সকাল ৮টা। ছাদে সবকিছু ফিট করা শেষ হয়েছে। দুটো বড় বড় অ্যান্টেনা ছাড়াও রয়েছে একগাদা হাঁড়ি-পাতিল। পায়েলের মাকে অনেক কষ্টে বোঝাতে হয়েছে যে, হাঁড়ি-পাতিলগুলো অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি বলে সেগুলো অ্যান্টেনা হিসেবে কাজ করবে। পায়েলের মা ধরেই নিয়েছেন তার ভাইয়ের মাথা পুরোটাই গেছে।
পায়েলের ভীষণ আফসোস হলো, তার মামা পুরো পৃথিবীকে বাঁচাতে যাচ্ছে অথচ কেউ তা টেরই পাবে না। মামার অবশ্য এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। বুদ্ধিটা কাজে আসলেই তিনি খুশি। পায়েলের বাবা দুবার ছাদে এসে শ্যালকের কীর্তি দেখে গেছেন। তবে কিছু বলেননি।
শুধু ইলেকট্রিক তারগুলো থেকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
রাতে নিজের রুমে বসেই মামা স্টোররুমের পুরনো রেডিও আর পাখা দিয়ে বিদঘুটে একটা যন্ত্র বানিয়েছেন। সেটা চালাতেই বিদ্যুতের সংযোগ দিতে হয়েছে।
ভোররাতে মামার কথামতো ঘণ্টা তিনেক ঘুমিয়েছিল পায়েল। তবে উত্তেজনায় ঘুম ভাঙতে দেরি হয়নি।
পায়েলের বাবা ইফতেখার আহমেদ টিভিতে খবর দেখছেন। বিবিসির সংবাদপাঠক ইংরেজিতে হড়বড় করে একগাদা কী যেন বলছে। মামাও উঁকি দিয়ে একবার খবরে চোখ বুলোলেন। সংবাদপাঠকের চোখ যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। মারাত্তক উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে।
পায়েল পুরোপুরি না বোঝায় মামার কাছে খবরের বাংলা তরজমা শুনছে। মামা বললেন, 'বুঝলি এতোক্ষণে নাসার গবেটগুলো খবর পেয়েছে। কিন্তু তাদের কিছু করার নেই। এলিয়েনরা তাদের স্যাটেলাইটগুলোকে ঝালমুড়ির মতো চিবিয়ে খেয়েছে। চাইলেও আর রকেট ওড়াতে পারবে না।
সবগুলো হাঁদারাম। '
টিভির খবর যে পড়ছে তার জন্য পায়েলের বেজায় দুঃখ হলো। ইশ বেচারা কী ভয়ই না পাচ্ছে! সে যদি একবার বোতল মামার বুদ্ধির কথা জানতো তাহলে ব্যাঙাচীর মতো লাফাতো না।
৯টা বাজে। তেপান্তরের হিসেব অনুযায়ী পৃথিবীর কক্ষপথে এলিয়েন পৌঁছাতে আর ৩০ মিনিট ১০ সেকেন্ড বাকি।
তারপরই শুরু হবে যুদ্ধ। আকাশভর্তি এলিয়েন বনাম একজন মানুষ।
ইফতেখার আহমেদ বোতল মামার দিকে ঘাড় উঁচিয়ে তাকালেন। তাকে কেমন যেন হতভম্ব দেখাচ্ছে। তিনি কিছু বলার আগেই বোতল মামা বললেন, 'বুঝলেন দুলাভাই, জীবনটা রাজনীতির মতো।
একেবারে আনপ্রেডিক্টেবল। ' পায়েল চোখ কুঁচকে মামার দিকে তাকালো। মামা তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, 'আনপ্রেডিক্টেবল মানে যা অনুমান করা যায় না। এখন চল আমার সঙ্গে। এলিয়েনের সঙ্গে ফাইটটা খালি চোখে না দেখলে মজা পাবি না।
'
অন্যসময় হলে ইফতেখার আহমেদ শ্যালকের এ ধরনের দার্শনিক টাইপের কথা শুনে ভয়ংকর বিরক্ত হতেন। কিন্তু এখন তাকে কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে। আসন্ন বিপর্যয়ে তার বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। তবে বরাবরের মতো এবারও নির্বিকার রয়েছেন পায়েলের মা মিসেস শান্তনা খানম।
আর পনের মিনিট বাকি।
মামা ঘড়ি দেখে বললেন, 'ওরা এখনো দুই লাখ মাইল ওপরে। ভাগ্যিস চাঁদের দিকে নজর দেয়নি। তা না হলে চাঁদটাকে আজীবনের জন্য হারাতে হতো। অতোদূর পর্যন্ত আমার অস্ত্র কাজ করতো না। ' পায়েলও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
সে ভাবছে, 'ইশ্ চাঁদ থাকতে আমরা চাঁদের মর্যাদা বুঝি না। শুধু দাঁত নিয়েই পড়ে থাকি। '
এমন সময় ঘটলো বিপত্তি। বিপত্তি না বলে বরং মহাবিপদ বলাই ভালো। কারণ এ বিপত্তির সঙ্গে পুরো পৃথিবীর ভবিষ্যত জড়িত।
তবে বোতল মামা এখনো বিপদ সম্পর্কে জানতে পারেনি। সময়মতো পায়েলই বিপদটা জানতে পেরেছে।
মামার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, 'মামা! বিদ্যুত চলে গেছে। লোডশেডিং!' মামার কানে যেন বাজ পড়েছে। 'বলিস কীরে!' বলেই ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি।
বোতল মামাকে এখন ঠিক সেই সংবাদপাঠকের মতোই দেখাচ্ছে। 'বিদ্যুত ছাড়াতো ওয়েভ গান (রাত জেগে তৈরি করা কালো বাক্সটা) চলবে না!' মামা দ্রুত ঘড়ি দেখলেন। 'দশ মিনিট!' পায়েলের কেমন যেন কান্না কান্না পাচ্ছে। এলিয়েনের ভয়ে না। বোতল মামার অসহায় চেহারা দেখেই তার খারাপ লাগছে।
ইশ্ এসময় সে যদি কিছু একটা করতে পারতো!
বুদ্ধিটা হুট করেই মাথায় এলো পায়েলের। কিন্তু ইয়াহু বলে যে লাফ দেবে সে সময়টুকু নেই। বোতল মামা এখনো ঝিম ধরে চোখ বুঁজে বসে আছেন। পায়েল একছুটে ছাদ থেকে নেমে নিজের রুমে গেল। একবার শুধু মাথা এদিক ওদিক নাড়লো।
সময় নষ্ট না করে ছোটাছুটি শুরু করলো।
আর মাত্র ৫ মিনিট বাকি। বোতল মামার ধ্যান এখনো ভাঙছে না। এমন সময় পায়েল ছাদে এলো। হাতে কী যেন আঁকড়ে ধরে আছে।
'মামা!'। ডাক শুনেই ফিরে তাকালেন বোতল মামা। মুখে ধীরে ধীরে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
পায়েলের হাতে অনেকগুলো ছোট ছোট ব্যাটারি। সবগুলো খেলনা থেকে খুলে এনেছে।
তার সবগুলো খেলনা চলে পানি দিয়ে। ব্যাটারিগুলো তাই অতই রয়ে গেছে। মামা ঘড়ি দেখে সময় নষ্ট করলেন না। পায়েলের হাত থেকে ব্যাটারিগুলো নিয়ে ঝটপট কালো বাক্সটার পাশে গিয়ে বসলেন। বিদ্যুতের তার খুঁজে পেতে সমস্যা হয়নি।
বাক্সটার ডালা খুলে ব্যাটারিগুলোকে সটাসট ঢুকিয়ে দিলেন ভেতরে। ভেতর থেকে দুটো তার বের করে পেঁচিয়ে দিলেন বাক্স থেকে বের হওয়া তারের সঙ্গে। 'দেড় ভোল্টের দশটা ব্যাটারি, কাজ করতেও পারে। ' বিড়বিড় করে বললেন মামা। 'এক মিনিট!' পায়েল চিতকার ছুড়লো।
সে হা করে তাকিয়ে আছে আকাশে।
বলা নেই কওয়া নেই হুট করেই কেমন যেন বিকেলের মতো আঁধার নেমে এসেছে। মৃদু গর্জন বলে দিচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে দমকা বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টি আসতে পারে। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে রাস্তায় মানুষের ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে।
বোতল মামা কপাল কুঁচকে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন।
পায়েলের মনে হচ্ছে সময়টা থেমে গেছে। ছাদে শুধু পায়েল আর বোতল মামা। বোতল মামার হাতে একটা রিমোট কন্ট্রোলার টাইপের বাক্স। দেখতে মোবাইলের মতো। অনেকগুলো বাটন।
পায়েলের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'এসে গেছে, ওরা এসে গেছে!' বলেই রিমোটের একটা সুইচে আলতো করে চাপ দিলেন।
কালো বাক্সটা যেমন ছিল তেমনই আছে। কোনো শব্দ নেই! মামা হা করে তাকিয়ে আছেন বাক্সটার দিকে। পায়েল চোখ বুঁজে ফেলল। এমন সময় দ্বিতীয়বারের মতো বাজের শব্দ শুনতে পেল দুজন।
বোতল মামা দৌড়ে বাক্সটার কাছে এলেন। এবার বাক্সের খুব কাছে রিমোটটা এনে বাটনে চাপ দিলেন। প্রথমে খুব মৃদু শোঁ শোঁ শব্দ হলো। একটু পরই তা গম্ গম্ করতে লাগল।
'কাজ হয়েছে মামা?' বোতল মামার মুখে কথা নেই।
তিনি এর আগে শুধু শুধু অনেকবার হেসেছেন। এবার হাসি নয়, কাজেই প্রমাণ করতে হবে।
কালো বাক্সটাকে কিছুটা সরিয়ে রাখলেন বোতল মামা। রিমোটে পরপর কয়েকটা বাটনে চাপ দিলেন। তৃতীয়বার বাজ পড়ার শব্দ।
আর একটু পরই ঝরতে থাকবে পানির ছদ্মবেশধারী এলিয়েন। বাজ পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কালো বাক্সের মাঝামাঝি জায়গা থেকে বেরিয়ে এলো নীলচে আলো। সোজা উঠে গেল উপরে। পায়েল শ্বাস ফেলতে ভুলে গেছে। বোতল মামাও দুহাত ভাঁজ করে ভদ্রলোকের মতো উপরের দিকে তাকিয়ে আছেন।
নীল আলোটা উঠলো অনেক দূর। সেটা কয়েক মাইলও হতে পারে। তারপর সেকেন্ডের মধ্যেই সেই আলো ছড়িয়ে পড়লো ব্যাঙের ছাতার মতো। পুরো আকাশে এখন শুধু গাঢ় নীল আলো। আলোর জন্য মেঘই দেখা যাচ্ছে না।
পায়েল নীচে তাকিয়ে আরো অবাক হয়ে গেলো। পুরো শহরটাই নীল হয়ে গেছে। অদ্ভুত কিন্তু সুন্দর। পায়েল আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে নীল শহর দেখতে ব্যস্ত। বোতল মামা এ ফাঁকে আরো কয়েকবার বাটন টেপাটেপি করেছেন।
এমন সময় মামার হাতঘড়ি থেকে ভেসে এলো এলিয়েনের কণ্ঠস্বর। তবে এলিয়েনের গলায় আগের সেই তেজ নেই। এলিয়েন বলছে, 'হে পৃথিবীর মানুষ, তুমি মহাজাগতিক আইন ভঙ্গ করিতেছ। আমাদের ধ্বংস করিবার কোনো অধিকার তোমার নাই। তুমি তোমার যন্ত্র বন্ধ করিয়া দাও।
আমরা ভাঙিয়া যাইতেছি। আমরা ধ্বংস হইতেছি। আমরা...'। ব্যাস্ থেমে গেলো এলিয়েনের গলা। শোনা গেল পায়েলের হাততালি।
বোতল মামা কিছুটা উদাস ভঙ্গিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। এলিয়েন আকুতি তার এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বের হয়ে গেছে।
দুই ঘণ্টা পর। আকাশ একদম পরিষ্কার। কোথাও এক ফোঁটা বৃষ্টিও হয়নি।
বোতল মামা আর পায়েলের বাবা টিভি দেখছেন। টিভির সংবাদপাঠক ইংরেজিতে হড়বড় করে যা বলল তার বাংলা মানে দাঁড়ায়, 'নাসা আজ আকাশে অদ্ভুত এক সঙ্কেত পেয়েছে। পুরো পৃথিবীতে একযোগে বৃষ্টি হতে গিয়েও হয়নি...মেঘগুলো ছিল ভয়ংকর... বাংলাদেশ থেকে এক অদ্ভুত আলোর সঙ্কেত পাওয়া গেছে। তবে ঠিক কোন অঞ্চল থেকে আলোটা এসেছে তা জানা যায়নি...। '
অন্যদিকে পায়েল তার বন্ধুদের সঙ্গে বোতল মামার বীরত্বের গল্প করতে ব্যস্ত।
'জানিস, মামার ভয়ে এলিয়েনগুলো সাধু ভাষায় কথা বলা শুরু করলো, বলে কিনা, হে মামা, আপনার পায়ে ধরি, মাফ করিয়া দেন'। বিশ্বাস করুক আর নাই করুক পায়েলের বলার ভঙ্গি দেখে সবাই না হেসে পারলো না।
(অচিরেই আসছে বোতল মামার আরেক অ্যাডভেঞ্চার.. 'মিশন মঙ্গল')
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।