চিংড়ি ভর্তা আর ঝাল করে রান্না কৈয়ের ঝোলের দিকে বোতল মামা যেভাবে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকালেন তাতে মনেই হয় না কোনো এলিয়েন টেলিয়েন আসবে। পায়েলেরও মনে হচ্ছে এলিয়েনের ভয় নিয়ে মন খারাপের কিছু নেই। কতো এলিয়েন আসবে যাবে! কিন্তু মজার মজার খাবারতো সবসময় আসবে না।
বোতল মামা গোগ্রাসে গেলা শুরু করেছেন। পায়েলের বাবা জনাব ইফতেখার আহমেদ এখনো অফিস থেকে ফেরেননি।
তিনি থাকলে বোতল মামা কিছুটা ভদ্রভাবে খেতেন। পায়েলেরও মনে হচ্ছে বোতল মামা মোটেও বিজ্ঞানী নন। তিনি শুধু খাওয়াই শিখেছেন। তবে কে কীভাবে খাচ্ছে তাতে কোনো মাথাব্যথা নেই বেগম শান্তনা খানমের। পাশে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের খাওয়া দেখছেন আর মাঝে মধ্যে হাই তুলছেন।
দুপুরের খাওয়ার পাট চুকে গেলে আরামসে ঘুমানো যাবে।
খাওয়া শেষ হতেই আবার দুজনের মাঝে চাপা উত্তেজনা ভর করলো। দুজন মানে বোতল মামা ও তার দশ বছর বয়সী ভাগ্নি পায়েল।
বিকেল হতে এখনো ঘণ্টা দুই বাকি। তবু রোদের তেজ নেই।
দুজনই এখন ছাদে। পায়েল চকচকে দৃষ্টিতে মামার হাতের ছোট বাক্সটার দিকে তাকিয়ে আছে। বোতল মামা ছাদে বসে একটা পুরনো টিভি নিয়ে খুটুর খাটুর করছেন। পায়েলদের স্টোররুম থেকে উদ্ধার করা। তবে বোতল মামার হাতে যেহেতু পড়েছে, টিভিতে একটা কিছু দেখা যাবে বলে একশভাগ নিশ্চিত পায়েল।
ছাদের একপাশে তিনকোণা স্ট্যান্ডের ওপর বসানো আছে মামার সেই বিখ্যাত টেলিস্কোপ। এর আগেরবার ওটা দিয়ে পায়েল দূরের একটা গ্রহ দেখেছিল। সেই গ্রহে আবার জিরাফ আর গরুর মাঝামাঝি একটা প্রাণীও আছে। পায়েল সেই প্রাণীর নাম রেখেছিল জিরু। তবে এবার টেলিস্কোপে চোখ রাখতে নিষেধ করেছেন মামা।
হাতের ছোট বাক্সটা পায়েলের দিকে বাড়িয়ে মামা বললেন, 'এটা হলো তেপান্তর। ' 'ও এটাই সেই কম্পিউটার। কিন্তু এর মধ্যেতো কিছুই নেই!' মামা ভ্রূ কুঁচকে পায়েলের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তুই দেখি মহাবোকা! কম্পিউটার মানে কি ওই মাথা মোটা বাক্স আর মনিটরটাকেই বোঝায়! গাধা এ বাক্সটায় প্রসেসর, মেমোরি, গাণিতিক যুক্তি সবই আছে। আর আর আর...। '
'আর কী মামা?' পায়েলের কণ্ঠে তেমন অভিমান নেই।
মামা প্রায়ই তাকে গাধা টাধা বলে। অনেক কিছু জানে না তো তাই। এতে সে বিশেষ কিছু মনে করে না।
মামা কিছুটা আমতা আমতা করে বললেন, 'এটা পৃথিবীর সবচে দ্রুতগতির সুপার কম্পিউটার। সেকেন্ডে ৫ লাখ ট্রিলিয়ন হিসেব কষতে পারে।
' অনেক কষ্ট করে এতোক্ষণ হাই চেপে রেখেছিল পায়েল। কম্পিউটারের গতির এ অদ্ভুত হিসেব শুনে হাই না তুলে পারলো না। হা করেই জিজ্ঞেস করলো, 'ট্রিলিয়ন মানে কি?'
মামা আবার টিভিতে মন দিলেন। খুটখাট করতে করতেই বললেন, দশ হাজার কোটিতে এক ট্রিলিয়ন। একের পর বারোটা শূন্য বসাতে হয়।
১ লাখ ট্রিলিয়ন মানে একের পর ১৯টা শূন্য। আর ৫ লাখ ট্রিলিয়ন মানে পাঁচের পর ১৯টা শূন্য। পায়েলের ঘুম উধাও। মামা বলে কি! এই বাক্সটা যদি এতো দ্রুত অংক কষতে পারে তাহলে তার কেন একটা সুদকষা করতে দশ মিনিট লাগে! নাহ্ তেপান্তরের গতিটা সত্যিই অবিশ্বাস্য!
বোতল মামার কাজ বোধহয় শেষের দিকে। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঝাড়তে লাগলেন।
টিভিটা এখনো বন্ধই আছে। তার ঠিক পাশে রাখা তেপান্তর।
মামা পকেট থেকে পাতলা একটা কাপড় বের করলেন। পায়েল দেখেই বুঝলো এটা সাধারণ কাপড় নয়। কারণ মামা কাপড়টা বেশ যত্ন করে ছাদে বিছিয়ে দিচ্ছেন।
এবার বুঝতে পারলো পায়েল। কাপড়টা আসলে একটা কিবোর্ড। তাতে এবিসিডি ওয়ান টু সবই আছে।
টিভির সুইচ অন করলেন বোতল মামা। টিভিতে আপাতত নীল রং ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
পায়েলের দিকে না তাকিয়েই মামা বললেন, 'এলিয়েন দেখবি এবার! আসল এলিয়েন! সিনেমার না। ' পায়েল বুঝতে পারলো ওই টেলিস্কোপটা দিয়েই এলিয়েনের ছবি টিভিতে আসবে। আর মাঝের যতো হিসেব নিকেষ আছে সে সব করবে তেপান্তর।
এরই মধ্যে বোতল মামা ঝড়ের গতিতে কিবোর্ডে আঙ্গুল বুলোতে লাগলেন। টিভির নীল রং উধাও।
কালো হয়ে আছে। তবে পুরোপুরি কালো না। তাতে বিন্দু বিন্দু সাদা রংও দেখা যাচ্ছে। আরেকটু গভীরভাবে তাকাতেই ব্যাপারটা বুঝে গেল পায়ের। সাদা বিন্দুগুলো হচ্ছে তারা।
আর টিভিতে দেখা যাচ্ছে বাইরের মহাকাশ।
কিন্তু দেখতে রাতের আকাশের মতো মনে হচ্ছে কেন? আকাশেতো এখনো সূর্য আছে। মামার কথাতেই পায়েল উত্তর পেয়ে যায়। 'আমরা এখন কয়েক হাজার আলোকবর্ষ দূরের দৃশ্য দেখছি। অর্থাত যা দেখছি তা কয়েক হাজার বছরের পুরনো।
তারাগুলোর আলোই দেখা যাচ্ছে শুধু। ' এটুকু বলেই বোতল মামার আবার কিবোর্ডে আঙ্গুল চালালেন।
টিভিতে ঝকমকে অনেক কিছুই ভেসে উঠছে। পায়েল মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না। একটু পর হুট করে টিভিতে নিকষ কালো অন্ধকার।
মনে হবে যেন বন্ধ হয়ে গেছে। বোতল মামার চোখে চিন্তার ছাপ। পায়েল মনে মনে ভাবলো, ইশ্ এ মুহূর্তে এক কাপ চা হলে সব মুশকিল দূর হয়ে যেত। কিন্তু মা ঘুমুচ্ছে। বলতে গেলে...।
নাহ্ পায়েল তার মামার জন্য কিছুই করতে পারছে না।
এদিকে মামার চিন্তা আরো গাঢ়তর হচ্ছে। পায়েল সাহস করে বলেই ফেলল, 'মামা চা খাবে?' মামা একবার মাথা তুলে তাকালেন। কিছু বললেন না। তারপর মাথা ঝাঁকি দিয়ে বললেন, 'ধরা খেয়ে গেছি।
ওরা জেনে গেছে সবকিছু। ' 'কী জেনেছে?'। মামা বললেন, 'এই যে ওদের দেখে ফেলেছি, এটাই জেনে গেছে। এখন আর চা খেয়েও কিছু হবে না। ওদের গতি যে হারে বাড়ছে তাতে এক দিনের মধ্যেই পৃথিবীতে চলে আসবে।
টেলিস্কোপটাও কোনো সিগনাল পাঠাতে পারছে না। ওরা এখন সংখ্যায় অনেক বেশি। ' মামা এবার হাতঘড়িতে তাকালেন। তবে সময় দেখার জন্য নয়। ডিজিটাল ঘড়িটার পর্দায় হিজিবিজি অনেকগুলো সংখ্যা আর চিহ্ন।
যার মানে কেবল বোতল মামাই বুঝবে। পায়েলের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, 'বুঝলি সব কুছ খতম। সব শেষ। এবার পৃথিবীর মানুষ বুঝবে, কতো চালে কতো ধান। '
পায়েলের মনে তাও ভয় টয় ঢুকছে না।
বোতল মামা সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। এলিয়েনের হালুয়া তিনি ঠিকই টাইট করবেন। শুধু এক কাপ চা হলেই হলো। আর হাতে আস্ত একটা দিনতো আছেই।
টিভি পর্দায় হুট করে আবার কি যেন দেখা গেলো।
দুজনেই একসঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। তাতে গোল গোল কি যেন দেখা যাচ্ছে। মামা হুড়মুড়িয়ে কিবোর্ডে টাইপ করা শুরু করলেন। তেপান্তরের ভেতর থেকে শোঁ শোঁ শব্দ বেরোচ্ছে। তারমানে সে হিসেব করার মতো কিছু পেয়েছে।
মামার চোখেমুখে ফাটাফাটি উত্তেজনা। পায়েলও পলক ফেলছে না। এমন সময় মামার হাতঘড়ি থেকে মৃদু শব্দ শোনা গেলো। শব্দটা কেমন যেন পানির স্রোতের মতো। মাঝে মাঝে টুপটাপ শব্দও শোনা যাচ্ছে।
পায়েলের গা শিউরে উঠলো। তার মানে সত্যিই সত্যিই এলিয়েনগুলো পানির মতো।
টিভি পর্দায় এলিয়েনদেরই দেখা যাচ্ছে। অনেকগুলো পানির ফোঁটা। মাঝে মাঝে সবগুলো মিলে একটা ফোঁটা হয়ে যাচ্ছে।
আবার হুট করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মেঘের মতো কালো হয়ে যাচ্ছে।
মামা কিবোর্ড থেকে হাত উঠিয়ে নিলেন। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন হাতঘড়ির দিকে। তাতেই মনে হয় লুকিয়ে আছে সব রহস্য।
পায়েলও উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো।
পানির শব্দটা ক্রমশ বাড়ছে। মামা এবার আতংকিত চোখে তাকালেন টেলিস্কোপটার দিকে। এমন সময় যা ঘটলো তাতে অল্পের জন্য জ্ঞান হারায়নি পায়েল। মামার হাতঘড়ি থেকে ভয়ংকর একটা অট্টহাসি শোনা গেল।
ঠিক যেন খেকশিয়ালের হাসি। পায়েল ভয় পেয়ে দুকদম পিছিয়ে গেলো, মামা! মামা পায়েলের দিকে তাকিয়ে হাত ইশারায় চুপ থাকতে বললেন। ঘড়ি থেকে এবার যা শোনা গেলো তার জন্য দুজনের কেউই প্রস্তত ছিল না। কে যেন হঠাত গর্জে উঠে বলল,
'শোনো হে বিজ্ঞানী! আশা করি তুমি আমাদের ভাষা এতোক্ষণে অনুবাদ করতে পেরেছো। আমরা কল্পনাও করিনি যে পৃথিবীর মতো তুচ্ছ একটা গ্রহের তুচ্ছ মানুষরা আমাদের অস্তিত্ব এতো সহজে টের পাবে।
তোমার বুদ্ধি সত্যিই প্রশংসনীয়। ' মুহূর্তের মধ্যে পায়েলের কিছুটা গর্ব অনুভব করলো। যাক এলিয়েনগুলো অন্তত বোতল মামাকে চিনতে পেরেছে। যাই হোক, এলিয়েনের কথা মন দিয়ে শোনাটাই এখন আসল কাজ।
'তুমি যা করেছ তা অভাবনীয় হলেও আমরা তাতে মোটেও সন্তুষ্ট নই।
তুমি আমাদের কাছে শক্তিশালী রেডিও তরঙ্গ পাঠিয়েছো। যা আমরা চরম মাত্রার অপরাধ বলে জানি। তার শাস্তি তোমাকে পেতে হবে। হা হা হা। তবে শুধু তুমি কেন! তোমাদের অন্য চুনোপুটি বিজ্ঞানীগুলো আমরা পানির মতোই গিলে ফেলবো।
হা হা হা। সবাইকে পানি বানিয়ে আমাদের দলে নিয়ে নেব। তোমরা আমাদের সঙ্গে গড়িয়ে চলবে অনন্তকাল। হা হা হা। '
মামার মুখ দেখে মনে হচ্ছে পারলে এখুনি কাচা লংকা দিয়ে এলিয়েনের ঝোল বানিয়ে খায়।
এলিয়েনের কথা শেষ হলেও পায়েলের ভয় এখনো কাটেনি। সে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এলিয়েনগুলো তাকেও পানি বানিয়ে দেবে বলেছে। 'পানি হয়ে গেলে কি সবাই মরে যাবে?' পায়েলের প্রশ্নটা মামা বোধহয় শুনতেই পেলেন না। তিনি জিনিসপত্র গোছাতে ব্যস্ত।
সময় বেশি নেই। তেপান্তরের দেয়া হিসেব মতো কাটায় কাটায় আঠার ঘণ্টা বাকি। তারপরই পৃথিবীর আকাশ ছেয়ে যাবে ঘন কালো মেঘে। টুপটাপ করে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়বে এলিয়েন। নদী-নালা, ছাদ, পুকুর সব এলিয়েনে ভর্তি হয়ে যাবে।
কিচ্ছু করতে পারবে না কেউ। বোতল মামা মহা চিন্তিত। আর যাই হোক তিনি তো এলিয়েনের খবর আগেই জেনেছেন। পায়েলের মনে হলো, পুরো পৃথিবীটা এখন বোতল মামার দিকে তাকিয়ে আছে। মামা কি পারবে এ মহাসঙ্কট থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে?
সন্ধা পেরিয়ে গেছে।
পায়েলের পরীক্ষা শেষ হয়েছে গতকাল। তাই পড়ার কোনো চাপ নেই। বিদ্যুত না থাকায় টিভিও দেখতে পারছে না। আপাতত বোতল মামার সঙ্গে ঝাল মুড়ি খাচ্ছে। বিকেলের পর থেকে মামা একদম চুপ মেরে গেছেন।
পায়েলের মা দুয়েকবার 'কি হয়েছে' জিজ্ঞেস করলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি। পায়েলও মামাকে ঘাটাচ্ছে না। মামার এখন চিন্তার সময়। (আসিতেছে... বাকি অংশ...)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।