সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরছি। রাত প্রায় সাড়ে দশটা। খিদের চোটে ছুঁচো ডন দিচ্ছে পেটে। দ্রুত খোপে ফিরতে ত্রিশ টাকায় রফা হওয়া ত্রি-চক্রযানের পাইলটকে বাড়তি দশ টাকা ভেট দেয়ার লোভ দেখালাম। কালোয়াৎ কাজ হলো।
রিকশায় সিট-বেল্টের ব্যবস্থা থাকলে বেঁধে নিতে কার্পন্য করতাম না। শীতের রাত। কানের লতিতে হিমশীতল সুঁচ বিধিয়ে যাচ্ছে উত্তুরে বাতাস। কোনমতে রিকশা থেকে নেমে সোজা লিটনের ফ্ল্যাটের (ব্যাচেলর ছবির সেই ফ্লাট নয়) ছয়তলা। ঠক,ঠক,ঠক।
নিদ্রাভঙ্গের শাস্তি হেতু চাচাতভাই দরজা খুললো পাঁচ মিনিট পর। খিদেয় তখন আমার একত্রিশ ইঞ্চি কোমরের সঙ্গে বত্রিশ ইঞ্চি প্যান্ট সম্পর্ক ছিন্ন করে আরকি। তিন লাফে রসুই ঘরে ঢুঁ মারতেই চক্ষু চড়কগাছ ! মাছের কোপ্তার এ কি হাল ! ইচ্ছে হলো বুয়াকে.....। না থাক,আপনাদের ভদ্রতার লেবাসে ঘা লাগবে। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে মনকে নিয়ে গেলাম চানখার পুঁলে।
সেই মিতালি রেস্টুরেন্টে । আমাকে দেখে তরমুজের বিচির মতো দাত কেলিয়ে হাঁসি দিয়ে হাঁক দিয়ে উঠলো এক কগ্ধকালমুখ -‘আহেন.কি লাগবো,ভাত,পরাটা,কালাভুনা.খাসির কলিজা। ’
আচ্ছা,ওই লোকটার পরিচয় কি ? জাতীয় নাম ‘মামা’। তবে বইয়ের ভাষায় তার পেশাদারি পরিচয় ‘ডেকো। ’
রেলস্টেশন বা লঞ্চঘাট ,অথবা আদালত চত্বরে একশ্রেণির মানুষ দেখা যায় যাদের কাজ হল লোক ডাকা।
সাধারণত ভাতের হোটেল বা মিষ্টির দোকানের খরিদ্দার গোছানোর কাজটা এরা করে দেয়। চলতি নামে এরা ‘ডেকো’। ডাকাই এদের কাজ। গোটা বাংলাদেশেই তাদের ডাক শোনা যায় সর্বত্র। নানা নামে নানা স্থানে।
নীলক্ষেতের ফুটপাতে হেঁটেছেন কখনো ? সেখানে এক ধরনের ডেকো পাবেন, এরা আপনার কানের ফুটোর পরিধি বাড়িয়ে দিবে ! অবিরত চিৎকারে- ‘মামা কী বই লাগবো ?’ একজন-দু’জন নয়, শয়ে শয়ে। প্রায় ছয়-সাতজনকে বলেছি যে কিছু চাই না আমার, আমি পথচারী মাত্র, কাজে যাচ্ছি, কিছু কিনতে আসিনি! তবু কে শোনে কার কথা! তেতুঁল গাছটার তলে ফের একজন। ‘মামু কি চাই ?’ গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘ফুটপাথে হাঁটতে চাই’। আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিয়ে লোকটি বলল, ‘কার লেখা? হুমায়ুন স্যারের ?’ বেচারাকে দোষ দিতে পারিনি। ইদানিং বইয়ের যেসব বাহারী নাম,তাতে পুস্তক ব্যবসায় হাত পাকানো ‘ডেকো’রাও তল পায়না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে এক বর্ষণমুখর রাতে দাঁড়িয়ে ভিজছিলাম। কারণটা শোনার দরকার নেই। হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হলো একটি লোক। কানের কাছে বলতে লাগল, ‘ পাকা হিমোগ্লোবিন পাবেন মামু । লাগলে বলবেন।
’ পাকা হিমোগ্লোবিন কি বুঝি নাই। শুধু এটুকু বুঝেছি লোকটি রক্তের দালাল। খাঁটি হিমোগ্লোবিন-এর কারবারি।
এই ডেকোদের নিয়ে একটা মজার গপ্প পড়েছিলাম প্রেমেন্দ্র মিত্রের কলমে। ভারতের বীরভূমের এক মন্দিরে যাওয়ার পথে দু’ধারে ভাতের হোটেলের পাশাপাশি অজস্র মিষ্টির দোকান।
পথচলতি পুণ্যার্থী মেয়ে-পুরুষের উদ্দেশে মুষকো মতো একটা লোক ক্রমাগত বলে চলেছে, ‘রসগোল্লা , ক্ষীরের সিঙারা , ছানার মন্ডা। ’ জনৈকা অতি আধুনিকা এক উর্বশী লোকটির সামনে এসে বললেন, ‘বোদে আছে’? দুই বাংলার মানুষ ওই মিষ্টান্নটিকে ‘বোঁদে (বাংলাদেশে বুঁন্দিয়া)বলে জানলেও জানি না কেন লিপস্টিক সর্বস্ব মহিলাটি চন্দ্রবিন্দুটি বর্জন করলেন। লোকটি বলল, ‘আজ্ঞে, কী বলছেন’? মহিলা আবার বললেন, ‘বোদে আছে’? লোকটি এবার আকর্ণ দন্ত কেলিয়ে গদগদ হয়ে বলল, ‘আজ্ঞে আমিই বদ্যিনাথ,পাঁচুর মা আমাকে বোদে বলেই ডাকে। ’
কথা হচ্ছিল ডেকোদের নিয়ে। যে ডাকে, সেই ডেকো।
শুদ্ধ বাংলায় ডেকো শব্দের ব্যবহার আলাদা। ডেকো বলতে সেখানে ডাকার অনুরোধ বোঝায়। তুমি যখন যাবে, তখন যেন আমাকেও ডেকো- এই জাতীয়। এই ডাকার গপ্প আজীবন চলমান। কত রকমের ডাক।
কী নামে ডেকে বলব তোমাকে? ‘ও মেয়ের নাম দেবো কি’ আহা,মাহমুদুনবীর কী রোম্যান্টিক গান! কতজন কতজনকে কত নামে ডাকে,কিন্তু বাপ-মার ডাকই ডাকনাম। বিখ্যাত মানুষের ডাকনাম ব্যবহারের রেওয়াজও চালু আছে। মাহমুদুনবীরই দুই সুযোগ্য তনয়ার ডাকনাম নুমা (ফাহমিদা) ও সুমা (সামিনা)। প্রয়াত সালমান শাহ’র ঘরের নাম ইমন। মজার ব্যাপার হলো,বাইরের যাঁরা তাদের ওই নামে ডাকছেন তাঁদের অনেকেই হয়তো ওইসব খ্যাতিমান মানুষদের চোখেও দেখেননি।
ওপার বাংলাতে এই রীতি আরো ভয়াবহ। বুম্বাদা,পুলুদা,রেণুদি,বেণুদি ইত্যাদি। সম্ভবত সত্যজিৎ রায় থেকেই ডাকনামের এই রমরমা শুরু। তবে ছবি বিশ্বাস থেকে উত্তম কুমার পর্যন্ত এই রীতি চালু ছিল না। দুই বাংলারই চোখের মণি শিবরাম বাবু তাই যতই বলুন না কেন, ডাকনামে কারও নাম-ডাক হয় না,ইদানীং কিন্তু নাম ডাকওয়ালাদের ডাকনামটাই পাবলিক বেশি খাচ্ছে।
ধর্মীয় ক্ষেত্রেও আমাদের আচরণ সেই ডেকোদের মতো। মসজিদমুখোদের স্রষ্টার নাম নিরানব্বুইটি। মন্দিরের ভগবান কৃঞ্চের নামও কড়ে গুনে মাত্র একশ আটখানা ! তবে আহলাদে আটখানা হয়ে বাঙ্গালি সবথেকে বেশি নামে যাকে ডাকে, সে তার প্রেয়সী। গোয়াল ঘরে জন্ম, বলে বাপ-মা হয়তো সাধ করে মেয়ের নাম রেখেছেন ‘গেঁদি’, কিন্তু সে নামে ডাকতে বয়েই গেছে প্রেমিকের। মস্তিস্কের নিউরন সেলে হারিকেন লাগিয়ে চলে চিরুনি অভিযান।
প্রেমিক আঁতি-পাঁতি করে খোঁজে তার প্রেয়সীর একখানা খাসা নাম। পেয়েও যায় তাগাদা।
একসময় নাম পাতানোর চল ছিল গ্রাম বাংলায়। মনমিষ্টি , সই,পদ্মপাতা ,কলমিলতা আরো কত কি। সে সব গল্পবন্ধুদের নাম।
নতুন সম্পর্কের গেঁড়ো। বাঙালি কিন্তু তার প্রিয়তমাকে এযাবৎ যত নামে ডেকেছে, তার মধ্যে সর্বজনপ্রিয় ‘রানি’ এবং ‘প্রিয়া’ নাম দুটি। এই রানি আগে ‘রাণী’ ছিলেন। এখন তিনি মুর্ধা থেকে নেমে এসেছেন দাঁতে। চিবিয়ে খাবেন বলেই বোধহয়।
তবে বাঙালির গদ্যে-কবিতায় কিন্তু রানির ছড়াছড়ি। নজরুল তো এক লাইনেই দুটি গেঁথেছেন-মোর প্রিয়া হবে এসো রাণি,দেব খোঁপায় তারার ফুল। ’ অথবা ‘মোর রানি তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে’-তে রানি নজরুলের সেই প্রেয়সী, যার কাছে হারের আরেক নাম জিত। বাঙালি কিন্তু রানির কাছে হারতেই চায়। সে গান ধরে, ‘ভালবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রানি।
’
ইতিহাসচারী এবং বইপোকারা বাঙালির রাজা বলতে রামমোহনকে বুঝে থাকে। কিন্তু রানি বললে অতলে পড়ে ! নাটোরের রানি ভবানী লক্ষৌর রাসমণি। বগ্ধিকমের দেবী চৌধুরানী থেকে উত্তর প্রদেশের ডাকাত-রানি ফুলন। আর গোটা উপমহাদেশ বললে সেই সুলতানা (রাণি) রাজিয়াকেই চিনে থাকে বাঙ্গালী।
তবে গায়ে ‘রেমন্ডে’র কমপ্টিèট চাপিয়ে বাঙ্গালী কিন্তু রাণি খুঁজেও থাকে।
সেই রাণির জন্ম হয় কোন কুঁড়ে-ঘরে কিংবা সোনার চামচ মুখে নিয়ে। তার বাবা ‘রানি’ ‘রানি’ করে ডেকে যখন আশ মেটে না, তখন সে তার আদরের ধনকে ডাকে ‘রাণু’ ‘রাণু’। বুকে ওড়না ওঠার আগে রাণুও জেনে যায়, সে রানি হতেই জন্মেছে। অন্তত একজনের। সেই একজনও হন্যে হয়ে রানি খুঁজছে।
রানির চুল দেখে, হাঁটা দেখে, কথা দেখে, রাঁধা দেখে,মাংসের পুর দেখে। তারপর দেনা-পাওনার হিসাব সেরে মাকে বলে, ‘তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি’।
সেই রানি আর রাজার চুলে একদিন পাক ধরে। দাঁত খসে পড়ে। হাতে লাঠি ওঠে।
তখন রানি রাজাকে বলে, ‘কাল সকালে আমাকে ডেকো,হাঁটতে বেরুবো’। আসল ডাকটা এখানেই। মনের ডাক। প্রাণের ডাক। সেখানে আমরা সবাই আমাদের সেই মামুদের ‘ডেকো’ বিশেষ।
যে খালি ডেকেই চলেছে। কাকে, তা সে নিজেও জানে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।