নুতন পদ্ধতিতে আয়কর-মুসক আদায়ের প্রস্তাব
প্রতি বতসরই বাংলাদেশে আজ পালিত হয় আয়কর দিবস । এই উপলক্ষে সেমিনার হয়, রালি হয়, বক্তৃতা হয়, আর টিভি টক তো আছেই । এসব জায়গায় যা বলা হয় তা হলো, জনগনের আরো বেশী বেশী আয়কর দেয়া দরকার, আগের চেয়ে আয়কর প্রদানের হার বেড়েছে (যেহেতূ জনসংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে তাদের আয়, তাই এটা তো বাড়বেই), এর পরেই বলা হবে, এটা আরো বাড়ানোর সুযোগ আছে । আয়্কর বিভাগের লোকজন বলবেন, জনবল এবং সু্যোগ সুবিধে পেলে তারা এটা আরও বাড়াতে পারতেন, সুযোগ সন্ধানীরা বলবেন মাত্র কয়েক বিলিওন টাকার কম্পিউটার আর সফটওয়ার আনা গেলে ব্যাপারটা একেবারে জলের মতন সহজ হয়য়ে যেতো, ইত্যাদি ইত্যাদি । শেষের প্রস্তাবদুটি উপরওয়ালাদের মনে ধরতে পারে ।
লোক নিয়োগ মানেই ব্যবসা, কম্পিউটার-সফটওয়ার ইত্যাদি আনা মানেই কমিশন । তাই এগুলি হয়তো বাস্তুবাইয়ীতও হবে । কিন্তু তারপর কি হবে ? আমরা জানি, এও ফলে সরকারের ব্যয় বাড়বে, আর জনগনকে সেই জন্যই আরও বেশী কর দিতে হবে । তার পর আগামী বৎসর গুলিতে আবার আবার পুরানো কাসুন্দি ঘাঁটা হবে । এই হলো বাংলার মানুষের বিধিলিপি ।
অথচ এসব না করে, একেবারে সামান্য ব্যয়ে, এমনকি কোন অতিরিক্ত লোক নিয়োগ না করেও যে এই সমস্যার সমাধান করা যায় তা কি আমরা জানি ? অনেকে হয়তো বিষয়টি জানেন, কিন্তু এই ব্যবস্থায় ‘ব্যবসা আর কমিশনের ব্যবস্থা’ না থাকায় অনেকেরই এটি মনে ধরবে না । এই বাস্তবতা মনে রেখে আজকের দিনে এটি আমরা জনগনের অবগতির উদ্দেশ্যে জানাচ্ছি ।
আয়কর প্রদান ঃ
সরকার কর সংগ্রহের ব্যাপারে যে ধরনের কথা বলে থাকে তার মধ্যে আছে ঃ (০১) অধিক সংখ্যক লোককে করের আওতায় আনা এবং (২) করদাতারা যাতে সঠিক ভাবে ও মাত্রায় কর পরিশোধ করে তার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রথম কাজটি করার জন্য প্রচুর জনবল লাগবে। তা করা হলে এই বাবদে সরকারের খরচ বাড়বে।
সেই সঙ্গে তাদের কর্মপদ্ধতি সঠিক না হলে এবং সততা আশানুরূপ না হলে নিট লাভ তেমন হবে না, বরং ক্ষতিই হতে পারে । এমন পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন : (ক) আমাদের দেশের মানুষের সততার বর্তমান মানের বাস্তবতায়, (খ) অধিক সংখ্যক লোক ব্যবহার না করে এবং (গ) অত্যন্ত কম খরচে উপরের দুটি উদ্দেশ্য সফল করার কোন উপায় আছে কি ? এখানে এমনই একটি প্রস্তাব রাখা হচ্ছে। এটি হলো- একটি বিশেষ ধরনের ব্যাংক চেক প্রবর্তন । ধরা যাক, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে কিছু ব্যাংক একটি বিশেষ ধরনের চেক চালু করল যার নাম, “কর প্রদানযোগ্য চেক”। প্রচলিত চেকের বদলে এই চেক-এ নতুনত্ব যা থাকবে তা হল, এই চেকে লেখা থাকবে, মোট (টাকার অংক) টাকার শতকরা (এত) অংশ অর্থাৎ (এত) টাকা বাংলাদেশ সরকারের ট্যাক্স একাউন্ট নং ... এ জমা দিন এবং বাকি (এত) টাকা প্রাপক (অমুক....।
..) কে দিন। “
ধরা যাক, বাংলাদেশ কর কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিয়েছে, যেসব কর্মচারীর মাসিক বেতন ১৫,০০০ (ধরা যাক) টাকার বেশি তাদের বেতন চাকরিপ্রদানকারী কর্তৃপক্ষকে শুধুমাত্র “কর প্রদানযোগ্য চেক” এর মাধ্যমে মাধ্যমে দিতে হবে। সরকারের প্রাপ্য কর বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দেয়া হবে । যেমন, যাদের আয় ১৫,০০১ থেকে ২০,০০০ তাদের কর হার ৫%, যাদের ২০,০০১ থেকে ৩০,০০০ টাকা তাদের ৮%, যাদের ৩০,০০১ থেকে ৪০,০০০ তাদের ১০% ইত্যাদি। চাকরিপ্রদানকারী কর্তৃপক্ষ বেতনের বাইরে কর প্রদানযোগ্য অন্য কোন টাকা প্রদান করলে তাও এই বিশেষ চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে ।
বর্তমানের মতোই প্রত্যেক কর প্রদানকারীর আয়কর প্রদানের নম্বর (যেমন, টি আই এন) থাকবে। এখন একজন ব্যক্তি যদি তার চেকের টাকা তোলার সময় ব্যাঙ্ক থেকে ট্যাক্স প্রদানের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেন, আর এই ধরনের সবগুলো সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে তার কর বছর শেষে ঐ গুলোসহ একটি স্টেটমেন্ট জমা দেন, তাহলে সঠিক অর্থে তার ট্যাক্স জমা দেয়া হয়ে গেল। এই সঙ্গে করদাতাদের কর বৎসর একটি মাসে না করে ১২টি মাসের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে । এতে করদাতা ও সংগ্রহকারীদের যেমন ঝামেলা কমবে, তেমনি ট্যাক্স ‘কমানোর উদ্দেশ্যে’ উকিল বা আমলা ম্যানেজ করার কোন দরকার হবে না ।
মুসক প্রদান ঃ
ক্রেতা হিসেবে আমরা মুসক বা ভ্যাট দেই।
সরকারের তহবিলে তা কি সঠিকভাবে জমা পড়ে ? বাড়ি ভাড়ার একটা অংশ ট্যাক্স হিসেবে সরকারের পাওয়ার কথা। সরকার কি তা পেয়ে থাকে ? ধরা যাক, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক সকল ব্যাংককে “মুসকপ্রদানকারী হিসাব” নামে একটি বিশেষ ধরনের হিসাব খোলার নির্দেশ দিলো । যেসব দোকানদার বা পেশাজীবী (যেমন ডাক্তার, উকিল ইত্যাদি) মুসক প্রদান করে থাকে তাদেরকে এই হিসাব খুলতে হবে। স্থানীয় কর কর্তৃপক্ষ তাদেরকে তাদের সিল ও স্বাক্ষরসহ প্রস্তুত ক্যাশ মেমো বই সরবরাহ করবে। ভ্যাট প্রদানকারী সকলকে এই বই ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহার শেষে তৃতীয় কপিসহ বইগুলো এবং ব্যাঙ্ক থেকে ষ্টেটমেন্ট কর অফিসে জমা দিতে হবে।
“মুসকপ্রদানকারী হিসাব” এর ক্ষেত্রে কর কর্তৃপক্ষের নির্দেশ থাকবে প্রতিবার টাকা উত্তোলনের সময় শতকরা (এত....%) টাকা ( এই হারটি বিভিন্ন ধরনের জিনিস বা আইটেম, যেমন, ডাক্তারের ফি, উকিলের ফি, বাড়ী ভাড়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে বিভিন্নন হবে ) বাংলাদেশ সরকারের ট্যাক্স একাউন্ট নং .... এ জমা দিতে হবে। যদি একই কোম্পানিকে বিভিন্ন কাজের জন্য বিভিন্ন হারে ভ্যাট দিতে হয় তাহলে প্রতিটি হারের জন্য তাকে ভিন্ন ভিন্ন হিসাব খুলতে হবে। এই সব কোম্পানিকে কর বছর শেষে ঐ ব্যাংকের স্টেটমেন্ট আর ব্যবহৃত ক্যাশ মেমো বই জমা দিলেই আসলে তাদের মুসক দেয়া হয়ে গেলো ।
ঊপরে বর্ণিত উপায়ে চাকরি করা ব্যক্তি, বাড়িওয়ালা পেশাজীবী ভ্যাট প্রদানকারী ব্যক্তি ও সংস্থা সকলকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে করের আওতায় আনা যায়। এর পর বাকি থাকবে বড় বড় কোম্পানি ।
এদের কাছ থেকে কর সংগ্রহের জন্য কর কর্তৃপক্ষ উপরোক্ত পদ্ধতি চেষ্টা করে দেখতে পারেন । তবে এটি একটু জটীল হবার কারণে কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই আরও চিন্তা ভাবনা করে ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে । আর তা কার্যকর মনে না হলে বর্তমান পদ্ধতিই বহাল থাকতে পারে ।
মজার ব্যাপার এই যে, প্রচলিত পদ্ধতিতে যেখানে সরকার কর পেয়ে থাকে কর বর্ষের প্রায় শেষে, এই পদ্ধতিতে কিন্তু করের জন্ম হবার সঙ্গে সঙ্গেই তা সরকারের তহবিলে জমা হবে। আর এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হলে কর ফাঁকির পথ যে একেবারেই বন্ধ হবে তা বলাই বাহুল্য।
সরকারকে যা যা করতে হবে তা হলো :
(০১) সরকারকে “আয়কর প্রদানকারী ব্যাঙ্ক চেক” ও “মুসক প্রদানকারী হিসাব” প্রবর্তন করতে হবে ।
(০২) সরকারকে চাকরি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিতে হবে যাতে তারা করদাতা লোকজনকে শুধুমাত্র কর প্রদানযোগ্য চেকের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করেন ।
(০৩) সরকারকে ভাড়াটিয়াদের নির্দেশ দিতে হবে যে যে তারা যেন বাড়ির মালিককে শুধুমাত্র মুসক প্রদানযোগ্য হিসাবে চেকের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধ করে ।
(০৪) সরকারকে জনসাধারনকে আহবান জানাতে হবে তারা যেন কোনক্রমেই কর কর্তৃপক্ষের দেয়া ক্যাশ মেমো ছাড়া অন্য কোন ভাবে টাকা পরিশোধ না করেন।
উপরের কাজগুলো করা হলে বাংলাদেশের মানুষের সততার মান যাই হোক না কেন তাতে কর সংগ্রহের কোনই ক্ষতি হবে না।
“আয়কর প্রদানকারী ব্যাঙ্ক চেক” ও “মুসক প্রদানকারী হিসাব” চালু করার খরচ :
উপরোক্ত পদ্ধতি বাংলাদেশে চালু করতে কত খরচ হবে আমরা জানি না। তবে এই পদ্ধতির অধিকাংশই সরকারের আইন প্রণয়ন ও প্রবর্তন বিষয়ক হওয়ায় এখানে আর্থিক খরচ হবে যে অত্যন্ত নগন্য তা বলাই বাহুল্য । বৎসরের একটি মাসে সব কাজের চাপ একসাথে আসার বদলে সারা বৎসরই কিছু কিছু কাজ আসার কারনে অনেক কম লোক দিয়ে কর কর্তৃপক্ষ কাজ চালাতে পারবে ।
উপসংহার ঃ
উপরে প্রস্তাবিত “আয়কর প্রদানকারী ব্যাঙ্ক চেক” ও “মুসক প্রদানকারী হিসাব” চালু করার কোন খারাপ দিক যদি আদৌ থাকে তা হলো, বিশেষ কারো জন্য বড় কোন আর্থিক সুবিধা বা কমিশন না থাকা । আমরা জানি, সঙ্গত কারনেই কোন বিদেশী কোম্পানি বা দাতাসংস্থা এ ধরনের কোন প্রস্তাব বাস্তুবায়নে আগ্রহী হবে না।
অনেক সময় কোন নতুন পদ্ধতি চালু করার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হয় এর কোন খারাপ ফল আছে কিনা, পদ্ধতি সফল হবে কিনা ইত্যাদি। এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বড় ব্যবসার কথাও আমরা জানি। বাংলাদেশে এই পদ্ধতি চালু করা সম্ভব করা সম্ভব কিনা, এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, একটি বুদ্ধিমান শিশুও বুঝতে পারে, শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর যে কোন দেশেই এই পদ্ধতি অতি সহজে প্রবর্তন করা সম্ভব । আর এটি চালু করা হলে কর প্রদানকারী ও সরকার, দুই পক্ষেরই লাভ হবে। ক্ষতি হতে পারে তাদেরই যারা এখন এই খাত থেকে নানা অনৈতিক সুবিধা পেয়ে থাকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।