উপন্যাসের নাটকীয় কাহিনীর মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে 'হ্যালো কর্নেল'-এ। কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মোস্তফা কামাল এটির রচয়িতা। তিনি প্রায় ৭০টি গ্রন্থের লেখক। পেশাগতভাবে বাংলাদেশের অনেক সংবাদপত্রে নিবেদিতপ্রাণ সাহিত্যিক সাংবাদিকতা করেছেন এবং বর্তমানে অনেকেই কর্মরত আছেন। সাংবাদিকতা পেশার ব্যস্ততার মধ্যে যারা সৃষ্টিশীল কাজের ধারা বজায় রাখতে পেরেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মোস্তফা কামাল।
প্রতিবছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তার একাধিক বই প্রকাশিত হয়। তিনি দুই দশক ধরে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সায়েন্স ফিকশন, টিভি নাটক এবং শিশু-কিশোর উপযোগী রচনার নিয়মিত লেখক। কলামিস্ট হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তাও রয়েছে তার। ২০১১ সালের তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস 'জনক জননীর গল্প' প্রকাশিত হয়েছে। এ গ্রন্থটির আগেও তিনি 'সিরিয়াস' ধারার উপন্যাস রচনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
'বারুদ পোড়া সন্ধ্যা' (২০০৫), 'হ্যালো কর্নেল' (২০১০) এর মধ্যে পাঠকের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছে। এরপর তিনি লিখেছেন 'জিনাত সুন্দরী ও মন্ত্রী কাহিনী' (২০১২), 'কবি ও একজন নর্তকী' (২০১৩) প্রভৃতি উপন্যাসের বাস্তবধর্মী কাহিনী। তার সংকলনগ্রন্থ 'সায়েন্স ফিকশনসমগ্র', 'চার জয়িতা', 'চার অপরূপা' এবং গবেষণাগ্রন্থ 'আসাদ থেকে গণঅভ্যুত্থান' (১৯৯৩) খ্যাতি অর্জন করেছে।
'হ্যালো কর্নেল' (২০১০) তার একটি ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। বিশেষত এই উপন্যাসের কাহিনী বর্তমান পাকিস্তানের জঙ্গি তৎপরতা ও আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তালেবানদের আক্রমণ সব মিলিয়ে সমকালীন ও প্রাসঙ্গিক।
২০০৪ সালে মোস্তফা কামাল পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ছাড়া অন্য সব অঞ্চল প্রায় এক মাস চষে বেড়িয়েছিলেন। এরপর আরও দু'দফায় তিনি সেখানে যাওয়ার সুযোগ পান। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি দেখতে পান সেখানকার সমাজে কিভাবে জঙ্গিবাদ শিকড় গেড়ে বসেছে। সরকার, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, রাজনৈতিক দল জঙ্গিবাদকে সহযোগিতা করছে। তখন থেকেই আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত এলাকা ও ওয়াজিরিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গি ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্র বিমান এবং কখনো কখনো ড্রোন হামলা চালিয়েছে।
পাকিস্তানের অনুমতি না নিয়ে এই হামলা পরিচালনা করলেও তৎকালীন মোশাররফ সরকার নিন্দা জানাতে পারেনি। কারণ তার সরকার জঙ্গিবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য নিয়ে উল্টো তালেবান জঙ্গিদের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেছিল। উল্লেখ্য, একসময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তালেবান জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হয়। মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা তালেবান সংগঠন আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সর্বত্র ঢুকে গেছে। বাংলাদেশ তাদের টার্গেট ছিল তখন থেকেই।
অর্থাৎ পাকিস্তান যেমন ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা পেয়েছে তেমনি বাংলাদেশকে ধর্মীয় উন্মাদনা দিয়ে অস্থির করে তোলার চেষ্টা হয়েছে অনেক আগে থেকেই। জঙ্গিবাদের এই বাস্তবতা নিয়ে মোস্তফা কামালের 'হ্যালো কর্নেল'-এ যুদ্ধ ও প্রেম একীভূত। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতা উপন্যাসের কাহিনীর ফ্রেমে ধারণ করেছেন তিনি। মোস্তফা কামাল দেখিয়েছেন এক জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতা রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে। তালেবান, আল-কায়েদার সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্পর্ক, যুক্তরাষ্ট্রের চাপে জঙ্গি দমনে নাটক মঞ্চস্থ করা, তালেবান নেতাদের ভয়ে ভীত পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা, মানুষ অপহরণ করে অর্থ সংগ্রহের তালেবানি কৌশল, বাংলাদেশে জঙ্গি প্রেরণের জন্য ট্রেনিং প্রদান প্রভৃতি প্রসঙ্গ এবং সামাজিক-পারিবারিক জীবনের অনেক অজানা তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে এ উপন্যাসে।
পাকিস্তানের সেনাকর্তা কর্নেল মইনুদ্দিন, বাংলাদেশি যুবক সাকিব, তার পাকিস্তানি প্রেমিকা মাহাভেস, যুবক আফ্রিদি ও তার মমতাময়ী মা উপন্যাসের মূল চরিত্র। সাকিবের জবানিতে উপন্যাসের কাহিনীর সূচনা এবং ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী ভূখণ্ডের চিত্রাবলি। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির ৬৬ বছরের ইতিহাস হচ্ছে সামরিক শাসনের ইতিহাস। এই সামরিক বাহিনী সেখানকার রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক শক্তি। চলতি বছর (২০১৩) মে মাসে একাধিক ঘটনায় আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে হত্যা করা হয়েছে পঞ্চাশের অধিক মানুষকে।
গত ২৫ মে আফগানিস্তানের কাবুল ও পাকিস্তানের পেশোয়ারে জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছে ১৩ জন। তালেবানরা বন্দুক ও রকেট হামলার সেই ঘটনার দায়িত্ব স্বীকার করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানে সার্বিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী পাঞ্জাবি ভূস্বামী ও সেনাপ্রধানরা। এসব বাস্তবতাও রয়েছে মোস্তফা কামালের উপন্যাসে। পাকিস্তানের রাজনীতি জটিল ও অমানবিক।
বাংলাদেশে পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হয়েছে জঙ্গি মৌলবাদ। আফগানিস্তানে এই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে মার্কিন অভিযান শুরু হলে এরা পাকিস্তান হয়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সহায়তায় সমুদ্রপথে দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং বাংলাদেশে জঙ্গিদের ট্রেনিং দেওয়া শুরু হয়। পাকিস্তানের অন্ধ ভারতবিরোধিতা, আমেরিকার ক্লায়েন্ট স্টেট হয়ে যাওয়া, আহমদিয়া ও শিয়াবিরোধী নীতি, মধ্যযুগীয় ধর্মীয় শাসন এবং সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রযন্ত্র মানুষকে প্রগতিশীল বিশ্ব থেকে বিচ্যুত করেছে। এ কারণেই 'হ্যালো কর্নেল' একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত। এর কাহিনীতে এ সব প্রসঙ্গ নাটকীয় কৌশলে বিবৃত হয়েছে।
এ জন্যই কর্নেল মইনুদ্দিন ইসলামী সংগঠনের পেশোয়ার শাখার জনৈক নেতার কাছে শুনেছেন- 'দেখেন, দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে জঙ্গি অভিযানে আমাদের চেয়ে আপনাদের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হচ্ছে। সাধারণ মানুষ বেশি মারা যাচ্ছে। তাদের ধনসম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। কাজেই আমার মনে হয় সত্যিকার অভিযানের পরিবর্তে আপনারা অভিযানের নামে নাটক মঞ্চস্থ করতে পারেন। কর্নেল সাহেব বললেন, আমরা তো তা-ই চাই।
তবে নাটকটা যেন অতিরঞ্জিত না হয়। '
এই অভিযান নাটকের সময় প্রথমে একজন সেনা কর্মকর্তা এবং আফ্রিদির বাড়ি থেকে একাকী বের হয়ে সাকিব তালেবানদের দ্বারা অপহৃত হয়। অপহৃত সাকিবকে উদ্ধারের জন্য মাহাভেসের প্রচেষ্টা, এই বাংলাদেশি যুবকের জন্য তার হৃদয়ের আকুতি কাহিনীকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। যুদ্ধ, হত্যা, আতঙ্ক সবকিছুকে ছাপিয়ে এ দুই ভিনদেশি নর-নারীর প্রেমের পুনর্মিলনে উপন্যাসটি শেষ হয়েছে। মূলত মোস্তফা কামাল সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে একাধিক উপন্যাস রচনা করেছেন।
তার মধ্যে স্থান-কালের বিন্যাসে বৈচিত্র্যময় আখ্যানের শৈল্পিক উপস্থাপনা হচ্ছে 'হ্যালো কর্নেল'। উপন্যাসটি দেশ এবং বিশ্বের বর্তমান জঙ্গিবিরোধী পরিস্থিতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সৃষ্টিকর্ম। এ ধরনের রচনার ধারাবাহিকতায় মোস্তফা কামালের সৃজনশীলতার ভুবন আরও এগিয়ে যাক এই প্রত্যাশা আমাদের। আর সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে জঙ্গিদের বিচিত্র তৎপরতার মধ্যে এই উপন্যাসটির বহুল প্রচার দরকার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।