আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশ 2.0 (নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অথবা অপ্রয়োজনীয়তা)



সকালে তর্ক হচ্ছিল এমএসএনএ, এক পর্যায়ে বাংলাদেশের নেক্সট ভার্শনে নেতা আর নেতৃত্বের কতখানি গুরুত্ব থাকবে বা থাকা উচিত এই নিয়ে প্রসঙ্গ গড়াল। বেশ গুরুত্বপুর্ন বিষয়, কারন নির্বাচন ভিত্তিক যে গনতন্ত্র এখন বিশ্বে প্রচলিত তার একটা মূল লক্ষ্য থাকে নেতা খুজে বের করা। আবার যেমন বাংলাদেশের ব্যর্থতার জন্য সুযোগ পেলেই আমরা নেতা-নেত্রীদের অযোগ্যতা, সুযোগসন্ধানী চরিত্র এবং দুর্ণীতিপরায়নতাকে দায়ী করে বসি। আমার মনে প্রশ্ন জাগে গনতন্ত্র নিজে কতখানি নেতৃত্বভিত্তিক, অথবা নেতার প্রয়োজনীয়তা গনতন্ত্রে কতটুকু। লিংকন বা এ্যরিষ্টটলের সংজ্ঞায় ঠিক নেতা নেতৃত্বের সাথে গনতন্ত্রের সম্পর্কটা পরিস্কার হয় না, অথবা যতটুকু হয় তাতে মনে হয় নেতা বিহীন অবস্থাই বরং বেশী গনতান্ত্রিক।

যেমন যেখানে নেতার গুরুত্ব বেশী সবচেয়ে বেশী তাদের মধ্যে আছে রাজতন্ত্র/স্বৈরতন্ত্র বা বিভিন্ন ধরনের ধর্মভিত্তিক তন্ত্র। এগুলোতে একজন বিশেষ ব্যক্তির মতামতের গুরুত্ব অন্য সবার চেয়ে বেশী, অনেক ক্ষেত্রে তার সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত। আবার এরিস্টোক্র্যাসিতে যেমন একদল কূলীন লোকের মতামতের গুরুত্ব বেশী, কার্যক্ষেত্রে তারা নেতৃস্থানীয়। অন্যদিকে গনতন্ত্রে সবাই সমান, এবং সবার মতামতের গুরুত্বও সমান হওয়ার কথা, আর তাই যদি হয় তাহলে গনতন্ত্রে নেতার প্রয়োজনীয়তা তো না থাকারই কথা। কারন এমন যদি হয় নেতা গাড়ি ছুটিয়ে বাসায় যাবেন বলে সব রাস্তা বন্ধ রাখতে হবে, এমনকি মরনাপন্ন যাত্রিকে নিয়ে এম্বুলেন্সও নড়তে পারবে না, তাহলে ঠিক কিভাবে গনতন্ত্র হলো বোঝা মুস্কিল (এই ঘটনাটা ঘটেছিল কয়েক মাস আগে খালেদা জিয়ার গাড়ি বহর যাওয়ার সময়)।

রাজার রথ যাত্রা রাজতন্ত্রে মানানসই, কিন্তু গনতন্ত্রে নয়। এটুকু ভেবে আমার মনে হলো যে, গনতন্ত্রের 100% প্রয়োগে আসলে কোন নেতা থাকার কথা নয়। বরং নেতা না থাকাটাই (নিদেনপক্ষে এইসব নেতাদের গুরুত্ব কম থাকা) গনতন্ত্রের লক্ষন। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি অবশ্য ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ সব গনতান্ত্রিক দেশেই নেতা নির্বাচন গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটা অংশ।

কিন্তু কেন? এতে কি গনতান্ত্রিক চেতনা ব্যহত হচ্ছে না। হচ্ছে বলেই তো মনে হয়। যেমন বৃটেনের জনগোষ্ঠির একটা বড় অংশ ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতা করলেও ওদের নেতা ব্লেয়ার ইরাকে সৈন্য পাঠান। দেখা যাচ্ছে নেতার ইচ্ছা অনিচ্ছার গুরুত্ব সাধারনের ইচ্ছার চেয়ে বেশী গুরুত্ব পাচ্ছে, যেটা গনতন্ত্রে হওয়ার কথা নয়। এরকম আরো উদাহরন দেয়া যেতে পারে।

তাহলে গনতান্ত্রিক দেশগুলোতে কেন নেতা নির্বাচনের ব্যাপারটা আছে, যদি নেতা থাকলে ঘুরে ফিরে গনতান্ত্রিক চেতনা ব্যহতই হয়। আমার ধারনা এর একটা কারন টেকনিকাল প্রবলেম। যখন দেশের জনসংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে লক্ষ বা কোটিতে যায় তখন সমস্ত সিদ্ধান্তের জন্য বারবার জনগনের কাছে যাওয়া মুস্কিল। আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে, যেমন বৃটেনে তাদের গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা কয়েকশ বছরের পুরোনো। সুতরাং যুদ্ধে যাবো কি না এর জন্য, জনে জনে ভোট নেয়া কঠিন, অন্তত দুশ বছর আগে চিন্তা করলে কঠিন বা অসম্ভব ছিল।

সুতরাং ব্লেয়ার সম্ভবত পার্লামেন্ট থেকে অনুমোদন নিয়েই তার কাজ সেরেছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে জনে জনে মতামত নেয়ার সমস্যা থেকে ঊদ্ধার পাওয়ার জন্য যে সমাধান তা ঘুরে ফিরে গনতন্ত্রের মৌলিক চেতনাকে আঘাত করছে। আমাদের দেশের ইতিহাসে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। সাংসদরা প্রথম অধিবেশনেই নিজেদের বেতন ভাতা বাড়িয়ে নেন। তারপর ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি আমাদানী থেকে শুরু করে রিলিফের বন্দোবস্ত কোনটাই বাদ যায় না।

দু'দলের মধ্যে সব ক্ষেত্রে সাপে-নেঊলে সম্পর্ক থাকলেও এসব ব্যাপারে ভিন্নমত দেখা যায় না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে টেকনিকালিটির সে সমস্যা আছে তার বর্তমান সমাধান (নেতা নির্বাচন) গনতন্ত্রকেই ধ্বংস করছে। কিন্তু অন্য আর কি সমাধান আছে, বা আদৌ কোন সমাধান কি আছে। আমার ধারনা আছে। আসলে নেতাবিহীন ব্যবস্থা খুবই সম্ভব।

তবে তার জন্য বেশ কিছু ইনফ্রাস্ট্রাকচার দরকার যা একবিংশ শতাব্দিতে মানুষের পুরোটাই আছে। আমাদের ব্যাক্তিপুজা মানসিকতা যে আমাদের কত ক্ষতি করছে আমরা এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। দেশের দুর্নীতি যে এরকম মহামারী আকার নিল তার পেছনেও নেতাভক্তি দায়ী, যে দল সমর্থন করি সে দলের নেতাদের দোষ দেখেও দেখতে চাই না, ঠিক এ কারনেই নেতারা মাথায় উঠে বসেছে। আরেকটা আশাব্যঞ্জক সম্ভাবনা হচ্ছে সত্যই যদি এরকম অধিকতর গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমরা যেতে পারি আমরা অদুর ভবিষ্যতে পাশ্চাত্যকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার একটা রিয়েলিস্টিক প্ল্যান করতে পারি। কারন আগের লেখাতেই আমি দেখিয়েছি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রগতির জন্য গনতন্ত্র একটা পুর্বশর্ত।

যত গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমরা যেতে পারব তত বেশী আমাদের উন্নয়নের চাকা ঘুরতে থাকবে। আসলে 5 বছরে একবার 300 আসনে ইলেকশন হলেই যে দেশে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না এটা এতদিনে নিশ্চয়ই পরিস্কার হয়েছে। বাংলাদেশে পদে পদে যে কত ধরনের অসাম্য/বর্ণবাদ তা আমাদের চোখে সহজে ধরা পড়তে চায় না। আমাদের অনেকে যারা ভাগ্যক্রমে অবস্থাপন্ন পরিবারে জন্মেছি তাদের হয়তো কমই এসবের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমার মনে আছে শিক্ষা বোর্ড অফিসে একবার মার্কশিট ইংরেজীতে ট্রান্সলেট করতে গিয়েছিলাম।

কোথায় পড়ি শুনে বোডের্র কর্মকর্তা লাইন ভেঙ্গে আরো 50 জনের আগে আমার মার্কশীট দিয়ে দিলেন। অথচ জামালপুর, নেত্রকোনার মতো প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেকে সকাল থেকে লাইন দিয়ে দাড়িয়ে ছিল। শুধু খালেদা হাসিনাকে বদলে লাভ হবে বলে মনে হয় না, সমাজে এবং আমাদের মানসিকতায় গনতন্ত্র দরকার। এরকম ব্যবস্থা দরকার যেখানে পটুয়াখালীর আমতলী, বা কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার একজন তরুন, ঢাকা শহরের একজন তরুনের সমান সুযোগ পায়। আর এর শুরুটা করতে হবে বিশেষ সুবিধা দেয়ার প্রথা বাদ দিয়ে, ব্যক্তি পুজা, বংশ পুজা, কৌলিন্যবাদ ছেড়ে দিতে হবে, রাজা-রানী, রাজপুত্র, যুবরাজদের বিদায় দিতে হবে, কারন গনতান্ত্রিক দেশে আমরা সবাই রাজা।

নেতা বিহীন, অথবা নিদেন পক্ষে নেতাদের গুরুত্ব কমিয়ে ঠিক কি রকম গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্ভব, এসব নিয়ে পরের লেখাগুলোতে লিখব, আর হিমু তো লিখছেই !@!17417।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.