আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রথম স্বেচ্ছায় বাঙ্গালী ধর্মান্তরিত খ্রীষ্টান

হৃদয়ের কাছে বুদ্ধির বাস ভাল কথা। কিন্তু মাঝে মঝে হৃদয়ের ওপর থেকে বুদ্ধির শাসন তুলে দিতে হয়, হৃদয়কে স্বাধীন করে দিতে হয়, মুক্ত করে দিতে হয়। স্বাধীন মুক্ত হৃদয়ের ধর্মকে সব সময় বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে নেই অনেক দিন ধরেই মাথায় একটা পোকা ঢুকে গেছে, আচ্ছা ইসলাম তো আরব দেশ থেকে এদেশে এসেছে, তাই যদি হয় তাহলে এই দেশে বা নিকটবর্তী জানা অতীতে কে প্রথম ইসলাম গ্রহন করছে, অথবা খ্রীষ্টান ধর্ম এদেশে এসেছে সাহেবদের মাধ্যমে তাই যদি হয় তাহলে বাংলায় কে প্রথম খ্রীষ্টান হয়? মনের কোন গহীনে যেন প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। হঠাৎ করে কিছু চমৎকার তথ্য হাতে পেলাম, মনে হল ভূলে যাবার আগে লিখে রাখি। তার নাম কৃষ্ণচন্দ্র পাল।

জন্ম চন্দন নগরের পার্শ্ববর্তী বড়া নামক গ্রামে। তাদের বংশ পরাম্পরায় পেশা ছিল সূত্রধর। খ্রীষ্টান ধর্মপ্রচারকরা তার খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহনে আবিভূত নানাবিধ কারনে। অন্যতম কারন ছিল এই যে, স্বয়ং যীশু খ্রিষ্ট জন্ম গ্রহন করছিল সূত্রধর পরিবারে। বাংলাতেও প্রথম স্বেচ্ছা ধর্মান্তকারী ব্যক্তিও এসেছেন সূত্রধর পরিবার থেকে।

এ স্বয়ং যিশুর অভিপ্রায়। কৃষ্ণচন্দ্র পাল খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহন করছিলেন ১৮০০ সালে ২৮শে ডিসেম্ভর। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৬ বছর। মিশনারিনীদের নথি ঘেটে দেখা যায়, কৃষ্ণচন্দ্রে জন্ম ১৭৬৪ সালে। কাজের সূত্রে কৃষ্ণচন্দ্র চন্দন নগর থেকে শ্রীরাম্পুর আসেন।

এখানে ছিল খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারকদের প্রধান কার্যালয়। এখানে উল্লেখ্য করা অপ্রাসাঙ্গিক হবেনা যে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিন্ত চায়নি যে স্থানীয় জনসাধারনের মধ্যে খ্রিষ্টধর্ম প্রসার লাভ করুক। কারন সে ক্ষেত্রে এক পর্যায় অব্যশাম্ভাবী ভাবে স্থানীয় লোকজনের কোম্পানী সন্মন্ধ্যে বিরূপ ধারনা জন্মাবে। কারন কোম্পানী এদেশে এসেছে ব্যবসা করতে যার কারনে কোম্পানী মিশনারীদের কোলকাতা থেকে বহিস্কার করে। এরপর মিশনারীরা ডাচ অধিকৃত শ্রীরামপুর ঘাটি স্থাপন করে কারন ডাচ অধিকৃত ভুখন্ডে ব্রিটিশদের কোন কতৃত্ব ছিলনা।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রভুত প্রভাবসম্পন্ন উইলিয়াম কেরী (বিখ্যাত গ্রন্থঃ কেরী সাহেবের মুন্সী) কিন্ত এখানেই কাজ করত মিশনারীদের কর্মকান্ড কিন্ত আগে থেকেই কৃষ্ণচন্দ্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই প্রভাব আরো গভীর হল যখন তিনি একটি আঘাত পেলেন। কৃষ্ণচন্দ্র গঙ্গায় গোসল করতে যেয়ে আছাড় খেয়ে কাধের হাড় স্থান চ্যুত করে ফেলেন। তার কন্যা তার চিকিৎসার জন্য মিশনারী ডাক্তার টমাসের কাছে নিয়ে যান। ডঃ টমাস গভীর সহানুভূতির সাথে কৃষ্ণচন্দ্রের সেবা করেন একই সময় কেরী সাহেব নিজেও ডঃ টমাস কে সাহায্য করেন।

এই চিকিৎসা সূত্রে কৃষ্ণচন্দ্রের মিশনারীর সাথে সম্পর্ক আরো গভীর হয়। সুস্থ্য হবার পর কৃষ্ণচন্দ্র বন্ধু গোকুলকে সাথে নিয়ে যান ডঃ টমাস কে কৃতজ্ঞতা জানাতে, ডঃ তখন মিশনারীর অন্যান্য সহকর্মীসহ সকালের নাস্তা করছিলেন। ডঃ টমাসের তাদের সাথে নাস্তায় যোগ দেবার উদার আহ্বানকে দুই বাঙালী ফেলতে নাপেরে এক টেবিলে বসে খাবার গ্রহন করেন। কিন্ত তাদের খাবার শেষ হবার আগেই এই সংবাদ মিশনারীদের স্থানীয় পরিচারিকাদের মাধ্যমে বাইরে চাঊড় হয়ে যায়। মিশনারীদের অফিস থেকে বের হয়েই কৃষ্ণচন্দ্র আর তার বন্ধু হামলার শিকার হয় তাদের বক্তব্য ছিল ফিরিঙ্গিদের সাথে এক টেবিলে খেয়ে তাদের জাত গেছে।

বাড়ীর কাছে যেয়ে আবার হামলার শিকার। আত্মীয় স্বজনরা জাতিচ্যুত হবার ভয়ে বাড়ী থেকে পালিয়ে যায় যাবার সময় কৃষ্ণচন্দ্রের আদরের বড় মেয়ে কে সাথে নিয়ে যায় জোর করে। ঘটনা দ্রুত এগিয়ে চলল, কৃষ্ণচন্দ্র ও গোকুলকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল ম্যজিষ্ট্রেটের কাছে, বিচারক বললনে এই মামলার রায় তিনি দিতে পারবেন না। এরপর যাওয়া হল গভর্নরের কাছে, গভর্নর রায় দিলেন কৃষ্ণচন্দ্র কোন অন্যায় করেন নি। আর কৃষ্ণচন্দ্রের বড় মেয়েকে তার কাছে যেন ফিরিয়ে দেয়া হয়।

বিরূপ পরিস্থিতি আচ করে কৃষ্ণচন্দ্র পুলিশি সহায়তা চাইল। উচ্ছৃখল জনতাকে ভয় দেখানোর জন্য কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়িতে পুলিশ পাহারা বসল। শারিরীক নিগৃহ না হলেও অবিবার মৌখিক নিগৃহ হতে থাকল কৃষ্ণচন্দ্র। অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বজাতির অবহেলা আর কূপমন্ডুক্তার জন্য কৃষ্ণচন্দ্র মনে মনে ঠিক করল ধর্মান্তরিত হবে। ঠিক হল কৃষ্ণচন্দ্র আর গোকুল ২৮শে ডিসেম্ভর আনুষ্ঠানিক ভাবে দীক্ষা নেবে।

কিন্তু নানা কারনে গোকুল আর ধর্মান্ত্রিত হয়নি। তাই বাঙ্গালীদের মধ্যে কৃষ্ণচন্দ্র সর্বপ্রথম খ্রিষ্টান হবার গৌরব অর্জন করেন। ১৮০০ সালের ২৮ শে ডিসেম্ভর সারা কলকাতা, চন্দন নগর ভেঙ্গে পরে শ্রীরামপুর। এমন কি স্বয়ং গভর্নর নিজে উপস্থিত ছিলেন। উইলিয়াম কেরী তার জোষ্ঠ ছেলে ফেলিক্স কেরী আর কৃষ্ণচন্দ্র কে নিয়ে নামলেন গঙ্গায় অবগাহনের জন্য।

জন্মান্তর দীক্ষা হল উভয়েরই। যার আন্তরিক প্রচেষ্টায় এই ধর্মান্তকরন সম্ভব হয়েছিল সেই ডঃ টমাস তখন কোথায়? সুদীর্ঘ সতের বছরের প্রচেষ্টায় বাংলায় প্রথম ধর্মান্তকরন হচ্ছে এই খুশিতে তিনি পাগল হয়ে গেছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের যখন দীক্ষা হয় ডঃ টমাস তখন এক প্রকোষ্টে বন্দী। একজন বাংগালীর হিন্দ ধর্ম গ্রহনে শ্রীরামপুর মিশনারী পরিচালিত স্কুল অনেকদিন নাকি ছাত্র শূন্য ছিল। ১৮০১ সালে সর্বমোট ৬ জন হিন্দু খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহন করে।

তার মধ্যে কৃষ্ণচন্দ্র পালের শ্যালিকা জয়মনিও ছিল। এই জয়মনিই প্রথম বাঙালী মহিলা যে খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহন করে। এর কিছুদিন পর কৃষ্ণচন্দ্রের স্ত্রী, কন্যা জামাতা সবাই খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহন করে। হিন্দ ব্রাক্ষ্মন্দের মধ্যে কৃষ্ণপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় সর্বপ্রথম ধর্মান্তরিত হন তিনি। ১৯০৩ সালের ২২শে জানুয়ারী কৃষ্ণচন্দ্রের বড় মেয়েকে বিয়ে করেন।

এরপর কৃষ্ণচন্দ্র খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারে মন দেন। তিনি কয়েকটি প্রার্থনা সংগীত রচনা করেন যা এখনো গীর্জায় প্রার্থনা সংগীত হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ১৮২২ সালের ২২শে আগষ্ট ওলাওঠায় আক্রান্ত হয়ে কৃষ্ণচন্দ্র মারা যায়। যতদুর জানা যায় ১৬৬৩ সাল নাগাদ পর্তুগীজ জলদস্যুরা জোর করে ভূষনার জমিদারের এক ছেলেকে অপহরন করে নিয়ে যায়। এই যুবককে ক্রীতদাস হিসাবে গ্রহন করে এক পাদ্রী।

পরে খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহন করে এই ছেলে তার নাম রাখে দোম আন্তোনিও হিসাবে। পর্তুগীজ লিপিতে তার লেখা “ব্রাক্ষন- রোমান ক্যাথলিক সংবাদ” বাংলা গদ্যের অন্যতম আদিগ্রন্থ। প্রাকৃত পক্ষে দোম আন্তেনিও ছিল প্রথম বাঙ্গালী খ্রীষ্টান কিন্ত তিনি স্বেচ্ছায় খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহন করেনি অনেকটা বাধ্য হয়েই শুরুতে, তাই আমরা বলতে পারি প্রথম স্বেচ্ছায় বাঙ্গালী ধর্মান্তরিত খ্রীষ্টান কৃষ্ণচন্দ্র পাল। আর কারো যদি অন্য কোন তথ্য থাকে তাকে দয়া করে শেয়ার করার অনুরোধ থাকল কৃতজ্ঞতাঃ জাকির তালুকদারের একটি গবেষনা ধর্মী নিবন্ধ  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.