পুরনো প্রার্থীদের পরিবর্তে নতুন প্রার্থী চায় আওয়ামী লীগের তৃণমূল। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে ধারাবাহিক বৈঠকে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা অধিকাংশ আসনেই দলীয় প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি করেছেন। এই দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাও আগামীতে সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদীয় আসনে ক্লিন ইমেজের নতুন মুখ আনার আশ্বাস দিয়েছেন বলে দলের ঘনিষ্ঠ সূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেছেন। ৪, ৮ ও ১১ সেপ্টেম্বর ২১ জেলার তৃণমূল নেতার সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ ২১ জেলায় ১১১টি সংসদীয় আসন রয়েছে।
কমপক্ষে ৩০-৩৫টি আসনে এবার নতুন মুখ দেখা যাবে বলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ওই সূত্রটি জানিয়েছে। তৃণমূলের ওই বৈঠক থেকে উঠে আসছে সারা দেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিপর্যয়ের চিত্র। দলীয় সভানেত্রীর সামনেই পরস্পর বাহাসে লিপ্ত হয়েছেন একাধিক জেলার নেতারা। দলীয় সভানেত্রীর কাছে তৃণমূল নেতারা অভিযোগ করেন, ত্যাগী নেতা-কর্মীদের সঙ্গে এমপি-মন্ত্রীদের যোজন যোজন দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। টিআর-কাবিখা এমপিরাই খেয়ে ফেলেন।
দলের নেতা-কর্মীদের কোনো খোঁজখবর রাখেন না এমপি-মন্ত্রীরা। নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করলেও এলাকায় গিয়ে নিরপেক্ষ সাজেন। দলে নবাগত হাইব্রিডদের নিয়ে বলয় গড়ে তোলেন। এবার আর বিতর্কিত এমপিদের মনোনয়ন দিলে পাস করানো যাবে না। এসব প্রার্থী পরিবর্তন করলে আবারও সব কটি আসন আওয়ামী লীগকে উপহার দিতে পারবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন জেলা নেতারা।
বৈঠকের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ১০টি প্রশ্নসংবলিত একটি করে ফরম তুলে দেওয়া হয় তৃণমূল নেতাদের হাতে। ওই ফরম সতর্কতার সঙ্গে পূরণের আহ্বান জানিয়ে তিনি প্রতিটি আসনের তৃণমূল নেতাদের আগামী নির্বাচনে দলের তিনজন করে প্রার্থীর নাম সুপারিশ করতে বলেন। সেই সঙ্গে ১০টি প্রশ্নের প্রতিটিতে ১০ নম্বর করে ১০০ নম্বরের মধ্যে কাকে কত নম্বর দেবেন তাও দিতে বলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রার্থী বাছাইয়ে দলের বর্তমান এমপিদের অনেকের নাম উত্তরপত্রে স্থান পায়নি বলে একাধিক নেতা জানিয়েছেন। এটা এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
তৃণমূল নেতাদের ফরম পূরণের মাধ্যমে জেলায় আগামী নির্বাচনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সর্বশেষ অবস্থান, জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটার, মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্ব, কোথায় কোথায় দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা বিবাদ আছে, সাংগঠনিক অবস্থা ইত্যাদি সব কিছু নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ জরিপের কাজ সেরে ফেলেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, তৃণমূল নেতাদের এই জরিপের মাধ্যমে গৃহীত মতামত এবং নিজ উদ্যোগে পরিচালিত বিভিন্ন জরিপের রিপোর্ট পর্যালোচনা করেই আগামী নির্বাচনে দলের প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে। দলীয় সূত্রমতে, তৃণমূল নেতাদের ওই রিপোর্ট মূল্যায়নের জন্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ এবং প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সামাজিক বিষয় সম্পর্কিত উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন আহমদ কাজ করছেন। তারা এরই মধ্যে তৃণমূলের মূল্যায়ন ও জরিপ নিয়ে দলীয় সভানেত্রীর সঙ্গে কথাও বলেছেন। এর আগেও তিনটি পৃথক জরিপ ও বর্তমান তৃণমূল নেতাদের মূল্যায়ন মিলিয়ে দেখে এই ১১১টি আসনে কমপক্ষে ২০-২৫ জন এমপির মনোনয়ন না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এদের মধ্যে কমপক্ষে দুজন মন্ত্রীও রয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, নানাভাবে বিতর্কিত হয়ে পড়া বেশ কিছু বর্তমান এমপি আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাবেন না। কোনো বিতর্কিত ব্যক্তিকে দলীয় টিকিট দেওয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন, এখন থেকেই দলীয় প্রার্থী ঠিক করা হচ্ছে। প্রার্থী নিয়ে যেন কোনো ধরনের ঝামেলা না হয় সে জন্য আগে থেকেই প্রার্থী বাছাই করা হচ্ছে।
তৃণমূল নেতারা দীর্ঘ দিন ধরে সম্মেলন না হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদেরও দায়ী করেন। তারা দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নিষ্ক্রিয়তারও সমালোচনা করেন। বুধবার মতবিনিময় সভায় নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা প্রধানমন্ত্রীর সামনেই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত আনোয়ার হোসেন এবং খোকন সাহা শামীম ওসমানের পক্ষের লোক হিসেবে চিহ্নিত। ময়মনসিংহ-৩ আসনের সংসদ সদস্য স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মজিবুর রহমান ফকির, ময়মনসিংহ-৭ আসনের এমপি মোহাম্মদ আমানউল্লাহ, বিতর্কিত এমপি গিয়াসউদ্দিন আহমেদসহ জেলার প্রায় সব এমপির বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন ময়মনসিংহ জেলার নেতারা।
এসব প্রার্থী পরিবর্তন করলে আবারও সব কটি আসন আওয়ামী লীগকে উপহার দিতে পারবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাদের জানান, কোনো জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। এদিকে নোয়াখালী জেলা সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরীকে ৫ সেপ্টেম্বর জেলা আওয়ামী লীগ তলবি সভা করে বহিষ্কার করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, জেলার এখতিয়ার নেই কাউকে বহিষ্কার করার। আমি তথ্য সংগ্রহ করছি কার এত বড় সাহস।
তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সিলেট সদর দক্ষিণের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাইফুল আলম সিলেট-৩ আসনের এমপি মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীকে ইঙ্গিত করে বলেন, অনেক এমপি নিজ দলে কোন্দল সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হন না; জামায়াত-শিবিরকেও মদদ দেন। তিনি বলেন, সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে গত উপজেলা নির্বাচনে এ আসনের দুটি উপজেলা ফেঞ্চুগঞ্জ ও দক্ষিণ সুরমায় জামায়াতের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। একই ভাবে সিলেট-৪ আসনের এমপি ইমরান আহমদের কারণে এ আসনের জৈন্তাপুর উপজেলায় জামায়াত ও গোয়াইনঘাটে বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন।
পটুয়াখালী-১ আসনে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শাজাহান মিয়ার পরিবর্তে বিকল্প প্রার্থী চেয়েছেন জেলার তৃণমূল কর্মীরা।
পটুয়াখালী-১ (সদর, দুমকি ও মির্জাগঞ্জ) আসনে এমপি নির্বাচিত হয়ে শাজাহান মিয়া ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি, মেয়র ডা. শফিকুল ইসলাম তৃণমূলের সভায় বলেন, '১৬ বছর ধরে দলের সম্মেলন হয় না। ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর দুই ছেলের টেন্ডারবাজির কারণে দলের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হওয়ায় এবং আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পদগুলো তার (প্রতিমন্ত্রী শাজাহান) পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে দখল করে নেওয়ায় এবং তৃণমূল কর্মীদের আদৌ মূল্যায়ন না করায় পটুয়াখালীর আওয়ামী লীগ কার্যত অচল। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জানান, সব তথ্য আমার হাতে রয়েছে। কে কী করছেন, সব আমার জানা।
৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে টঙ্গাইল জেলার সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান ফারুক বলেন, দ্বন্দ্ব-কোন্দল ও বিরোধ নিরসন করতে না পারলে তা দলের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কালিহাতী উপজেলা সাধারণ সম্পাদক আনসারি বলেন, যে কোনো পরিস্থিতিতে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে জেলার মন্ত্রী-এমপিদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আর ঐক্য নিশ্চিত করতে নেত্রী আপনার দিকনির্দেশনা জরুরি। টাঙ্গাইল-৬ আসনের এমপি আবদুল বাতেনের সমালোচনা করে দেলদুয়ার ও নাগরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই নেতা বলেন, তিনি আওয়ামী লীগের লোকজনকে এড়িয়ে চলেন। ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম লেবু বলেন, টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের জন্য শনির দশা বয়ে আনছে খান পরিবার।
তারা জেলা আওয়ামী লীগকে গ্রাস করতে চায়। যশোর জেলার সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার তার বক্তৃতায় বলেন, বিতর্কিত সংসদ সদস্যদের বিষয়টি কড়াভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের মধ্যে যারা গত সাড়ে চার বছরে নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করেননি তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, ঢাকায় ডেকে এনে মনোনয়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা ঠিক হবে না। মনোনয়ন দেওয়ার আগে শুধু জেলা নেতাদের নয়; ওয়ার্ড, ইউনিয়ন পর্যায়ের মতামতও নিতে হবে।
জেলা, উপজেলার নেতারা লেজুড়বৃত্তি করেন। তাদের মতামত সঠিক মানদণ্ডে হবে না। তাই গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করলে সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। তার এ বক্তব্য সমর্থন করেন অন্যান্য জেলার উপজেলা নেতারাও। কুড়িগ্রাম-৪ আসনের এমপি জাকির হোসেনের সমালোচনা করে চিলমারী ও রৌমারী উপজেলার নেতারা বলেন, তিনি এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর নেন না।
অন্য দল থেকে আসা নেতাদের নিয়ে চলেন। আগামীতে তাকে মনোনয়ন দিলে দলের নেতা-কর্মীরাই কাজ করবেন না। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাদের বলেন, আপনাদের মতামতের ভিত্তিতেই দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।