যখন বিকাল হতে থাকে, হতে হতে সূর্যটা ঢলে পড়ে, পড়তে থাকে
আনোয়ার হোসেন ওরফে নারায়ন চন্দ্র দাসের রিকশায় সকালে বাসস্টান্ড থেকে বাসায় ফিরছিলাম শশুর মহাশয়কে দেশের বাড়ীর বাসে উঠিয়ে দিয়ে। তবে নামটা জেনেছি বিদায়ের আগমুহূর্তে। সকালটা ছিল আমার জন্য ভিন্ন রকম। এ বিষয়ে কিঞ্চিত বলেছি শাহানার প্রিয় কেউ পাশে থাকুক শীষর্ক লেখাটা পড়ে । সেখানে বলেছিলাম, আজকে দিনটা অন্যদিনের মত শুরু হয়নি।
বহুদিন অপরিচিত গন্ডী, মানুষ, প্রকৃতির সাথে আমার কোন ইন্ট্যারএ্যাকশন ছিল না। ৭ বছর যাবত এমনই চলেছে। পরিবার আর দীর্ঘকাল যাবত পরিচিত জনদের নিয়ে তৈরী একটা ক্ষুদ্র গন্ডির বাইরে পড়ে থাকা বিশাল বিশ্ব দেখার জন্য মনির ছিল আমার জন্য দরজা বিশেষ। পৃথিবীকে আমি চিনেছি তার হাত ধরে। চারিপাশের মানুষ, প্রকৃতি, ঘটনাপ্রবাহ থেকে যে এত আনন্দ কুড়িয়ে নেয়া যায় তা আমার অজানা ছিল।
৭ বছর আগে আমাদের দুজনের বাসা দুই শহরে স্থাপিত হয়েছিল। তারপরে অদ্যাবধি দেখা হয়েছে সাকূল্যে ১০ বার এবং ফোনে কথা হয়েছে যৎসামান্য। কিন্তু আচমকা আজকে মনিরের চোখ দিয়ে প্রভাতটিকে দেখলাম। নিজে থেকে প্লান করে দেখা শুরু করেছি বা আমার উলবদ্ধ হচ্ছে, তা নয়, ঘুম থেকে সাত সকালে উঠে যখন রাস্তায় বেড়ুলাম তখনই মনে হলো - আরে এ তো আমার পরিচিত পৃথিবী নয়! আমার অজান্তে কোন কাযর্কারণ ছাড়াই অদ্ভুত ভিন্ন এক সকাল আমার চোখে প্রতিভাষিত হলো। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি মানুষের চেহারার ভাষা, প্রকৃতির ছন্দ সব যেন আমার সাথে কথা বলে উঠল।
আমি দেখলাম আর প্রতিটি মুহূর্তকে হৃদয়ের ভেতরে গেড়ে নিলাম। আগে এসবতো দেখিনি কখনো! হয়তে কেবল তাকিয়েছিলাম যাকে কোনভাবে দেখা বলে না।
বাকীটুকু এখন বলবো, মানবকে দেখাও যে মস্তিস্কের সেলগুলোকে ক্লান্ত করে ফেলে সে কাহিনী। নারায়ন চন্দ্র দাসের রিকশায় চড়ে ভাবছিলাম একটু আগে বাসস্টান্ডে এক রক্তাক্ত ছিনতাইকারীর কথা। তাকে ঘিরে রেখেছিল অর্ধশত মানুষ আর পেটাচ্ছিল দয়ামায়াহীনভাবে।
আমিও ভীড়ের মাঝে উঁকিঝুঁকি মেরেছি আর বিভৎস চেহারা দেখে আতঁকে উঠেছি। কানাঘুসায় আর উদ্যোমী দুই পেটুয়ার রাগত বাক্যের ফুলঝুড়িতে বুঝলাম তাহারা এই ছিনতাই ঘটনাটির ভুক্তভোগী, কাজেই পেটানোতে তাদের অধিকার সর্বাগ্রে। পেটানো হচ্ছে যাকে তার ট্যাক্সিতে চেপে দিনাজপুরের বাস ধরতে আসছিলেন। অন্য একটা ট্যাক্সিতে করে ছিনতাইকারীরা এসে তাদের ট্যাক্সি থামায়। যদিও তখন ড্রাইভারের গলায় ছুরি ধরা হয়েছিল, কিন্তু সেও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।
স্ত্রীর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে নিয়েছে ৯ ভরি সোনার অলংকার, আর দামী মোবাইল সেট। ছিনতাইকারীরা পিঠটান দেয়ার পরে অতি আত্মবিশ্বাসী ড্রাইভার তাদের বাসস্ট্যান্ড পৌছে দিতে এসে ধরা খেয়েছে। কর্তার কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল, আর যায় কোথায়! শুরু হয়ে গেল উত্তম-মধ্যম। তার সহছিনতাকদের বের করার জন্য পেটের কথা পিটিয়ে বের করার একটা মহৎ প্রচেষ্টায় লিপ্ত। আমার পাশে দাড়ানো এক বৃদ্ধা আ-হা-রে করে উঠলেন, ছিনতাইকারীর চেহারা বলে তখন আর কিছু আলাদা করা যাচ্ছিল না।
আমি ঝামটা বেড়ে বৃদ্ধাকে বললাম, এখন দরদ দেখালে মাল উদ্ধার হবে কিভাবে! আমার ভেতরেও কাজ করছিল এক প্রকার আক্রোস, মনে হচ্ছিল ব্যাটাকে লাগাই দুচার ঘা, কিছুদিন আগে সদ্য কেনা মোবাইলসেট হাইজ্যাকের দুঃখটা লাঘব হয়নি এখনো। এইসব ভাবাভাবির সময় রিকশাআলা বললো স্যার আপনি যেখানে যাবেন সে জায়গাটির নাম যা বললেন, আমরা কিন্তু ঐ এলাকাটাকে অন্য নামে ডাকি! কি আশ্চর্য্য আপনারা এক নামে ডাকেন আর আমরা রিকশাআলারা আরেক নামে ডাকি! এক জায়গার দুই নাম! আমিও জানি বিষয়টা। তারপরেও রিকশাআলার এমন সুক্ষ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দেখে অবাক হই।
রিকশা জ্যামের মধ্যে দাড়িয়ে আছে। অসংখ্য ভ্যান শাক-শবজী ভর্তি করে রাস্তা আগলে দাড়ানো।
এ জায়গা থেকে ঢাকা শহরের সব ভ্যান-শবজী-ফেরিওয়ালাদের দিন শুরু হয়। অদ্ভুত লাগলো দৃশ্যটি। সাড়ি সাড়ি ভ্যান দাড়িয়ে আছে। একবার এমন একটা দৃশ্য দেখেছিলাম স্থলে নয়, জলে। সেখানে ছিল সাড়ি সাড়ি নৌকা, শাক-শবজী ভর্তি।
জীবনে তো কত জায়গায় গিয়েছি, এখন মনে করতে পারছি না, কিন্তু দৃশ্যটা চিরজাগরুক হয়ে আছে অন্তরে। শমিতের মত বলতে পারি এসব দৃশ্য স্ক্রীন জীবনের ছবিকে বড় এলোমেলো করে দেয়। ভাবছি এ চলমান বাজার নিয়ে একটা মার্কেটুমেন্টারী বানাবো। শরৎকে বলতে হবে। জ্যাম ছুটে যাওয়ায় এক ঝাক দমকা হাওয়া এসে গায়ে লাগলো ।
সম্বিত ফিরে পাই রিকশাআলার কথায়। রোজা রেখে রিকশা চালাতে বড় কষ্ট। আমি অবাক হই। এ পর্যন্ত কোন রিকশাআলাকে দেখিনি রোজা রাখতে। আমি জিজ্ঞেস করি, সারাদিন চালান? সে জানায় ফজরের নামাজের পর ১০০ টাকা হওয়া পর্যন্ত চালায়।
যেটা হয়ে যায় ৯টার মধ্যেই। তারপরে ইফতারের আগে ৫০ টাকা হওয়ার জন্য ঘন্টাখানেক চালায়। অতপর তারাবী পড়ে ১৫০/২০০ টাকা হওয়া পর্যন্ত চালায়। রাত্র ১১/১২ টা বেজে যায়। আমি হিসেব কষে দেখি ৩৫০ টাকা।
বলি আয় বাণিজ্যতো ভাল! গ্রামীন ব্যাংকের দারিদ্রসীমা নির্ধারণের সূচক চালিয়ে দেখি সপ্তাহে ২০০ টাকা অনায়েসে সে ঋনের কিস্তি দিতে পারে। মনে পড়ে ডঃ ইউনুসের রাজনৈতিক পার্টি নিয়ে চালানো চ্যানেল আইয়ের এসএমএস জরিপের কথা। প্রতিদিন সন্ধ্যার খবরের সময় ইমার্জ এ অথবা বি লিখে দেড় টাকা ধ্বংষ করা এখন আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। গতকালের বিষয় ছিল, ডঃ ইউনুস রাজনৈতিক দল তৈরী করবেন প্রয়োজন হলে, আপনি কি এর সাথে একমত? একমত হলে এ আর না হলে বি লিখে পাঠিয়ে দিন ২৩৪৫ এ। গতকাল আমি যতক্ষণ চ্যানেল আইএ লটকে ছিলাম তখন পর্যন্ত স্কোর ছিল এঃবি = সত্তরঃত্রিশ।
এ'তে অবশ্য আমারও একটা মেসেজ ছিল। আনোয়ার ওরফে নারায়নের সাথে কথা বলতে বলতে মনে হলো তার উপরেও জরিপটা চালাই। সে বললো আনডিসাইডেড। আমি ভাবি এ, বি-র সাথে সি যোগ করতে হবে।
আনোয়ারকে জিজ্ঞেস করি আপনি রোজা রাখেন এ জন্য হয়তো আপনায় আয়ে বরকত হচ্ছে।
সে বলে, আসলে ভাই আমি কনভার্টটেড মুসলিম। এখন ধর্ম ঠিকমত না করলে খারাপ লাগে। মনে হয় কেন তবে মুসলিম হলাম! আমি আরো একবার চমকে যাই। জিজ্ঞেস করি কি মনে করে মুসলিম হলেন? সে বলে একদিন স্বপ্নে দেখলাম আমি জুমার নামাজ আদায় করছি মসজিদে। পরের দিন মুসলিম হয়ে গেলাম।
কোর্টে গিয়ে নাম রাখলাম আনোয়ার হোসেন।
আমার ভাবনা অতলান্ত ঘুরে কোন কূল কিনারা পায়না। চোখের সামনে ভেসে ওঠে উইলসনের ভিডিও। জেহাদীদের গলাকাটার দৃশ্য। হাইজ্যাকারের বিভৎস, রক্তাক্ত অবয়ব।
মানবকে দেখা বড় বিচিত্র কষ্টদায়ক। প্রতিটি ছবি মাথায় জমা হতে থাকে। তার পারিপার্শ্বিকতা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নিজের মত করে একটা গবেষণাও হয়ে যায়। তারপরে একটু একটু ব্যাথা হতে থাকে।
ব্রেন থেকে শরীর বেয়ে নামে, অবিশ্বাসের স্রোতধারা। প্রতিদিনের এত সুখ, দুখ দেখে দেখে আমার সময় কেঁটে যায় ধাবমান অশ্বের গতিতে, খেয়াল থাকে না নিজের দিকে তাকাবার।
মনির তোমার দরজা বন্ধ কর! আমি আর মানুষকে দেখতে চাই না, বড় কষ্ট দেয় এ প্রানীরা!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।