তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
আমার অনেক দিনের লালিত একটা স্বপ্ন হলো কোন এক বইমেলায় আমার একটা বই বের হবে। আমি প্রতিদিন মেলায় গিয়ে সংকোচ নিয়ে বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করবো, "আজ কয় কপি গেলো দাদা?"
আমার এই স্বপ্নটা খুব গোপন কিছু নয়। আমার পরিবার, আত্মীয়, ঘনিষ্ট বন্ধু-বান্ধবেরা সবাই কম-বেশি জানেন। আমি দেশ ছাড়ার পর যে প্রশ্নটা আমি অবধারিত ভাবেই নিয়মিত ইমেইল, ফোন আর এসএমএস-এ শুনেছি সেটা হলো, "লেখালেখিটা কি একদমই ছেড়ে দিলি?" এমনকি আমার মা, যিনি একদমই সহ্য করতে পারতেন না আমার পড়া বাদ দিয়ে কলম ঘষা, তিনি পর্যন্ত বলেন, "মাঝে মাঝে একটু লিখিস, পত্রিকায় না দিতে চাইলে দিস না, কিন্তু ডায়রি লেখার মত করে হলেও কিছু লিখিস। " সে সময়টা আমার ছিল না।
এতটাই ব্যস্ত ছিলাম লেখাপড়ায়, অন্য কিছু আর ছিল না মাথায়।
কিন্তু কী হয়েছে বলি, গত গ্রীষ্মে দেশে গিয়েছি ঘুরতে, এক মেয়ের সাথে হঠাৎই রাস্তায় দেখা। আমি চিনতে পারিনি প্রথমে, ওই এসে পরিচয় দেয়। বলে, "আপনি x x আরিফ, তাই তো?" আমার পুরো নাম ধরে কেউ ডাকলেই আমি বুঝে যাই তিনি আমার লেখা পড়েছেন কোথাও না কোথাও। আমার মনে পড়ে "ভোরের কাগজে" দেখেছি মেয়েটাকে কোনদিন।
কথা এগিয়ে যায়। প্রশ্ন আসে কোথায় লিখি এখন। আমি বিস্ময় এবং একটা চাপা গর্ব নিয়ে দেখি কোথাও লিখি না শুনে মেয়েটা অবুঝের মত অভিযোগ করে। সেদিন আমার সারাটা বিকেল কাটে সেই মোহে। মনে হয় এই শহরে একজন হলেও আমার পাঠক আছে, যে জানে আমার কোন লেখাটা কোথায় কোনদিন ছাপা হয়েছিল।
আমি ঠিক করে ফেলি লিখবো। এই ব্যস্ততার ফাঁকেই লিখবো। ২০০৮ না হোক ২০০৯ এ একটা বই আমি বইমেলায় বের করার চেষ্টা করবোই। করবোই!
প্রবাসে ফিরে এসেই লেখা শুরু করলাম। কাগজের বান্ডিল ভরতে থাগলো গল্পে।
লেখা শুরু করতেই পুরানো স্মৃতি সব ভিড় করতে থাগলো মনে। মনে পড়লো আরিফ ভাই, বিপুল ভাই, রেজা ভাই, মাসুদ ভাই, ভোলানাথ পোদ্দারদা, আহসান কবির ভাই, আহসান হাবিব ভাই, আর সবার কথা। ইমেইল করলাম যাদের ইমেইল ছিল তাঁদের কাছে। দেখা গেলো কারো ইমেইল অ্যাড্রেসই আর আগেরটা নেই, সব ইমেইলই বাউন্স ব্যাক করেছে, কেবল আরিফ ভাইরেরটা ছাড়া। তিনি ইমেইল করলেন, বাঁধ ভাঙার আওয়াজ ব্লগের ঠিকানা দিলেন।
আমি রেজিস্ট্রেশন করে ক'দিন অপেক্ষা করে দেখলাম, কী ধরনের লেখা আসে ব্লগে। আমার ভাগ্য ভালো না খারাপ বলবো জানি না। সেই ক'দিন ব্লগে রাজাকারদের তান্ডব ছিলো না। গোলাম আজম, নিজামীদের ছবি আমার দেখতে হয়নি। গালি সহ কমেন্ট বা পোস্টও চোখে পড়েনি।
আমি লেখা পোস্ট করা শুরু করলাম।
কিছুদিন থেকে বাবা ফোনে জিজ্ঞেস করছেন অন্তর্জালে কোথায় লিখি। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা। স্কুলে স্কাউটিং করে একটা জাতীয় পদক পেয়েছিলাম, প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর করা সার্টিফিকেট। প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাস।
বাবা কেবল জানিয়েছেন এই লোকের ভুমিকা কী ছিলো একাত্তরে। সেই সার্টিফিকেট আমি আগুনে পুড়িয়েছি। সেই বাবাকে কোন মুখে আমি ব্লগের ঠিকানা দেই? কলকাতার এক মেয়ে আমার খুব বন্ধু। কলকাতার পটভুমিকায় গল্প লিখছি শুনে সেও কতোবার ঠিকানা চেয়েছে ব্লগের। কোন বিবেচনায় ওকে ঠিকানা দেই, যেখানে আকাশে-বাতাসে ভাসে গালি?
আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায়, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।
ভিন্ন মত, ভিন্ন বিশ্লেষণ থাকতেই পারে। তাই বলে কি আমার বাক স্বাধীনতা গুঁড়িয়ে চুরমার করা হবে? আমি বিশ্বাস করি লেখার জবাব হবে লেখাতেই। যুক্তির খন্ডন হবে যুক্তিতেই। গালিতে নয়, পোস্ট মুছে নয়। রাজাকারদের আমি ঘৃণা করি।
মনে-প্রানেই ঘৃণা করি। কিন্তু সেই ঘৃণার প্রকাশ কেনো হবে গালিতে? আমার পরিবার আমাকে এ শিক্ষা তো দেয়নি। আমি জেনেছি, জ্ঞানের অভাবে সাহসের অভাবে যুক্তির অভাবে গালি আসে। "রাজাকার" এর চেয়ে বড় গালি আর কী হতে পারে? এর পরেও কেনো মুখ খারাপ করে নিজেদেরকে নিজে নিচে টেনে নামানো?
আজ ব্লগ ছাড়ার আমার যে সাময়িক সিদ্ধান্ত সেটা আমার প্রিয় মানুষদেরকে ব্লগের ঠিকানা দিতে না পারার লজ্জায়। আমাকে কথা বলতে না দেয়ার ক্ষোভে।
আমার মুল্যবোধকে পিষে ফেলার প্রতিবাদে। লেখা আমার থামবে না। ব্লগে হোক আর চিরায়ত কাগজেই হোক লেখা চলবেই। কিন্তু সেই লেখা হয়তো এখানে আর আসবে না। ভালো থাকবেন সবাই।
যোগাযোগ থাকবে।
ধন্যবাদ!
© অমিত আহমেদ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।