প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ আইন
বাংলাদেশের প্রচলিত প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ বিষয়ক আইনটি কেবল পুরনোই নয়, বরং সমকালীন বাস্তবতা-বিবর্জিত। ১৯০৪ সালে প্রণীত একটি আইনের আলোকে ১৯৬৮ সালে প্রণীত এই আইনটি ১৯৭৬ সালে সংশোধন করা হলেও এখানে প্রত্নসম্পদ পাচার ও কেনা-বেচা সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তি হিসেবে ৩০ দিনের কারাদণ্ড অথবা ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনটির বিধান একাধারে অ-যুগোপযোগী এবং সেই সাথে এটি অকার্যকরও বটে।
পরশপাথর না কষ্টি পাথর না কালো পাথর
সংবাদমাধ্যমে এটি প্রায়ই দেখা যায়, উদ্ধারকৃত মূর্তিটি ‘কষ্টি পাথরে তৈরি’। সম্প্রতি উদ্ধারকৃত কিছু মূর্তির মধ্যে ২টি নাকি ‘পরশ পাথরে’র তৈরি।
মূর্তিটি প্রকৃতপক্ষে কোন্ পাথরে তৈরি তা যথাযথ গবেষণার আগে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে কষ্টি পাথর বা পরশ পাথর বলে কোনো পাথর পৃথিবীতে নেই। সাধারণ ভাবে ব্লাক ব্যাসাল্টকে অনেকে কষ্টি পাথর বলে থাকেন। কিন্তু উদ্ধারকৃত মূর্তিগুলো ব্লাক ব্যাসাল্টের তৈরি কিনা তা-ও তো আগে নিশ্চিত হতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী উদ্ধারকারী দলে কি কখনও কোনো পাথর-বিশেষজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে?
প্রত্নসম্পদের মূল্য : কোটি টাকা না তারও বেশি?
প্রায়ই আমরা দেখে থাকি ‘৫০ কোটি টাকা মূল্যের কষ্টি পাথরের মূর্তি উদ্ধার’।
এই মূল্য নির্ধারণ কে করলো? বাজারে ব্লাক ব্যাসাল্টের (কষ্টি পাথরের!) মূল্য কিরূপ? বাজারে প্রতি টন ব্লাক ব্যাসাল্টের দাম ৭০০০ টাকা। তাহলে ২০ কেজি ওজনের কষ্টি পাথরের মূর্তির মূল্য কি করে ৫০ কোটি টাকা হয়? প্রকৃতপক্ষে প্রত্নসম্পদের মূল্য কোনোভাবেই টাকার অঙ্কে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এই মূল্য নির্ধারণ ও প্রচার পরোক্ষভাবে পাচারকারীদের উৎসাহিত করে।
উদ্ধার অযত্ন ধ্বংস?
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, মূর্তিগুলো উদ্ধার হওয়ার পর সেগুলো কোথায় যায়? সেগুলো কি আইন-রক্ষাকারী বাহিনীর গুদামেই পরে থাকে? সেগুলোকে কি প্রত্নসম্পদ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠানো হয়? আমাদের প্রস্তাব হলো, উদ্ধারকৃত প্রত্নসম্পদ যথাসম্ভব দ্রুত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে এবং যোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠানো হোক। উপযুক্ত গবেষণার পর তা যেন জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়, তার ব্যবস্থা করা উচিৎ।
কেবল উদ্ধার এবং অযত্নে গুদামে পরে থাকা প্রকৃত অর্থে প্রত্নসম্পদকে ধ্বংসই করে।
প্রত্নসম্পদের প্রকৃত মালিক ও সংরক্ষক
দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরিচয়বাহী সাংস্কৃতিক সম্পদের প্রকৃত মালিক এই দেশের জনগণ। জনগণকে প্রত্নসম্পদের প্রকৃত পরিচয় অবহিত না করলে জনমনে ভুল ধারণা তৈরি হয়। আমরা মনে করি, পদ্ধতিগত প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার আগে স্থানীয় জনগণ ওই স্থানের প্রত্নসম্পদের গুরুত্ব সম্পর্কে অনেকটা উদাসীন থাকে। পদ্ধতিগত গবেষণা শুরু হওয়ার পর অনেকে ধারণা করতে থাকে, সরকারি আমলা অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্ররা এখান থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছেন।
গবেষণাকাজে অবশ্যই স্থানীয় মানুষদেরকে সম্পৃক্ত করা উচিত। কিছু মানুষ প্রতক্ষ্যভাবে কাজ করবেন, অন্যরা কাজ দেথবেন। তারা প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কাজ এবং আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তু দেখবেন। তখনই যদি বোঝানো হয়, কীভাবে ভাঙ্গা মৃৎপাত্র থেকেও আমাদের অমূল্য ইতিহাস ও সংস্কৃতি বোঝা সম্ভব, তাহলে সেখানে অ-পদ্ধতিগত খনন অনেক কমে যাবে, এমনকি গবেষক দলের অনুপস্থিতিতে কোথাও কোনো প্রত্নসম্পদ পাওয়া যাওয়ামাত্র তাদের কেউ কেউ আপনাকে ফোন করবে, খবর পাঠাবে। বাইরে থেকে গিয়ে কারো পক্ষে ঐ অঞ্চলের প্রত্নসম্পদ সংগ্রহ, বেচা-কেনা এবং পাচার করা কঠিন হয়ে পড়বে।
রেপ্লিকা ও আলোকচিত্র
আর একটি কাজও করতে হবে, তা হলো, প্রত্নসম্পদের যথাযথ আলোকচিত্র ও রেপ্লিকা তৈরি করে বহুল প্রচার। এটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিষয়ে জনসাধারণের সচেতনতা এবং জাতীয় সম্পদের প্রতি আগ্রহকেই বৃদ্ধি করবে। এমনকি ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও পুরাকীর্তির রেপ্লিকা তৈরি করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর আইন ১৯৮৩-তেও জাতীয় জাদুঘরের কার্যাবলিতে রেপ্লিকা তৈরি করা ও তার প্রচারের কথা বলা হয়েছে, অথচ এই আইনটির যথাযথ প্রয়োগ নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।