যা বুঝি, যা দেখি, যা শুনি এবং যা বলতে চাই
তত্ত্বকথার সাথে বৃক্ষ-লতার সম্পর্ক কাকতালীয়। যাদের আফসোস হয় বাঙাল মুল্লুকে আপেল গাছ নাই বলে তারা মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারলেন না, তাদেরকে শান্ত্বনা দিয়ে কাঁদাতে আসিনি আমি। তবে অস্বীকার করবো না এই ছোট্ট অথচ বড় বেশি প্র্যাকটিক্যাল তত্ত্বের জন্ম হয়েছিল একটি বৃক্ষতলায়ই, অশ্বত্থতলায়। তবে অশ্বত্থের ফল-পাতার টুপ করে পরার সাথে এই তত্ত্বের জন্মের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং খাঁচা জব্বারের (খাঁচায় করে মুরগি বেচতো বলে এই নাম) ছেলে জয়নাল যখন ঐ গাছতলায় চায়ের দোকান খুললো তখন খদ্দের বসার বেঞ্চের উপর প্লাস্টিকের বস্তা কেটে জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা শামিয়ানা দিলো টাঙ্গিয়ে।
সুতরাং থিওরির বা সূত্রের ইন্সপিরিশেন যে টুপ করে মাথায় পরে বিভ্রাট লাগিয়ে দেবে সেরকম কোনো আশংকা ছিল না। তবে বৃক্ষের ফল-পাতা আটকানোর চেয়ে জয়নালের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার চায়ে যাতে বেয়াদব পক্ষীকূল কোনো বাড়তি হোয়াইটনার যুক্ত করতে না পারে তা নিশ্চিত করা।
পণ্যের মানের দিকে জয়নালের নজর কড়া হলেও তার চা এমন আহামরি কোনো পানীয় ছিল না। বরং বিকালে ও যে গরম তেলেভাজা পিঠা নামাতো তার কারণেই আমাদের বৈকালিক আড্ডা ঐ অশ্বত্থতলায় স্থানান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। সদলবলে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আমরা বিকাল থেকে সন্ধ্যা ওর দোকানের এক অংশ দখল করে রাখতাম।
জয়নাল পিঠা নামাতো, আর সাথে সাথে তা ছোঁ মেরে নিয়ে যেত একেকজন। তেলেভাজা নাকি তাওয়ার উপর থেকে ডাইরেক্ট মুখে ঢুকানোই শাস্ত্রসম্মত। কিন্তু ঠিক এত গরমকিছু মুখগহ্বরে পুরে ফেলার ক্ষেত্রে আমার দক্ষতা একেবারেই ছিল না। আমি তেলেভাজাগুলোর ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতাম, কিন্তু গরমাগরম ভক্ষণে বিশ্বাসী বন্ধুদের পাকস্থলী পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো তেলেভাজাই আমার জন্য নিরাপদ তাপমাত্রায় পৌঁছাতে পারতো না। সুতরাং দু' হাতে তেলেভাজা জাগলিং আর ফুঁস করে এর ভেতরের গরম ভাঁপ বের করে দিয়ে বত্রিশদন্ত দিয়ে তাতে আক্রমণ ও মুখে নিয়ে চোখমুখ ঘুরিয়ে ভক্ষণপর্ব রসিয়ে সমাপ্ত করার সাকর্াসের দর্শক হয়েই বসে থাকতাম আমি একা।
আমার অদক্ষতায় মনে পীড়া হতো জয়নালের। একদিন একা পেয়ে সে আমাকে জিজ্ঞেস করেই বসলো, 'দাদা গরম পিঠা কি আপনি একেবারেই খেতে পারেন না?' আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম, কোনো বন্ধু-বান্ধব এখনও গাছতলা পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি। তারপর তেলেভাজা ভক্ষণপর্ব সাকর্াস দেখতে দেখতে দেখতে হতাশ হয়ে অশ্বত্থতলায় বসে থাকা সময়ে মনে মনে তৈরি করা তত্ত্বটা তাকে শোনালাম। জয়নালের পর আপনারাই প্রথম এর শ্রোতা-পাঠক।
'শুনো জয়নাল, গরম খাবার টপাটপ খেতে পারতে হলে কম্পিটিশনের ফ্যামিলিতে বড় হতে হয়।
আমি তো বাড়ির একমাত্র সন্তান। মা যখন পিঠা বানিয়ে চুলা থেকে নামায়, তখন কাড়াকাড়ি করে ওগুলো খাওয়ার জন্য আমার বাসায় তো আর ডজনখানেক ভাই-বোন নেই। তাই ওরকম সার্কাসের জাগলিং আমি শিখে উঠতে পারিনি'।
'কম্পিটিশনের ফ্যামিলি' শুনে জয়নাল বোধহয় কিছুটা মনে আঘাত পায়। 'জন্মনিয়ন্ত্রণের' দুনিয়ায় ওর ভাইবোন বারোজন।
কিছুক্ষণ চুপচাপ ভেবে ও তত্ত্ববিরোধী উদাহরণ খুঁজে বের করে। 'কিন্তু দাদা, আমাদের রতন দাদার তো মাত্র একটি বোন। অথচ রতন দাদাই সবার আগে তেলেভাজা ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। তার ফ্যামিলিতে তো কোনো কম্পিটিশন নাই'। শক্ত পর্যবেক্ষণ! বাধ্য হয়েই আমাকে তত্ত্বটা টেনে বাড়াতে হয়।
বলি, 'ওরা না হয় দু'জন। কিন্তু ওদের বাপ-চাচারা নয়জন। ফুফু ক'জন ছিলো তা জানিনা। ধরো সব মিলিয়ে বারোজন। বংশের এক সিঁড়ি আগের শিক্ষা এত তাড়াতাড়ি যায় কি করে? অন্তত: তিনসিঁড়ি তো লাগবে।
'
জয়নাল এইবার মনে হয় আশ্বস্ত হয়। বলে, 'তা মনে হয় দাদা ভুল বলেন নাই। আমরা বারো ভাইবোন হলে কি হবে, আমার বাবা-তো দাদা-দাদীর একমাত্র সন্তান। আর আপনি তো দেখেছেন, চা কিন্তু আমি ঠান্ডা না করে খেতে পারি না'।
আমি তখন তত্ত্বকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির দিকে এগিয়ে দেই, 'হুম, তেলেভাজা গরম খাওয়ার জন্য রক্তে কম্পিটিশনের জিন থাকা লাগে।
দেখো একদিন ডিএনএ পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা এই সত্যই প্রতিষ্ঠা করবে'। জয়নাল সানন্দে মাথা ঝাঁকায়। আমি আরেকবার চারপাশে তাকিয়ে দেখি বন্ধু-বান্ধবরা কেউ এখনও এসে হাজির হয়নি।
এবার নিশ্চিতমনে আমরা দু'জন, মানে আমি আর জয়নাল, ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ে চুমুক দেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।