশের সিটের সহযাত্রী। প্লেনের মাঝখানের সারির আইলের দিকের সিটে বসেছিলাম আমি, আর এবেন মাঝখানে। আমাদের সিটের সামনেই গ্যালের দেয়াল, দেয়ালে বড়সড় একটা স্ক্রীন টাঙানো। ভাবলাম, ভালই হলো, সিনেমা দেখে কাটিয়ে দেয়া যাবে চার-পাঁচ ঘন্টার ঢাকা-কুয়ালালামপুর ফ্লাইটটা। পাশের সিটে বসা এবেনকে একনজর লক্ষ্য করে ডুবে গেলাম 'মর্নিং পোস্ট' বা এই জাতীয় কোন এক পত্রিকায়।

বলাবাহুল্য তখনও আমি ছেলেটাকে চিনিনা, নাম জানাতো দূরের কথা। ছেলেটার দিকে লক্ষ্য করে নিজের সামনে ধরা পেপারে চোখ রাখলাম ঠিকই, কিন্তু তখনই মনের ভেতরের খটকাটা টের পেলাম। 'আরে! একেবারে পাক্কা ইউরোপিয়ান এক ছেলে অথচ বাংলা পত্রিকা পড়ছে। ' মনে হতেই চকিতে তাকালাম ছেলেটার দিকে, তারপর তার ধরে রাখা পত্রিকার দিকে। 'আসলেইতো! বাংলা ম্যাগাজিন!' ম্যাগাজিনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা এবেন ঠিকই আমার বিস্মিত দৃষ্টি টের পেল।

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, মুখে স্মিত হাসি। যেন বলতে চাচ্ছে, 'দেখলে, তোমাকে কেমন ধাঁধায় ফেলে দিলাম। ' মনে হলো, ছোকরা যেন আগেভাগেই ঠিক করে রেখেছিল পাশের যাত্রীকে ধাঁধায় ফেলে দেবে, আর সেজন্যই আমার বিস্মিত হবার জন্য অপেক্ষা করছিল। তাই যখন আমি হতবাক হয়ে তার সামনে ধরে থাকা পত্রিকাটাকে লক্ষ্য করছি, তখন তার মুখে স্মিত হাসি, যেন পরিকল্পনা কাজ করায় সে ভীষন খুশী। এবেন ছেলেটি ২৩/২৪ বছর বয়েসী, আমেরিকান হোয়াইট, সোনালী চুলের ভদ্র ছিমছাম গোছের।

চোখে বিল গেটস টাইপের চশমা, চুলের স্টাইলও অনেকটা সেরকম। এধরনের চেহারা দেখলেই সবার আগে যে ধরানা তৈরী হয় মানুষটা সম্পর্কে তা হলো, 'বদ্ধিমান ও সপ্রতিভ'; এবং পরে যা টের পেলাম তা থেকে বলতে পারি ছেলেটি আসলেও তাই ছিল। স্মিতহাসিটা মুখে ঝুলিয়ে রেখে এবেন বলল, 'কি? অবাক হচ্ছেন? আমি বেশ ভাল বাংলা বলতে পারি, এবং পড়তেও পারি। ' ছেলেটার বাংলা উচ্চারণ দেখে আমি হতবাক! বিদেশীদের কাছে আমাদের ভাষাটা উচ্চারণ করা বেশ কঠিন, অথচ এই ছেলে খুব ভালভাবে বাংলা বলছে। তারওপর মনোযোগ দিয়ে পড়ছেও।

একবার ভাবলাম, বলি, 'লিখতেও পারেন?' তবে চিন্তাটা বাদ দিলাম, পাছে আবার নিরুৎসাহিত করার দায়ে পড়ি। তবুও ভাবলাম, নিজে থেকেই যখন বলছে বাংলা বলতে পারে, তবে আজ সারাক্ষণ এই ছেলের সাথে বাংলাতেই কথা বলব। বিদেশীদের সাথে ইংরেজী আর জাপানীজে ভাঙাচুরা কনভারসেশন করতে করতে ততদিনে আমি ক্লান্ত। সেদিন একটু শোধ নেয়া যাবে ভেবেছিলাম। আমি হাসিমুখে বললাম, 'অবাক তো হলামই।

খুব কম বিদেশীকেই বাংলা বলতে দেখেছি। আর বলতে পারলেও আপনার মতো এত ভাল বাংলা আমি কোন বিদেশীর মুখে শুনিনি। তারওপর ছোটছোট অক্ষরের ম্যাগাজিনও পড়ছেন!' 'তাই নাকি? সত্যি বলছেন? যাক, আমার নয় মাসের কষ্ট সার্থক। ' আমাকে আরেকদফা অবাক করে দিয়ে এবেন বলল। 'কি? মাত্র নয়মাস?' আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম।

'তুমি কি ঢাকা ইউনিতে কোন স্পেশাল কোর্স করতে এসেছ?' বিস্ময়ের কারনেই হোক বা ছেলেটার বন্ধুসুলভ মনোভাবের কারণেই হোক, আপনি থেকে তুমিতে চলে যেতে আমার কষ্ট হলোনা। এবেনও একইসাথে 'তুমি'তে চলে গেল, বলল, 'নাহ! আমি এসেছি ঢাকার মগবাজারের এক ক্লিনিকে, নয়মাস আগে। তোমাদের দেশের মেডিক্যাল সিস্টেম সম্পর্কে জানার জন্য। ' 'এত সুন্দর বাংলা শিখলে কিভাবে?' আমি কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করি। এবেনও সমানতালে চালিয়ে যায়, বলে, 'ক্লিনিকের ফ্রেন্ডদের কাছে, আর বই পড়ে পড়ে।

অবসরে বাংলা পড়াটা আমার হবি। ' 'ফ্রেন্ড? নিশ্চয়ই কোন সুন্দরী ডাক্তার বা নার্স?' এ্যামেরিকানের সাথে বাঙালী স্টাইলের মস্করা করে দেখি কি করে। 'তাহলে তো হতোই!' এবেন খানিকটা আক্ষেপের মতো সুর করে বলে যায়, 'তবে তোমার দেশের মেয়েগুলো কিন্তু দারুন সুন্দরী; আর খুব মিষ্টি স্বভাবের। ' 'খাইছে! তাই নাকি' আমার বেশ মজা লাগে এক বিদেশীর সাথে এরকম ফ্রেন্ডলি কথাবার্তায় ঢুকে যেতে। সময়ের সাথে সাথে প্লেন টেকঅফ করে, বিশের দশকের দুটো তরুন যাদের একজন ছুটি শেষে দেশ-পরিবার ছেড়ে এবং অন্যজন শখের ভাললাগার একটি দেশ ছেড়ে বিষন্ন মনে মালয়শিয়ান এয়ারের কোন এক ফ্লাইটে যাত্রা শুরু করছিল, তাদের মধ্যে হঠাৎই কোন এক শক্তিবলে কথাবার্টাগুলো দারুনভাবে জমে যায়।

সাড়ে চার ঘন্টার পুরো ফ্লাইটটাই এবেনের সাথে কথা বলে কাটে; একটানা বাংলা বলাও যে ক্লান্তি আনে সেটা বুঝতে পারি। তাও প্লেনের সেই ইকনমিক ছোটখা স্পেসে সমবয়েসী একটি বিদেশী ছেলের সাথে গুটুর গুটুর করে নিজের ভাষায় কথা বলছি, এব্যাপারটা আমাকে একরকম বিশ্বজয়ের আনন্দ দেয়। তখন মনে হয়েছিল, 'বাংলাটা লিংগুয়া ফ্রাংকা হলে কি জমজমাটই না হতো! পৃথিবীর সব মানুষের সাথে মন ভরে কথা বলতে পারতাম!' ২. এবেনের সাথে কথা চলে অনেক বিষয় নিয়ে। যথারীতি বাংলাদেশে তার কাটানো নয়মাসের অভিজ্ঞতা, কোন ধরনের বাঙালী মেয়েদের তার ভাল লাগে, বাংলাদেশের মেডিক্যাল সিস্টেম আর যুক্তরাষ্ট্রের মেডিক্যাল সিস্টেমের তফাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, জাপানের দর্শনীয় স্থান, এটা সেটা আরো অনেক হাবিজাবি নিয়ে। কথাপ্রসঙ্গে জানলাম, এবেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল স্কুলের ছাত্র; থাকে বস্টনে।

মনে মনে বললাম, 'চেহারা দেখে যা ভেবেছিলাম, তাই!' আর কয়েকবছরপর এবেন হবে আমেরিকার সবচেয়ে এলিটদের একজন (হয়ত ইতিমধ্যে হয়েও গেছে), আর দেখলাম তার চিন্তাভাবনাও সেরকম। খুবই পরিস্কার। আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তখন সবেমাত্র রিপাবলিকান পার্টির নমিনেশন পেয়েছিলেন (সুপার টিউসডে ধরনের কিছু একটা ইভেন্টে জন ম্যাকেইনকে হারিয়ে), এবেন সেবিষয়টা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিল। তার সরাসরি কথা, 'জর্জ বুশের বাবাও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; কাজেই একই পরিবার থেকে বংশানুক্রমে আরেকজন প্রেসিডেন্ট হবে -- এটা ভাল কোন লক্ষণ না। ' আমি শউধু ভেবেছিলাম, এরা কত পরিস্কার আর সরাসরিভাবে চিন্তা করে! কথাপ্রসঙ্গে এবেনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'আচ্ছা, তুমি স্টাডির জন্য বাংলাদেশকে বেছে নিলে কেন? আর বাংলা ভাষাটাই বা এত ভাল লাগল কেন তোমার? আমার তো এখনও জাপানী ভাষা দেখলে পালাতে ইচ্ছে করে।

' 'বাংলাদেশকে স্টাডির জন্য বেছে নেয়ার পেছনে তেমন বিশেষ কোন কারণ নেই; ইউ.এসের মেডিক্যাল স্ট্যান্ডার্ডের সাথে বাংলাদেশের মেডিক্যাল স্ট্যান্ডার্ডের বেশ বড় রকমের ফারাক আছে, সেই ফারাকটুকু নিজের চোখে দেখার জন্যই এখানে আস আমার। ' এবেন একটানে বলে যেতে লাগল, 'তবে বাংলা ভাষা সিরিয়াসলি শেখার পেছনে আমার বিশেষ একটা কারণ আছে। ' 'তাই নাকি?' আমি আবার ফিচেল হাসিতে বললাম, 'নিশ্চয়ই কোন সুন্দরী বাঙালী ললনার সাথে বেশী বেশী কথা বলতে চাও?' হাস্যরসের মাঝখানে আমি তাকে টিপসও দিয়ে দিলাম, বিদেশ থেকে ফোন করার সময় শুরুতে অনেকেই একটা যিরো বেশী প্রেস করে সেটা বেশ বুঝিয়ে বললাম। হাসাহাসি শেষ হলে এবেন সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, 'নাহ! বাংলা শেখার পেছনে সিরিয়াস কারন আছে। ' আমি আগ্রহ পেলাম, এবেন বলে যেতে লাগল, 'দেখ বাংলাদেশে চিকিৎসাব্যাবস্থা দেখে আমি ব্যবধানটা বুঝতে পেরেছি, তবে সবচেয়ে বড় কষ্ট পেয়েছি যে জিনিসটা দেখে তা হলো এদেশের নার্সদের দক্ষতার স্ট্যান্ডার্ড।

তাদেরকে আরো অনেকঅনেক ভালোভাবে শেখানো যায়, অনেক বেশী দ্বায়িত্ব দেয়া যায় এবং অবশ্যই আরো অনেক বেশী সন্মান দেয়া যায়। অথচ, তোমাদের দেশে সেটা একেবারেই নেই। ' আমি আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বললাম, 'হুমমম, ঠিকই বলছ। ' এবেন বলে যেতে লাগল, তাকে কিছুটা উত্তেজিতও শোনাল যখন সে বলল, 'সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার কি জানো? দেশে নার্সদের জন্য ভাল কোন বাংলা ম্যানুয়ালই নেই! তারা শিখবে কোথা থেকে? তারা তো তেমন ইংরেজী জানেনা!!' এবার আমার আরো একদফা আশ্চর্য হবার পালা। আমি সন্মোহিতের মতোই বললাম, 'আশ্চর্য! তুমি এতকিছু ভেবেছ মাত্র নয়মাসেই! আমি তো এরকম বিষয়গুলো নিয়ে কখনও ভেবেও দেখিনি!' এবেন আমাকে সান্ত্বনা দেয়, 'আরে! তুমি তো ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনের লোক! তুমি এসব নিয়ে ভাবতে যাবে কেন?' তারপর আমাকে স্তব্ধ করে দিয়ে এবেন বলে যায়, 'তোমাকে একটা কথা বলি।

তোমার দেশে বেড়াতে এসে আমি আমার স্বপ্ন খুঁজে পেয়েছি। আমার স্বপ্ন হলো, আমি বাংলা ভাষায় একটা নার্সিং ম্যানুয়াল লিখব যেটা পড়ে এদেশের নার্সরা অনেক ভালোভাবে কাজ শিখতে পারবে। সেজন্য আমি বাংলা শিখে যাচ্ছি। ' ঠিক সেই মুহূর্তটায় আমি কিরকম অনুভব করেছি সেটা বলে বোঝাতে পারবনা। আমি ভীষন অসহায় বোধ করা শুরু কর।

আমি ফ্যালফ্যাল করে এবেনর দিকে তাকিয়ে থাকি, দেখতে পাই, তার দুচোখ জুড়ে একধরনের সুন্দর আলো, সেই আলো ঠিকরে বেরহচ্ছে আবার জন্ম নিচ্ছে, সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন লালন করলে মানুষের যেটা হয়। এদিকে এবেন কথা থামাচ্ছেনা, সে বলেই চলল, 'আমি যখন খুব বড় আর বিখ্যাত ডাক্তার হবো, তখন বাংলাদেশে 'ই.আর'এর মতো অত্যাধুনিক হাসপাতাল করব। এটা আমার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। ৩. এবেনের সাথে বাকীটা পথ আমার আরো অনেক কথা হয়, আজ তার অনেক কিছু মনেও নেই। তবে এটুকু মনে আছে যে ছেলেটালকে দেখছিলাম আর ঈর্ষাবোধ করছিলাম।

কি চমৎকারভাবে সে নিজের স্বপ্নকে খুঁজে পেয়েছে, কি করতে চায় সেই স্বপ্ন। বাংলায় একটা নার্সিং ম্যানুয়াল লিখবে; যারা হ্যানকরব, ত্যান করব বলে মনে মনে দুনিয়া উদ্ধার করে ফেলে তারা হয়ত শুনে ভাববে, 'এ আর এমন কি'। কিন্তু আমি জানি যেদিন এবেনের স্বপ্নটা পূরণ হবে সেদিন সে কিরকম অনভূতির মধ্য দিয়ে যাবে। আকাশ ছুঁয়ে দেখার অনুভুতি হবে তার, নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরে। আর আমার কি স্বপ্ন? অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো, বিরাট কোম্পানীতে চাকরী করব, অনেক বেতন হবে, গাড়ী হবে, বাড়ী হবে, এটাসেটা হাবিজাবি, কত কি! সেই মুহূর্তে নিজের এই করুণ দরিদ্র স্বপ্নগুলোর কথা ভেবে আমার ইচ্ছে হচ্ছিল স্বপ্নগুলোকে দুমড়ে মুচড়ে প্লেন থেকে বাইরে ফেলে দিই।

আমি খুঁজে দেখলাম, একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কি তৈরী করব তা নিয়ে আমার কোন সুনির্দিষ্ট স্বপ্ন নেই, আমার সব স্বপ্ন 'আমি কি হবো?', 'আমি কি পাব?' এসবকে ঘিরেই। আমি কি করব তা নিয়ে আমার স্বপ্ন তো দূরের কথা, কোন মাথাব্যাথাও নেই! প্রচন্ড অসহায় বোধ হচ্ছিল; মনে হচ্ছিল, যেন আমার কোন আসল অস্তিত্ব নেই! যেন এতদিন ধরে তিলেতিলে যে আমি গড়ে উঠেছি, সেটা পুরো অর্থহীন, লোভী, লক্ষ্যহীন, আনন্ধীন -- 'এ্যা ড্যাম ফাকিং লুজার'! ভাবলাম, বাংলাদেশ আর আমেরিকার শিক্ষাব্যাবস্থাই কি এরজন্য দায়ী? আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা এস.এস.সি অথবা এইচ.এস.সি পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করে, পত্রিকার পাতাজুড়ে তাদের ছবি ছাপা হয়, সেখানে সাক্ষাৎকারে তারা সগর্বে বলে, 'আমি কম্পিউটার প্রকৌশলী হবো' অথবা 'আমি ডাক্তার হবো' অথবা 'আমি বিজ্ঞানী হবো', এসব হ্যানত্যান। অথচ কেউ বলতে পারেনা সে কি করতে চায়! পত্রিকার সাংবাদিকরাও 'হওয়া'/'পাওয়া' নিয়েই ব্যস্ত। তারা শুধু জিজ্ঞেস করেন 'বড় হয়ে কি হতে চাও'; 'কি করতে চাও'টা কেউ জিজ্ঙেস করেননা। অথচ কিছু একটা না করে কিভাবে কিছু একটা হওয়া যায়? এবেনের সাথে আমার কয়েকঘন্টার কতঃায় মনে হয়েছে, 'হওয়াটা আসল না, করাটাই আসল।

করলে একদিন কিছু না কিছু হবেই। ' প্রতি বৎসর এস.এস.সি বা এইচ.এস.সি'র ফলাফল বের হলে আমি গভীর আগ্রহে পত্রিকা পড়ি, অধীর প্রতিক্ষায় থাকি যে এবার অন্ততঃ দেখব যে একটা ছেলে সাক্ষাৎকারে বলেছে 'আমি পানির আর্সেনিক দূর করার জন্য যন্ত্র বা মেডিসিন বানাতে চাই। ' আমার প্রতীক্ষার অবসান হয়না। আমরা সবাই খালি হতে চাই, হয়ে হয়ে ফাটিয়ে ফেলি চারদিক, আর কিছু করা হয়ে ওঠেনা। তবে এটা বুঝি যে ব্যাপারটা আমারও দোষ না, বা আমার মতো অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদেরও দোষনা।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাই দায়ী। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কোন ভিশন তৈরী করতে পারেনা, কোন নির্দিষ্ট পথ দেখাতে পারেনা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা বড় ধরনের পরিবর্তন ডরকার, বিপ্লব দরকার -- এটা ভেবেই এবেনের গল্পটা লিখলাম। আমার দেশে এসে সে কি সুন্দর স্বপ্ন পেয়ে গেছে, হয়ত এরই মাঝে সেই স্বপ্নের পথে সে অনেকদূর এগিয়েও গেছে, আর আমরা স্বপ্ন বানাতে পারিনা? এটা হয়না, এটা মানা যায়না। কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে বিদায় নেবার পালা এবেনের সাথে।

জাপানে বেড়াতে আসার জন্য বললাম, হ্যান্ডশেক করতে করতে মনে পড়ল আসল জিনিসটাই তো জানা হয়নি। জিজ্ঞেস করলাম, 'আচ্ছা ভ্রাতঃ, তোমার নামটাই তো জানা হলোনা!' 'আরে! তাইতো!' এবেন মুচকি হেসে বলল, 'আমার নাম এবেন। এটা আমার শেখা বাংলা প্রথম সেন্টেন্স। ' একমুহূর্ত আমার মনে হলো ছেলেটা বাংলাদেশকে নিয়ে কোন এক স্মৃতিতে বিভোর হয়ে গেছে। ফিরতে ফিরতে মনে হলো, আরে! ছেলেটার ফ্যামিলি নেমতো জানা হলোনা! আবার ভাবলাম, থাক! পরে আবার দেখা হলে জিজ্ঞেস করে নেব।

তখন হয়ত আবার নতুনভাবে অবাক হবো। পরেরবারের আড্ডার জন্য ফ্যামিলি নেমটা তুলে রাখলাম। -------------------------------------------------- [লেখাটি যায়যায়দিনে ছাপা হবার পর মজার ঘটনা ঘটতে লাগল। এবেনকে খুব ভালভাবে চেনেন এমন কয়েকজন আমার সাথে মেইলে যোগাযোগ করলেন। তারা জানালেন, এবেন এখনও বাংলাদেশের সাথে সংযুক্ত; ইন ফ্যাক্ট খুব ভালোভাবে সংযুক্ত।

কারণ বাংলাদেশেরই একটি মিষ্টি মেয়েকে সে বিয়ে করেছে, যার সাথে সে একসাথে কাজ করত। আমার অসম্ভব আনন্দ হতে লাগল, অসম্ভব আনন্দ। মনে মনে বলি, 'এবেন তোমার সবগুলো স্বপ্নপূরন হোক, তার সাথে সাথে তুমি এদেশের মানুষকেও স্বপ্ন দেখতে শিখিও। ']

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.