পরিবর্তনের জন্য লেখালেখি
খুব মনযোগ দিয়ে গল্পটা লেখা শুরু করি । নামটা খুব পছন্দ হয়েছে । প্লট্টা ঘুরছে মাথায় বেশ কয়দিন ধরে । একটু বিষন্ন প্লট । প্রথমে কবিতার আকারে এসেছিলো মাথায় , কিন্তু আজকাল এত ভালো আছি , আনন্দে আছি , এমন ফুর্তির ঈদ করছি , ছুটি কাটাচ্ছি - ইচ্ছাই হলো না যে একটা বিষন্ন একটা কবিতা লিখি! তার উপর কবিতার প্রথম প্যারা আর শেষ প্যারা লেখা হয়ে গেছে মাথায় ,কিন্তু মাঝখানের দেহ নিয়ে খেলার সময় পাচ্ছি না ।
যা ইচ্ছা তাই খেলা যায় । একে বলে খাঁচার স্বাধীনতা । সীমাবদ্ধ মুক্তি । খুব মজার ধারনা । স্রষ্টা এই ধারনা থেকেই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন বলে আমি বিশ্বাস করি।
দুই তিন দিন ধরে মাথায় খেলানোর পরে মনে হলো , নাহ শব্দরা অভিমান করছে । লেখা দরকার । বিষন্ন বলেই হয়ত, কবিতা না লিখে ,গল্প লেখা শুরু করলাম। গদ্য কবিতা থেকে সটান গদ্যে ।
“_____, একটু পানির হাড়িটা নামায় দিবা?”
তড়াক করে লাফিয়ে উঠি ।
মামণি ডাকছে । আমার মিষ্টি মামণিটা ঈদের আগে থেকে অসুস্থ । আজকে আমার শরীরটাও গাঁই গুঁই করছে দেখে রুম থেকেই বের হই নাই । চিন্তা নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলাম, আবার চিন্তা নিয়েই উঠেছি । প্রচন্ড উদাস ।
তারপর ব্লগে ঢুকে ডুবে গিয়েছিলাম গল্প লেখায় । ছিঃ ছিঃ ছিঃ । ভুলেই গিয়েছিলাম , ঈদের ৬ দিন আগে থেকেই কাজের লোক লাপাত্তা । প্রচন্ড খারাপ লাগে । তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে যাই ।
"যদি পারো , ভাতের হাড়িটা একটু ধুয়ে দিবা?"
আরে , পারবো না মানে ! বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠে । মা জানে ,আমি লিখছিলাম । মা জানে আমাকে কি থেকে উঠিয়ে নিয়েছে । বকতেও পারছে না , এতটা অসুস্থ ,অথবা বকতেই চাইছে না নাকি! আমার খুব ইচ্ছা করে বলি , মা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বকাবকি শুরু করো তো ! তোমার এই চেহারা দেখে আমি অভ্যস্ত না । পুরো বাড়ি নিঃস্তব্ধ কবর হয়ে আছে ।
একটু বকো , চিল্লাচিল্লি করো । কি করে বুঝি , এখনো বেঁচেই আছি ! ধুত্তারি!
আর লেখা হবে না গল্পটা । চিন্তার সূত্র একবার ছিড়ে গেলে আমি আর জোড়া দিতে পারি না । কেউ কেউ চিন্তা লেখক। আমি চিন্তা করে লিখতে পারি না কখনো ।
আমার হলো হঠাৎ করে মাথায় লাইনের পর লাইন আস আসা শুরু করবে । আমি পড়ি কি মরি করে লেখা শুরু করবো । লেখা হলে তো ভালো , না হলে চিরদিনের মত হারিয়ে যাবে লাইন গুলো । আর কোন দিনই কোন ভাবেই খুঁজে পাব না । রান্না ঘরের সব কয়টা হাড়ি পাতিল , থালা বাসনে সাবান ঘষতে ঘষতে একটু হাসি আমি ।
রাগ ইমন । কি হবে লিখে ! কি হবে শুরু করে ! কালকে নিজের অজান্তেই একটা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছো । সব লেখা মুছে ফেলাই উচিত । তুমি কোন দিনই লেখক হইতে পারবে না । কপালে নাই সোনা ।
মেয়েদের খুব বেশি স্বপ্ন দেখতে নেই । মাথার উপর দায়িত্ব নিয়ে । আমি জোরে হেসে উঠি ।
ভাত রানতে হবে । সবজি শেষ ।
আব্বু কি দিয়ে খাবে ? মাঝে একদিন বাড়ি ফিরে এসে দেখি আব্বু থালা বাসন মাজতে লেগেছে । লজ্জা শরম কিছু বাকি থাকলে এই দৃশ্য দেখা লাগতো না । এমন না যে ছেলেরা ঘরের কাজ করবে না ধরনের আজগুবি চিন্তায় আক্রান্ত । আব্বু সব পারে । রান্না , সেলাই ,কাপড়ে ধোয়া ।
কিন্তু , এই মানুষটা মাত্র ১২ বছর বয়স থেকে নিজের বাড়ি ছাড়া । লজিং থেকে, পড়িয়ে -পড়ে , সারা জীবন নিজের হাতে সমস্ত কাজ করে এসে এই বয়সে আমি থাকতে যদি তাকে বাসন ধুইতে হয় --- আমার জায়গা তো জাহান্নামেও হওয়া উচিত না । আরো খারাপ একটা দোযখ বানাইতে হবে আমাকে ভরার জন্য ।
লেখা চাঙ্গেই উঠলো তাহলে । আমি হাসতেই থাকি ।
আজকাল কাঁদি না। সব কিছুই ঠিক লাগে । সবটাই জীবন । সব কিছুতেই মজা পাওয়া শুরু করেছি । মন শান্ত ।
পুরাই শান্ত । কষ্ট হচ্ছে কিনা বুঝার চেষ্টা করি। নাহ ! সব ঠিক আছে । আমি হাসতে হাসতে সব ধুয়ে উঠাই । ভাত চড়াই ।
সবজি রান্না করার জন্য ফ্রিজ থেকে বের করি । রেডি করে এসে পোস্ট লেখা শুরু করি । নাহ । গল্প না । ওটা হারিয়েই গেছে ।
মা একবার এসে ঘুরে গেলেন। আবার দৌড় দেই। ভাত নামানো । গুছিয়ে টেবিলে দেওয়া । মা আড়চোখে একবার কি যেন বলতে গিয়েও বললো না ।
জানে , দেখানোর মত কিছু লিখলে আমি তাকে দেখাবো রাতে । এখন গুঁতিয়ে লাভ নেই । আমার সেরা , সবচেয়ে ভালো , সবচেয়ে প্রিয় লেখা গুলো কেউ পড়ে না আম্মু ছাড়া । আমি ব্লগে দেই না । আমি কাউকে পড়াই না ।
আম্মুকে দেখাই । আম্মু বহুবার ছাপানোর কথা বলে বলে ক্ষান্ত দিয়েছে । আগে ছিড়ে ফেলে দিতাম । আম্মু সারা ঘর টুকিয়ে এই অভিমানী , তীব্র অভিমানী মেয়েটার লেখা গুলোকে জড়ো করতো । তারপর আইকা , স্কচটেপ নিয়ে বসতো জোড়া দিতে ।
কত লেখা এভাবে হারিয়ে গেছে । কত গুলো জমা হয়েছে মামণির ভান্ডারে , আমি খবরও রাখি না। কত কবিতা পুড়িয়ে ফেলেছি । কত দিয়ে দিয়েছি বন্ধু বান্ধবীর প্রেমিক প্রেমিকাকে দেওয়ার জন্য । তাদের প্রেম দারুন সফল ।
আমি ব্যর্থ স্বপ্নবিলাসী । হা হা হা হা ।
মামনি কষ্ট পায় । খুব কষ্ট পায় । আব্বু রাগ করে কথাই বলে না এইটা নিয়ে ।
আমি বুঝি । মামনি শান্তি নিকেতনের স্কলারশীপ পাওয়া ছাত্রী । গান শিখতে যেতে পারে নাই শুধু এই সংসার নামক চক্রে আটকে । একই পরিণতি আমার বেলায় হইতে দিতে চায় না । গান তো কবেই ছেড়ে দিয়েছি ।
এখন আমি লিখতে বসলে তাই সাধারনত ডাকে না । আমাকে হাজার বার করে বলে , একটু সিরিয়াসলি লেখনা কেন? তুমি চেষ্টা করলে এত ভালো লিখতে পারো । আমি হাসতে থাকি ।
"মা, আমার বাজে লিখতেই ভালো লাগে। "
মা মুখ কালো করে ।
আমি আরো দুষ্টুমি করতে শুরু করি ।
"দেখো মা, এই ১৪ কোটি ভুখা নাঙ্গার দেশে খেয়ে পরে অভিজাত এলাকার বাড়িতে স্বচ্ছন্দ্য একটা জীবন যাপন করছি । আবার কবি হবো ? এত বেশি আশা করা কি ঠিক?"
"আপু, এইটা কোন কথা হলো! গড গেভ ইউ এ গিফট । তুমি ঐটা নষ্ট করবা ?"
ছোট বোন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে ।
আমি তর্ক এড়াই।
কয়দিন আগেই এক ভীষন প্রিয় বন্ধুকে বলছিলাম , "ঈশ ! রাজকবি ব্যাপারটা খুব ভালো ছিল গো ! আমাকে যদি কেউ শুধু কবিতা লেখার জন্যই বেতন দিত! আমি আর সারাজীবনে কিচ্ছু চাইতাম না । আমাকে মোটামুটি একটা ঘরে একটা রুটি আর একটা কলা দিয়ে বসিয়ে দিলেই চলবে । জানো , আমার সোনা দানা, শাড়ি - বাড়ির কোন নেশা নেই । এমন কি যেই গাড়ি আমার এত্ত পছন্দ , ওইটা না পেলেও চলবে । আমাকে শুধু একটু লেখার সুযোগ যদি কেউ করে দিতো !"
বন্ধুর কাছে উত্তর নেই ।
নেই আমার কাছেও । চাকরী আমি ছাড়তে পারবো না । এমন কি বড় লোক স্বামী পেলেও না । ন্যাডিনের পরিণতি হইতে কতক্ষন! ২২ তারিখ থেকে অফিস শুরু । তারপর সন্ধ্যায় সুইমিং আর জিম করতে হবে ।
শরীর ভেঙে পড়ছে নাইলে । তারপর ফিরে এসে রান্না করা , ঘর পরিষ্কার । আম্মুকে আর এই সবে রাখা যাবে না । সকালের নাস্তার দায়িত্বটাও নেওয়া দরকার । বোনটা বাইরের খাবার খেলে অসুস্থ হয়ে যায় ।
তার মানে ভোরে উঠে রান্না করতে হবে । বাহ ! তাইলে আর লিখবো কখন?
কালকে আরণ্যক যাযাবর একটা মন্তব্য করেছেন । এইখানে না গ্যাঁজায় সময়টা নিজের জীবনে কাজে লাগালেই তো হয় । ঠিক । কেন গ্যাঁজাই ? মেয়েদের , বিশেষ করে "মানুষ হিসেবে যাদের খারাপ মনে হয় না" - তাদের মত মেয়েদের লেখালেখির স্বপ্ন না দেখাই ভালো ।
মামণি কষ্ট পাবে । তাতে কি ! মামণি এখনো বোঝে না । কবিতা যারা ভালোবাসে , তারা বড় অভিমানী হয় । তারা বড় বেশি অভিমানী হয় । ছেড়া কাঁথায় শুয়ে কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখা ঠিক না ।
মা, আর তোমাকে পড়তে দেব না । ভালো মেয়েরা লেখে না । ভালো মেয়েরা ভাত পুড়িয়ে ফেলে না, কবিতা পুড়িয়ে ফেলে ভাত রাধে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।