ব্লগের আমি ব্লগের তুমি ব্লগ দিয়ে যায় চেনা
২.২
এখন তাঁর সঙ্গী বলতে, বন্ধু বলতে তো এক জোহরা বেগম। এই গত অগাস্টে তাঁদের বিয়ের পঞ্চাশ বছর হলো। ঝর্ণা একটা উৎসবমতো করবে। ঘটা করে এসব পালন করার রীতিনীতির সঙ্গে ভালো পরিচয় ঘটেনি, খানিক আপত্তি তাঁর ছিলোই। তবু রাজি হয়েছিলেন, একটা উপলক্ষ করে সবাইকে একসঙ্গে পাওয়া যাবে, এ-ই বা কম কি! করা হলো একটা ছোটোখাটো অনুষ্ঠান।
ঢাকায় চিঠি লিখেছিলেন: আমাদের বিয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ছোটোখাটো একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চাই। জীবনের এই শেষ উৎসবে মনে-প্রাণে তোমাদের জন্যে প্রতীক্ষা করছি। তোমরাই আমাদের আত্মার ধন, আমাদের সামনে যাওয়ার পিছুটান...
দোগাছীর গ্রামের বাড়ি থেকে বড়ো তিন ভাইয়ের ছেলেরা - খোকা, আশরাফ, আফজাল - তাদের বউ-ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসেছিলো। ঢাকা থেকে মেজো ছেলে ফিরোজ আর তার বউ রুবা, ঝর্ণা-রঞ্জু আর তাদের একমাত্র ছেলে রঙ্গন। রীতা আসতে পারেনি, জ্বরে পড়া মেয়েকে নিয়ে ঢাকা থেকে ছুটে আসার কোনো মানে হয় না।
এবারক হোসেন ফোন করে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। আর আসেনি বড়ো আর ছোটো দুই ছেলে। দেশের বাইরে থেকে সশরীরে ওদের আসা সম্ভব ছিলো না, ফোনে এসেছিলো। বড়ো ছেলেকে লিখেছিলেন: তোমরা আসতে পারবে না জেনেও এই ভেবে পুলক অনুভব করছি যে তোমরা ছায়ার মতো আমাদের পাশেই আছো...
জোহরা বেগম ওপরে চলে যেতে এবারক হোসেন ইজিচেয়ার থেকে উঠে পড়লেন। শোবার ঘরে গেলেন, বেরিয়েও এলেন আবার।
দরজা খুলে বাইরের বারান্দায় একটু দাঁড়ালেন। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। কিছু না দেখেই খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে এলেন ঘরে। অস্থিরতা বোধ করেন। মনে হয়, কী যেন একটা কী করার আছে।
কিন্তু কী? মনে পড়ে না। বুকের ব্যথা খানিক বেড়েছে বলে বোধ হয়। অন্ধকার ঘরে ফিরে আলো জ্বালতেও ইচ্ছে হলো না। আবার ইজিচেয়ারে বসতে বুকের ভেতরে একটা তীব্র দংশন টের পেলেন। ধাক্কাটা খুব আচমকা আর জোরালো।
এই তো সেই দংশন, চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয়। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকেন ইজিচেয়ারে।
ছোবলটা আর টের পাওয়া যায় না, কিন্তু বুকের ভেতরটা কেমন ভয়ানক ভারি হয়ে চাপ ধরে আছে। যেন বুকের ওপর পাথরচাপা দেওয়া হয়েছে। চোখমুখে গরম ভাপ, এই শীতে সন্ধ্যায়ও কপালে ঘাম জমছে।
শরীরের ভেতরে কি ঘটছে, ভাবতে চান না। ভেবে কী হবে! ‘যেতে যদি হয় হবে / যাব, যাব, যাব তবে...’। ' জীবনের কাজ কিছুই আর বাকি পড়ে নেই। অবশিষ্ট পড়ে আছে কেবল একবুক ভরা মায়া, ভালোবাসার মানুষদের জন্যে পিছুটান। এই লেনদেন শেষ হওয়ার নয়।
জীবন যে কী ভীষণ এক তৃষ্ণা! তার পরতে পরতে কতো মায়া আর পিছুটান! ‘এখনো নিজেরই ছায়া, রচিছে কত যে মায়া / এখনো মন যে মিছে চাহিছে কেবলই পিছে...’
এবারক হোসেন জানেন, জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে শুয়ে আছে অস্পষ্ট একটি রেখা। দেখা যায় না, বোঝা যায়না। অনুভবেরও বাইরে। তাহলে? এক মুহূর্তের কারসাজিতে নেই হয়ে যাওয়া! কী করুণ! নিজের জন্মের সময়টি মানুষের স্মৃতিতে থাকে না। আর এই চলে যাওয়ারও তো কোনো স্মৃতি আমার থাকবে না।
অদেখা সুতোয় টানা রেখাটি পেরিয়ে গেলেই স্মৃতি-বিস্মৃতি কোনোকিছুরই আর কোনো মূল্য নেই। আমি তখন অন্য মানুষদের কাছে স্মৃতি, আমার সেখানে কোনো ভাগ নেই! কী দুঃসহ এই চলে যাওয়া। কী অর্থ আছে এর! জীবনের পরে কী আছে জানা গেলে হয়তো এই যাওয়া অনেক সহজ হয়ে যেতো। জানা নেই বলেই কি এতো সংশয়! এতো দ্বিধা! এতো পিছুটান! পিছুটান, ভালোবাসা, মায়া না থাকলে বুকভাঙা এমন হাহাকারও বুঝি উঠতো না।
শরীরের ভেতরে এই আকস্মিক আক্রমণ সহনীয় হয়ে ওঠার কথা নয়, কিছু সময় যেতে হয়তো খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে ওঠার ব্যাপার ঘটে।
এবারক হোসেন ধীরে ধীরে উঠে বসলেন, অনেকখানি ইচ্ছেশক্তি জড়ো করে দু’পায়ে ভর রেখে দাঁড়ালেন। মাথার ভেতর খালি খালি লাগে, পা সামান্য টলোমলো। ইজিচেয়ারের পাশে খাটে হাত রেখে সামলে নিলেন। পায়ে পায়ে চলে এলেন শোবার ঘরে, পড়ার টেবিলে এসে বসলেন। চোখের আলো কমে আসায় আজকাল আর লেখাপড়ার কোনো কাজ নেই, টেবিলটা তবু রয়ে গেছে এ ঘরে।
টেবিলে কাচের নিচে খুব প্রিয় মুখগুলোর ছবি পরপর সাজিয়ে রাখা। ছেলেমেয়েরা, তাদের ছেলেমেয়েরা ছবির ভেতরে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের দেখা তো আর হলো না, ছবিতে এখন কাকে রেখে কাকে দেখবেন! ভেজা ঝাপসা চোখে দেখাও কি যায়! চোখের কোল মুছে তাকিয়ে দেখেন আবার। ‘নদীতটসম কেবলই বৃথাই প্রবাহ আঁকড়ি রাখিবারে চাই, / একে একে বুকে আঘাত করিয়া ঢেউগুলি কোথা ধায়...’। ' জানি, জীবন এরকমই, চাইলেও সব ধরে রাখা যায় না।
ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়েছে, তাদের নিজেদের জীবন, জগৎ তৈরি হয়েছে। ওরা তাঁর আশেপাশে যে সবসময় থাকবে, তা তো হয় না। তবু এ যে কী বিষম তৃষ্ণা!
ছোটো ছেলেটি ক্যাডেট কলেজ পাশ করে বিদেশে পড়তে গিয়েছিলো। আর তার ফেরা হলো না। চোখের আড়ালেই সে থাকলো প্রায় সারা জীবন।
চল্লিশের কাছাকাছি, তবু তাকে সংসারী করে তোলা গেলো না আজও। কী আর করা, সবাই একরকম হয় না। একসময় অনুযোগ করতেন, এখন তা-ও নেই। ওর মুখে তিনি তাঁর নিজের পিতার ছবি দেখতে পান, একমাত্র ওকেই আদর করে বাপজান বলে ডাকতেন। আজও ডাকেন, মনে মনে।
তার সঙ্গে দেখা নেই ঠিক পাঁচ বছর, চিঠিপত্র নেই, ফোনও আসে না বড়ো একটা। তাঁদের পঞ্চাশ বছরের বিয়ে বার্ষিকীর সময় ওকে লিখেছিলেন: বাপজান, অনেক দুঃখ-বেদনার মধ্যেও আজ তোমার হাসিমুখ স্মরণ করছি। তুমি সুখে থাকো, ভালো থাকো। আমাদের কথা মনে রেখো...
কীসের অভিমান তার, বোঝা যায় না। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো, কষ্ট আসলে আজও আছে।
ওকে শেষবার একনজর দেখার বড়ো ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু তা যে হয়ে উঠবে এমন আশা বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছেন। কিছুদিন আগে ফোনে অনুনয় করে বলেছিলেন অন্তত এখনকার তোলা একখানা ছবি পাঠাতে। ছবি আসেনি। ‘বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা... / হৃদয়বিদারি হয়ে গেল ঢালা...’। ' তবু ওকে তিনি ক্ষমাও করে দিয়েছেন।
সঠিক কিছু জানা না থাকলেও ভেবে নিয়েছেন, হয়তো ওঁরই ভুল হয়েছিলো কোথাও। তিনি জানেন, কোনোকিছু বদলে ফেলার ক্ষমতা না থাকলে তাকে মেনে নিতে হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।