আমি সত্য জানতে চাই
সামাজিক অবক্ষয়, মাদকের বিস্তার, কর্মহীনতা, আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকা, পর্নো ছবির অবাধ বিক্রি সর্বোপরি নারীর প্রতি পুরুষের হীন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতরা হয়ে পড়ছে অপ্রতিরোধ্য। যারা মাদক সেবন করে তাদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক বিকৃতি তৈরি হয়। এরপরই তারা নানা অনৈতিক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ধর্ষণের ঘটনা তার মধ্যে অন্যতম।
তাদের থামানোর যেন কেউ নেই। শিশু থেকে কিশোরী, যুবতী থেকে বৃদ্ধা, স্কুল ছাত্রী থেকে পোষাক কর্মী, ডাক্তার, আইনজীবী এমন কি ভিখারীনিও রেহাই পাচ্ছে না মানুষরূপী এসব হায়েনাদের হিংস্র থাবা থেকে। ধর্ষকরা শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত থাকছে না, ঘটনা ধামাচাপা দিতে ঘটাচ্ছে নৃশংস হত্যাকাণ্ড। দেশে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নারী ও শিশুরা। সম্প্রতি ভারতের যাত্রীবাহী বাসে ছাত্রী ধর্ষণের ভাইরাস ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশেও।
ধর্ষণের ক্ষেত্রে এটি নতুন সংযোজন। গতকাল মানিকগঞ্জে দিনে দুপুরে চলন্ত বাসে চালক ও ড্রাইভারের নির্মম ধর্ষণের শিকার হযেছেন এক পোষাক কর্মী। এছাড়াও আছে গণ ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ প্রবনতা। বাংলাদেশে ধর্ষণের মতো ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে মাদক বড় ভূমিকা পালন করে।
পুলিশ ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতাদের মতে, থানায় দায়ের হওয়া মামলা এবং পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে নারী ও শিশু ধর্ষণের প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে না।
অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনাই নির্যাতিতের পরিবার গোপনের চেষ্টা করে। কিন্তু এরপর যে তথ্য পাওয়া যায় সেটা ভয়াবহ। পুলিশ সদর দফতরের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত ৪ বছরে সারাদেশে ১২ হাজার ৯৭১ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল ৩ হাজার ৫৬৩টি ধর্ষণের ঘটনা। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ সালে ২ হাজার ৯৭৭টি ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে প্রকাশ হয়েছিল ৪৫৬টি।
২০১০ সালে ৩ হাজার ২৪৩ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হলেও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল ৫৫৯টি ঘটনা। ২০১১ সালে ৩ হাজার ৩৪৪টি ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল মাত্র ৭১১টি। আর ২০১২ সালে ৩ হাজার ৫১০ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল যা পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল মাত্র ১ হাজার ৮৩৭টি ঘটনা। মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থাগুলো দাবি করেছে, প্রকাশিত পরিসংখ্যান ধর্ষণসংক্রান্ত ঘটনার সুনির্দিষ্ট তথ্য নয়। প্রকাশিত এসব ঘটনার বাইরেও প্রচুর ঘটনা থেকে যায়, যা পরিবার এবং পারিপার্শিক কারণে অজানা থেকে যায়।
পুলিশ সদর দফতরও এ বক্তব্য সমর্থন করে বলেছে, অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনা পরিবার থেকে গোপন করা হয়। আবার কিছু ক্ষেত্রে পারিবারিকভাবে আপস-মীমাংসাও করা হয়। এ কারণে কখনোই ধর্ষণের প্রকৃত পরিসংখ্যান জানা যায় না। মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২০১০ সালে গণধর্ষণ করা হয়েছিল ৯০ নারী ও শিশুকে এবং হত্যা করা হয়েছিল ৬০ জনকে। ২০১১ সালে গণধর্ষণ করা হয়েছিল ৭৩ নারী ও শিশুকে এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল অন্তত ৭০ নারী ও শিশুকে।
আর ২০১২ সালে ধর্ষণের পর ৫৫ নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৩৮ নারী ও শিশু। এসময় ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে প্রায় অর্ধশত নারী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে। এসব পরিসংখ্যান দেখে শুধু এটুকু অনুমান করা সম্ভব, ধর্ষণের ঘটনা এই সমাজে কতটা মহামারী আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন গড়ে ৯ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে বিচারের আশায় থানায় মামলা করেন।
এর মধ্যে গড়ে ৪টি ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সচেতনতার অভাবেই বাড়ছে ধর্ষণের মতো ঘটনা। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে ধর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। এসব পরিবার সব সময়ই নানা ধরনের টানাপড়েনের মধ্যে থাকে। এর সুযোগ নেয় এক ধরনের নরপশুরা।
তারা সুযোগ বুঝে এসব পরিবারের শিশুদের নিজের কাছে নেয় এবং অবুঝ শিশুরা তাদের লালসার শিকার হয়। গত ১ আগস্ট লৌহজংয়ে ধর্ষণের শিকার হয় এক বাক-প্রতিবন্ধী। ওইদিনই ধর্ষিতার পরিবারকে হুমকি-ধমকি দিয়ে থানায় বসেই ঘটনার রফা করে ফেলেন স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা। গত বছরের ১ এপ্রিল রাজধানীর কাফরুল থানার ইব্রাহীমপুরে ২ বছর ৪ মাস বয়সী এক শিশুকে আদর করার নামে বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে স্থানীয় এক যুবক। ২০১১ সালে মোহাম্মদপুুরে টিভি দেখার জন্য ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করা হয় ৭ বছরের এক শিশুকে।
২১ জুন মীরসরাইয়ে ৬ বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। শুধু এ কয়েকটি ঘটনাই নয়, প্রতিনিয়ত রাজধানীসহ সারাদেশে ঘটছে এ ধরনের অনেক ঘটনা। তবে চলতি বছরের প্রথম থেকেই অতীতের তুলনায় অনেক বেশি ধর্ষণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি পিরোজপুরের নাজিরপুরে ৮ বছরের শিশু আঁখিকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। তার লাশ উদ্ধার করা হয় বাড়ির পাশের বাগানের ভেতর থেকে।
একই দিনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও ৪ জনকে ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়। শুধু ওই দিনই নয়, সারা বছরই বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা। রাজধানীসহ সারাদেশে ঘটে এ ধরণের নৃশংস ঘটনা। যেসব ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশ হয় তা প্রকৃত ঘটনার তুলনায় খুবই কম। এসব ঘটনার কিছু কিছু বিচ্ছিন্নভাবে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেলেও অধিকাংশই থেকে যায় আড়ালে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষিতা পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের সহযোগিতা না পাওয়ায় নিজেকে গুটিয়ে রাখে। কারণ কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলে সমাজ ওই নারীকেই ঘটনার জন্য দায়ী করে। খারাপ মেয়ে আখ্যা দিয়ে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় তাকে। ধরনের ঘটনায় অবশ্যই সবাইকে ওই নারীর পাশে দাঁড়াতে হবে। নির্যাতিত মেয়েটিকে সহানুভূতির সঙ্গে সমাজে পুনর্বাসন করতে হবে।
সবকিছু ঝেড়ে-মুছে সুন্দর আগামী গড়ার স্বপ্ন দেখাতে হবে মেয়েটিকে। পাশাপাশি ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করতে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। আর বিশেষভাবে নজর দিতে হবে কোনোভাবেই যেন ধর্ষিতাকে হয়রানির শিকার হতে না হয়।
সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে বেশিরভাগ নারীই বিচার চাইতে যান না। আবার যেসব নারী বিচার চাইতে যান, তাদের পুলিশ, প্রশাসন ও সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে যথেষ্ট হেনস্তা হতে হয়।
ধর্ষণের অভিযোগগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রমাণ হয় না। এর মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে ঘটনার তদন্ত প্রভাবিত হওয়া। যারা সমাজে প্রভাবশালী, তারাই ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজ করে থাকে। আর প্রভাবশালীদের পক্ষে থাকে এ দেশের পুলিশ প্রশাসন। যে কারণে মামলা তদন্তের সময় আলামত নষ্ট হয়।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুলিশ ধর্ষিতার মামলা গ্রহণ করে না। উল্টো ভিকটিমকে হয়রানি করেন এমন অভিযোগও পাওয়া যায়। তাছাড়া স্থানীয় মাতব্বর, মেম্বার, চেয়ারম্যান বা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা এসব ঘটনা আড়াল করে রাখে। তারা বিচার করতে দেয় না। আর অধিকাংশ ঘটনায় ধর্ষক প্রভাবশালী হওয়ায় তারা অপরাধীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিষয়গুলো ধামাচাপা দেয়।
এ কারণে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তি না হওয়ায় দিন দিন সমাজে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে।
যদিও সরকার ভায়বহভাবে বেড়ে যাওয়া নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ঘৃণ্য এই বর্বরতার সঙ্গে জড়িত নরপশুদের শাস্তি নিশ্চিত করতে দিন কঠোর আইন করছেন। তবে ওই আইনের ফাঁকফোকরে বরাবরই তারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না তাদের কৃতকর্মের শাস্তি। তাই উদ্বেগ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে ধর্ষণের ঘটনা।
দেশে ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের যে অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণে সরকারের একটি গভীর পর্যবেক্ষণ দরকার। দেশে যেন এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে জন্য নেওয়া দরকার কার্যকর উদ্যোগ। কারণ প্রত্যেক নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
এ ছাড়া এ সমাজকে 'নারীবান্ধব সমাজ' হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারকে নিতে হবে উচ্চ পরিকল্পনা। এ জন্য স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে।
তাহলে নারী ও শিশুরা নিরাপদ থাকবে। একে শুধু নারীর প্রতি সহিংসতা না ভেবে পারিবারিক সহিংসতা হিসেবেও বিবেচনা করতে হবে। ঘটনার শিকার নারীর পাশে দাঁড়িয়ে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কারণ একজন নারী যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন তার পুরো পরিবার এ ঘটনাটি নিয়ে ভোগান্তিতে পড়ে। তাই ধর্ষণের মতো বর্বর ঘটনা নির্মূল করতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন।
সচেতন করে তুলতে হবে সাধারণ মানুষকে। তাদের বোঝাতে হবে ধর্ষিতা নয়, ধর্ষককে ঘৃণা করতে হবে। মনে রাখতে হবে ধর্ষকের কোনো দল নেই, গোষ্ঠী নেই। পরিবার-পরিজন নেই। এরা আলাদা শ্রেণী, মানুষরূপী হায়েনা।
সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে এসব নরপশুকে। শুধু আইন প্রণয়ন করেই নরপশুদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এ জন্য প্রয়োজন আইনের সঠিক প্রয়োগ। নিশ্চিত করতে হবে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আমরা আগামী দিনগুলিতে আর একটিও নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাইনা।
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকলে কোনো নারীই এসব হায়েনা কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হবে না। আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি এই বিশ্বাস হারাতে চাইনা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।