আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: গন্দম (পর্ব ৪)

তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

৬ ফেব্রুয়ারী, ২০০৭ সময়: বিকাল ৩:১২-৩:৪৫ স্থান: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বিকৃত মানুষের বিকৃত ছোঁয়া এর আগেও পেয়েছে ঋতু। এমন হয়েছে পূজোর ভিড়ে চৌরঙ্গীতে কেউ ওর বুকে হাত ছুঁয়ে চলে গেছে। কিন্তু সেখানে ঘটনার দ্রুততা আর অসম্ভবতা ওকে বিহ্ববল করলেও কাতর করে তোলেনি। কিন্তু সবার সামনে এভাবে সময় নিয়ে নষ্টামী কেউ কখনও ওর সাথে করেনি। নুড়ি বেছানো গাড়ি রাস্তা পেরিয়ে ডান দিকের চৌবাচ্চার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাপড়ের মত হাঁপাতে লাগলো ও।

এত গুলো মানুষ ওখানে, কেউ কিচ্ছু বলল না! ছিঃ! ঋতুর মনে হলো এক্ষুণি এই মুহূর্তে যদি ওর মৃত্যু হতো, তবেই কেবল এ অদমনীয় লজ্জ্বা থেকে মুক্তি পাওয়া যেত! "ইয়ে... এক্সকিউজ মি!" পাশ থেকে আমতা আমতা করে বলল কেউ। তাকিয়ে একটা ছেলেকে দেখলো ও - লম্বায় প্রায় পাঁচ-নয়, আরেকটু ফর্সা হলে ওকে নির্দ্বিধায় বিদেশী বলে চালিয়ে দেয়া যেত। চেহারা দেখে বয়স অনুমান করাটা কঠিন, বিশও হতে পারে আবার পঁচিশও হতে পারে। তাকিয়ে কেবল ওর কাচুমাচু হওয়া চেহারাটাই লক্ষ্য করলো ঋতু, অন্য কিছু মাথায়ই আসলো না, কি চায় ছেলেটা! "আপনি আমার হাতটা এখনও ধরে আছেন। " চমকে উঠে হাতটা ছেড়ে দিল ও।

ছেলেটার হাত ও কখন, কেন ধরেছে তা কিছুতেই মনে করতে পারলো না ঋতু। ভগবান আর কত লজ্জ্বা দেবেন আজ ওকে! *** রাজীব স্পষ্ট বুঝতে পারছে মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে - এমন কিছু যা ওকে বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে নিয়ে ফেলেছে। এখন ওর হাত ছেড়ে দিয়ে এমন ভাবে বড় বড় কাজল দেয়া চোখে করে তাকিয়ে আছে যে রাজীবের একবার দেখেই মেয়েটার উপর মায়া পড়ে গেল। আহারে বেচারী! "আমার নাম রাজীব। " হ্যান্ডসেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল ও, কোন ভাবান্তর না দেখে হাতটা আবার ফিরিয়েও নিতে হলো, "আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি।

আপনি নিশ্চই স্থানীয়?" এবারও কোন উত্তর এলো না। হাল না ছেড়ে চেষ্টা করেই গেল ও, একমাত্র কথা বলেই এখন পরিবেশটা হালকা করা সম্ভব! *** ছেলেটা একা একাই কথা বলে যাচ্ছে। প্রথমে কিচ্ছু শোনেনি ঋতু, পরে বাংলাদেশ বেতারে কান দিতেই হলো। ঋতু শুনলো ছেলেটা জিগাস করছে, "কফি-হাউস যেতে কতক্ষণ লাগে জানেন আপনি?" কফি হাউসের কথা কোথা থেকে এলো বুঝে পেল না ঋতু, বলল, "না!" বলেই চমকে গেল। কফি-হাউস কলকাতায় অনেক আছে, কিন্তু শুধু কফি-হাউস বললে সবাই মান্নাদের কফি হাউসই বোঝে।

সেই কফি হাউস ওর কলেজের ঠিক সামনে। প্রায় প্রতিদিনই সেখানে বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে আড্ডা জমাতে যাওয়া পড়ে। "শুনুন, আপনি পানি খাবেন?" জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা ছোট্ট পানির বোতল বের করে দিল ছেলেটা। বোতলটা নিয়ে এক চুমুকে খালি করে দিল ও, এত তৃষ্ণা পেয়েছিল জল দেখার আগে অনুভব করেনি ঋতু। "আমি রাজীব।

আপনার নামটা কিন্তু এখনও জানা হলো না!" "ঋতু..." পাশের সিমেন্টের বেঞ্চটা দেখালো রাজীব নামের ছেলেটা, "ঋতু আপনি দয়া করে এখানে একটু বসুন..." রাজীবের গলায় এমন এক ধরনের মমতা ঝরে পড়লো যে ঋতু না বলতে পারলো না। বেঞ্চে বসে একা একাই বকবক করতে থাকলো রাজীব। ভারতীয় বাংলা লেখকদের বই পড়ে বাংলাদেশীরা কলকাতা সম্পর্কে কতটা জানে তাই জাহীর করছে। এই অবস্থাতেও হাসি পেল ঋতুর, ছেলেটা এমন ভাবে হাত মাথা নেড়ে বর্ননা করছে যেন দুনিয়া উদ্ধার করা হয়েছে। হঠাৎ ঋতুর মনে হলো একটু আগে যা ঘটেছে তা এই ছেলেটাকে বলা যায়... বলা দরকার! *** রাজীব বুঝতে পারছে ঋতু আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসছে।

এখন ওর প্রতিটা কথাই শুনছে, মাথা নেড়ে সায়ও দিচ্ছে। ও জানে কি হয়েছে তা একটা ওকে সময়ে বলবে ঋতু, কিন্তু সে সময়টা আসার আগে পর্যন্ত মেয়েটাকে বোঝাতে হবে যে ওর কাছে নির্ভয়ে সব বলা যায়। সে বোধটা ঋতুর কখন হবে তা ভাবার মুহূর্তেই ফুঁপিয়ে উঠলো ও, বলল, "আমাকে অসম্ভব অপমান করেছে... কয়েকটা আঠারো-উনিশ বছরের ছেলে আমাকে সবার সামনে..." গলা দিয়ে উঠে আসা প্রশ্বাসে কথা শেষ করতে পারলো না ঋতু, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকলো। রাজীব সন্দেহ করেছিল এমনই কিছু হয়েছে, ও ঠান্ডা গলায় জিগাস করলো, "কয়জন ছিল?" *** কথাটা বলার পর যেমন প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল ঋতু তার ধারে কাছ দিয়েও গেল না রাজীব। কোন কৌতুহল নয়, কোন প্রতিবাদ নয়, সে ফিরে গেল তার সাহিত্য আলোচনায়।

ওর জায়গায় দীপক হলে কি করতো? প্রথমেই কাহিনীর খুঁটিনাটি জানতে চাইতো, তারপর ছুটতো মারামারি করতে! ঢাকার ছেলেদেরকে নিয়ে অনেক কথা চালু আছে কলকাতায়। তার মধ্যে একটা হলো বাঙালরা হুট করে রেগে যায়, ওদের সব কাজই আবেগ নির্ভর... রাগ আর আবেগ মিশে ওদের একটা দূর্দম ছবি ঋতুর মনে আঁকা ছিল, সেটা যে কতটা ভুল এই ছেলেকে দেখেই বুঝতে পারছে। কোন অজানা কারনেও ও আশা করেছিল এ অচেনা ছেলেটা ওর ব্যাথায় সমব্যাথী হবে, দীপকের মতই ছুটে যাবে মারামারি করতে। সেটা মিললনা দেখে রাগ উঠলো ঋতুর, প্রচন্ড রাগ। পরমুহূর্তেই মনে হলো এ বিদেশী ছেলেটার তো ওর জন্য কিছু করার আবেগী বাধ্যকতা নেই - ঋতুর রাগটা পরিনত হলো অভিমানে! ঠিক এসময়েই বেজে উঠলো মোবাইল ফোনটা।

হাতড়ে খুঁজে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে কে কল করেছে দেখলো ঋতু। দীপক! ঢাকার ছেলেটার উপর জমা অভিমান দীপকের উপর ঢেলে মোবাইলটা বন্ধ করে দিল ঋতু - উচ্ছন্নে যাক সব! *** ঋতু মাথা নিচু করে রাজীবের গল্প শুনছে। রাজীব নাছেড়বান্দার মত ওর কাছে এটা-ওটা জানতে চাইছে। বেশির ভাগ সময়ই ঋতু জবাব দেয়নি, দিলেও কাটা-কাটা উত্তর দিয়েছে। রাজীব জানে ঋতু কি ভাবছে... মেয়েটার অভিমানটা বাচ্চাদের মতই এতটা প্রকট যে না বোঝার কোন কারন নেই।

কিন্তু ওকে একা রেখে গেলে স্মৃতিরোমন্থনের বিশ্রী সুযোগটা পেয়ে যাবে, এটা হতে দেয়া যায় না। একটু আগের ঘটনা সামলে মেয়েটা যে ওর নির্লিপ্ততা নিয়ে ভাবছে এটাও কম পাওনা নয়। খামাখা ঝামেলায় জড়াবার চেয়ে এটাই এখন বেশী গুরুত্বপূর্ণ। ও ইচ্ছে করেই এমন জায়গায় বসেছে যেখান থেকে বেরুবার গেট দেখা যায়। বের হবার গেট ওই একটাই, তাই কে যাচ্ছে আসছে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

ও খেয়াল রেখেছে চারটে আঠারো-উনিশের ছেলে বেরুচ্ছে কি-না। *** "ওরাই সেই চার জন তাই না?" কঠিন গলায় জানতে চাইলো ছেলেটা। হঠাৎ কন্ঠের পরিবর্তনে মুখ তুলে তাকালো ঋতু, চারটে ছেলে হাসতে হাসতে গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দু'জনে তুমুল গালি চলছে, বাকি দু'জন চেষ্টা করছে একজন আরেকজনকে ল্যাং মারতে। ওর দৃষ্টি দেখেই যা বোঝার বুঝে গেল রাজীব।

একটু আগেও যে ছেলে হাবিজাবি কথা বলছিল তার চোখের আগুনে দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে গেল ঋতু। ওর চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে... শক্ত মুঠোয় টানটান হয়ে উঠে দাঁড়ালো রাজীব। ওর অভিব্যক্তিতে এমন এক অদম্য হিংসা ফুটে বেরুচ্ছে যে ঋতু অনুভব করলো ওর ভয়টা এখন ছেলেটাকে নিয়েই। আরও বুঝলো ও কখনই চায়নি রাজীব ওদের সাথে লড়ুক, ও শুধু দেখতে চেয়েছে ওর এই অদম্য ভাবটাই। এক পা ফেলতেই রাজীবের হাতটা আজ দ্বিতীয়বারের মত শক্ত করে ধরে ফেলল ঋতু, ওর দেহে শেষ বিন্দু শক্তি থাকা পর্যন্ত ও রাজীবকে যেতে দিতে পারে না... ঋতু ব্যকুল গলায় বলল, "না... প্লিজ না... ওদের সাথে ছুরি-চাকু থাকে!" © অমিত আহমেদ (চলবে) গন্দম - পর্ব ১ গন্দম - পর্ব ২ গন্দম - পর্ব ৩


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.