তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা
এ পর্যন্ত তিনি শুধু শিশুদের জন্য লিখেছেন ৭০০ টির বেশি বই। তার একটি বই বিক্রি হয়েছে প্রায় ৭০ লাখ কপি। বিস্ময়কর এ লেখকের জীবন ও কর্ম নিয়ে এ লেখাটি।
..............................
জীবনের আয়ুজগতে শিশুকাল বাদ দিয়ে যেমন কেউ পূর্ণতার তারুণ্য কিংবা যৌবনে পৌঁছতে পারে না, তেমনিভাবে সাহিত্যজগতেও শিশুসাহিত্য বাদ দিয়ে কোনো জাতি কিংবা দেশ অথবা ভাষা-সংস্কৃতির সাহিত্য পূর্ণতায় পৌঁছতে পারে না। যে বাচ্চাটি তার আনন্দময় শৈশবে নিত্য নতুন বইয়ের সুঘ্রাণ ও সুবর্ণ সাহচর্য থেকে বঞ্চিত- সে বড় হয়েও বইয়ের সুন্দর সান্নিধ্য থেকে দূরে এবং এসব তার কাছে চিরঅবহেলিত।
দুরন্ত কৈশোর কিংবা উন্মাদনাময় তারুণ্যের অস্থির সময়ে যখন কেউ দিশেহারা, মা-বাবা এবং আশেপাশের স্বজন-গুরুজনদের আদেশ-নিষেধে যখন কান ঝালাপালা, এমন নিঃসঙ্গ একাকিত্বে ‘ভালো’ বইয়ের সঙ্গলাভ তার জন্য সর্বোত্তম ব্যবস্থা এবং কার্যকর দাওয়া।
মন খারাপের দুঃসময়ে একাকী অবসরে যখন সে ভালো বইটি হাতে নিয়ে বসবে, দৃশ্যমান অভিভাবকের উত্তপ্ত বকা-ধমক কিংবা আদেশ-উপদেশের চেয়ে অদৃশ্য লেখকের শব্দহীন গল্প-অভিজ্ঞতা এবং উপসংহারে মোড়ানো শিক্ষনীয় ঘটনা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য আপন মনে হবে, অদেখা লেখকের আবেগ-অনুভূতি সে নিজের ভেতর ধারণ করে হাসি-কান্নায় আকুল হবে, বইয়ের নির্বাক পাতার সাথে এমন নীরব কথোপকথনের মধ্য দিয়েই তার চঞ্চল মনে ধৈর্য, আত্মপরিচয় এবং আত্মবিশ্বাসের চারা রোপিত হবে। এভাবেই কালো কালির শব্দ ও বাক্যের নির্যাসে তার অপরিপক্ক চিন্তা-ভাবনার ডালপালাগুলো শক্ত হবে, কল্পনার রাজ্য ছেড়ে সে তার চারপাশের সমাজ ও বাস্তবতার সাথে নিজেকে মিলিয়ে নেবে।
বইয়ের সাথে এমন মিশে যাওয়ার মানসিকতার সূচনা হতে হবে শৈশবকাল থেকে। চারপাশে গভীরভাবে অবলোকন ও পর্যবেক্ষণের যে স্পর্শকাতর সময় শিশুটি পার করছে, তখন যেন তার হাতে রং-বেরঙের বইপত্র থাকে।
আশেপাশের মন্দ জিনিসগুলো না দেখে তার কৌতুহলী দৃষ্টি ও অনুসন্ধিৎসু মন যেন বইয়ের রাজ্যে ডুবে থাকে। ধীরে ধীরে বই তার আশ্রয় হয়ে উঠবে, বইয়ের পাতা তার বন্ধুতালিকায় অবস্থান নেবে, তার সুখ-আনন্দের সঙ্গি হিসেবে বই আপন জায়গা খুঁজে নেবে।
শিশুদের জন্য লেখালেখির বিষয়টি যে মোটেও ফেলে দেওয়ার মতো নয়, তা আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আরববিশ্বের বেশ কয়েকজন নামকরা জনপ্রিয় লেখক-সাহিত্যিক। তারা অন্তত এ সত্যটুকু অনুধাবন করেছেন যে, জাতি হিসেবে সুশিক্ষিত সচেতন হতে হলে শিশুর মন-মানস গঠনে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। আর এ গঠন ও পরিচর্যা প্রক্রিয়ায় শিশুসাহিত্যের প্রতি যতœবান হওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প উপায় কিংবা সমাধানও নেই।
এমনই একজন বিস্ময়কর শক্তিমান লেখকের পরিচয় ও কর্মবর্ণনা দিয়েই এ লেখাটির বাকি অর্ধাংশ।
আব্দুত তাওয়াব ইউসুফ। আরব দুনিয়ার শিশুসাহিত্যে জনপ্রিয় লেখকদের অন্যতম একজন তিনি। শুধু জনপ্রিয় নয়, তিনি প্রচুর লেখেন এবং তার লেখা বইয়ের বিক্রিও বিস্ময়কর। কাতারের শিশুতোষ ওয়েবম্যাগাজিন ‘কানা’র তথ্যমতে, আব্দুত তাওয়াব ইউসুফ এ পর্যন্ত আরবশিশুদের জন্য প্রায় কয়েকশ বই লিখেছেন।
এসবের মধ্যে শুধু মিশরে ছাপা হয়েছে শিশুদের জন্য লেখা তার ৫৯৫টি ছোট-বড় বই। আর অন্যান্য আরব দেশগুলোতে ছাপা হয়েছে ১২৫টি শিশুসাহিত্যমূলক গ্রন্থ। এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। শিশুদের পাশাপাশি সময় ও সুযোগমতো বড়দের জন্যও কলম হাতে নিয়েছেন তিনি। লিখেছেন প্রায় ৪০টি বই।
আর এ বইগুলো সর্বমোট বিক্রি হয়েছে বিশ মিলিয়ন কপির বেশি। এসবের বাইরে শিশুদের জন্য তিনি টেলিভিশন ও রেডিওতে অসংখ্য প্রোগ্রাম করেছেন।
আব্দুত তাওয়াব ইউসুফের লেখা সবগুলো বই আরববিশ্বে বিক্রয় তালিকায় শীর্ষে। এসবের মধ্যে দুটি বই কয়েক মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। ‘হায়াতু মুহাম্মাদ সা. ফী ইশরীন কিসসা’ বইটি এ পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ৭০ লাখের বেশি।
اবইটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে গল্পে আঁকা সীরাত- হে মুহাম্মদ' নামে। আর ‘খিয়ালুল হাকল’ নামের আরেকটি বই বিক্রি হয়েছে ৩০ লাখেরও বেশি।
আরবী সাহিত্যে শিশুদের জন্য তার অসামান্য কীর্তির প্রতি সম্মান জানাতে ১৪১১ হিজরীতে বাদশাহ ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন আব্দুত তাওয়াব ইউসুফ। নিজের দেশ মিসরও তার এ কৃতী সন্তানকে ফেলে দেয়নি। শিশু সাহিত্যে মিসরের রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে তিনি সম্মানিত হয়েছিলেন ১৯৭৫ সালে।
শিশু সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পেয়েছেন ১৯৮১ সালে। ১৯৯২ সালে সশস্ত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে পেয়েছেন বিশেষ পুরস্কার। এসবের বাইরেও বিভিন্ন সময়ে নানা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের পুরস্কারও জমা হয়েছে এ গুণী মানুষের সৌভাগ্যঝুলিতে। শিশুদের মানসিক পরিচর্যা ও মানবিক চরিত্র গঠন প্রক্রিয়ায় তার অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য তিনি দেশে-বিদেশে আমন্ত্রিত হয়েছেন ৭০টিরও বেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে।
১৯২৮ সালের ১লা অক্টোবর তারিখে মিসরে জন্মগ্রহণকারী এ লেখক কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেন ১৯৪৯ সালে।
আরববিশ্বে তিনিই প্রথম শিশুদের জন্য ইসলামী ম্যাগাজিন বের করেছিলেন ১৯৬৯ সালে এবং এটির নাম রেখেছিলেন ফিরদাউস। ১৯৭৫ সাল থেকে তিনি শুধুই শিশুদের জন্য লেখালেখি ও সৃজনশীল কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন।
সাহিত্য সমালোচকদের মতে, আব্দুত তাওয়াবের এমন বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে মূল কারণ তার অনবদ্য সৃষ্টির সাথে তিনি আকর্ষনকে জুড়ে দিয়েছেন। লেখক নিজেও মনে করেন, পশ্চিমা বিশ্ব শিশুদের কৌতুহলী মনের আগ্রহ ও উৎসাহের জায়গাটি ধরতে পেরেছে। তারা শিশুসুলভ বইগুলোতে আগ্রহ, ঘোর এবং আকর্ষনের সব রূপ-রস ঢেলে দিয়েছে।
ফলে কচিমনের খোকাশিশুরা ওদের রঙ-রেরঙের কার্টুনসম্বলিত বইগুলোর প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে উঠছে। এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে আরব লেখকরা এখনও নিজেদের লেখালেখিতে শিশুদেরকে শিক্ষা ও উপদেশ দিয়ে ভরে ফেলছেন। আব্দুত তাওয়াব ইউসুফ সমগোত্রীয় লেখকদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, আরব লেখকবন্ধুরা শিশুদের বাড়ন্ত মানসিকতার চাহিদা বুঝতে পারছেন না। তারা বাচ্চাদের মনের গতি-প্রকৃতির কাছে নিজেদের কর্মকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারছেন না। এদিক দিয়ে পশ্চিমা বিধর্মীরা আমাদের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
শিশুসাহিত্যে কর্মসাধনায় চিত্রায়ন ও ছবি ব্যবহারের প্রতি যতœবান আব্দুত তাওয়াব ইউসুফ। ছবি এঁকে দিয়ে শিশুর কচিমনে গল্পটির জীবন্ত রূপায়ন করে দিতে আগ্রহী তিনি। পাশাপাশি শব্দ ও বাক্যের খেলায় শিশুকে বইয়ের রাজ্যে নিমগ্ন রাখার জন্য স্নেহসিক্ত রসের পরিমিত সংযোজনেও পারদর্শী তিনি। এসবের সমন্বয়ে আব্দুত তাওয়াবের লেখা কুরআন-হাদীসের নানা পুরনো ঐতিহাসিক গল্প-ঘটনাগুলোও জীবন্ত নতুন হয়ে উঠে শিশুদের মনোজগতে। তিনি তার শব্দবাহনে চড়িয়ে ছোট্ট পাঠককে ফিরিয়ে নিয়ে যান নবীদের যুগে, ছবির তুলিতে তাকে দেখিয়ে আনেন আবরাহার হাতি, সুলাইমানের পিঁপড়া কিংবা আবাবিল পাখিটি।
তিনি গল্পের ছলে শিশুদের কাছে তুলে ধরেছেন- হযরত উমর, হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ থেকে নিয়ে সালাহুদ্দীন আইয়ুবীসহ আমাদের মহানায়কদের জীবনকাহিনী। প্রজন্মের আগামী উত্তরসুরীর উর্বর ভূমিতে পূর্বসুরীদের শক্ত শেকড় গেঁথে দেয়ার কি অপূর্ব কার্যকর পদ্ধতি।
মাত্র একজন আব্দুত তাওয়াব ইউসুফ তার অব্যাহত কর্মসাধনা ও বিস্ময়কর চিন্তা-চেতনা দিয়ে জয় করেছেন অজস্র অগণন আরব শিশুদের মনোজগত। পশ্চিমাদের বানানো ডাইনোসরের কল্পগল্পের চেয়ে শিশুরা এখন কুরআন-হাদীসে বর্ণিত সত্য ঘটনাগুলো তার লেখায় জানার জন্য অধীর হয়ে থাকে। মাত্র কয়েক বছরে আরব শিশুসাহিত্যে যে অবিশ্বাস্য রুচিবদল করেছেন তিনি, তা সবার বেলায় সম্ভব নয়।
আরবদের সৌভাগ্য, তারা আব্দুত তাওয়াব ইউসুফের মতো শিশুদের জন্য মমতাময় লেখককে পেয়েছে এবং শিশু-সন্তানদের হাতে তার বইগুলো তুলে দিতে পেরেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, হাতেগোনা যে কয়েকজন বাংলায় ইসলামী শিশুসাহিত্যে নিজেদের কলমসাধনা অবিরাম চালিয়ে যাচ্ছেন, আমরা তাদেরকে চিনিনি, তাদের কর্মজগতের সাথে পরিচিত হতে পারিনি। এমন ব্যর্থ অভিভাবকদের সন্তানদের কপালে ‘টম এন্ড জেরী’, ‘মিনা-রাজু’, ‘ডোরেমন’, ‘ঠাকুর মার ঝুলি’, ‘হুতুম প্যাঁচা’র অলীক গল্প ছাড়া আর কী জুটবে? কপালপোড়া বাঙালী।
লিখেছেন- তামীম রায়হান
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।