তার ডানা বাতাস...এবং বর্ষণমুখর মেঘ
হারিয়ে যাওয়া এক নারীর জীবনকথা
(প্রথম পর্ব)
আসিয়া সাখিরী (তিউনিশিয়া)
অনুবাদ : ফায়সাল বিন খালিদ
ত্রিপলী ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভারসিটি, ত্রিপলী, লিবিয়া।
সূচনার পর ...
সমাপ্তির পূর্বে
তোমার ভেঙে পড়ার সময় হয়েছে নারী ! আমি জানি তুমি অচিরেই ভেঙে পড়বে, টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়বে একরাশ তপ্ত অগ্নি খণ্ডে, গুচ্ছ গুচ্ছ ঝলসানো কয়লায়। তোমার সেই বিধ্বস্ত ভেঙে পড়া অংশগুলো প্রচণ্ড ঝাঁপিয়ে পড়বে জীবন ও ভালোবাসার উপর, গলা চেপে মারবে ভিজে নিস্তেজ প্রশান্তিগুলোকে, যার কারণে ধাতব ডানা ঝাপটে শূন্যে উড়তে পারে মৃত্যু। হে আমার নির্বোধ দু:খ...জগতে কি এমন নির্লজ্জ কোন ঈশ্বর আছেন যিনি আমার উপর এই অবিচার দেখে লজ্জা পাবেন না ?
গল্প কিন্তু এখনও শেষ হয় নি। সম্ভবত তা কোন দিন শেষ হবে না।
এই জন্যই তার সূচনাটা আমার জন্য কঠিন। সমাপ্তি না জানলে আমরা কোন জিনিসের সূচনাটা সঠিকভাবে ধরতে পারি না। এবং তখনই ট্রাজেডিগুলো এসে হাজির হয় দুলকি চালে।
এই সব আমি পরওয়া করি না...আমি শুরু করব। শুরু করব এই সবকিছুর মুখে চুন-কালি ছুঁড়ে।
যদিও আমি জানি নাট্যকার এখনও তার নাটকের রক্তাক্ত অধ্যায়গুলোর উপর বিষণ্নতার যবনিকা টেনে দেননি। অনেক দেরিতে হলেও আমি শিখে গিয়েছি কীভাবে এই সব ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো থেকে সেই শক্তি তৈরি করা যায়, যা দিয়ে আমি দমিয়ে রাখব এই দুর্বার উন্মত্ত ইচ্ছাটাকে, যা আমার ভেতর জ্বলছে ক্রুদ্ধ-উন্মাদ এক আগ্নেয়গিরি হয়ে যা সব কিছু ধ্বংস করে ফেলতে চায়। সবটুকু শক্তি ব্যায় করে ছিন্নবিচ্ছিন্ন ছড়িয়ে থাকা বস্তুগুলোকে আমি একত্র করি, তার ভেতর ছড়িয়ে দেই পবিত্র আত্মা, তার বেদিতে বসিয়ে দেই সজীব এক হৃদয়, যার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে রক্তিম-অভিশপ্ত-পবিত্র কামের রক্ত।
ছোট ছোট বিস্তারিত বিষয়গুলো সবময় আমাকে আটকে রাখে। সুদূর ইতস্তত বিষয়গুলো আমার কাছে এসে হাজির হয় আর আমি তার মেরামত ও পুনর্নিমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এবং সেই প্রশ্নটার উত্তর খোঁজার কথা ভুলে যাই, যা আমাকে অজস্র অভিশপ্ত নির্ঘুম রাত্রি উপহার দিয়েছে, দিয়ে যাচ্ছে : বিচ্ছিন্নতা-ইতস্ততার পরদা উন্মোচন করে আমার কি লাভ ? ওদেরকে তাদের বিস্তৃত প্রান্তে স্বাধীনভাবে ঘুরতে দেওয়াটাই কি ভাল নয়? কেন আমি সবসময় বিচ্ছিন্নতার সৌন্দর্যের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করার চেষ্টা করে যাই? নিজ হাতে আমিই কি ওগুলোকে তৈরি করি নি?
এখন আর কোন কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়।
একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আমি এই ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা বিষয়গুলোকে একত্র করব, আমার একান্ত নিজস্ব পদ্ধতি ও মত অনুসারে, যা অধিকাংশ সময়, বরং কখনোই অন্যদের মনপুত হয় না। আমি কোন কিছুতেই আর আনন্দ পাচ্ছি না। আমি একমাত্র আনন্দ ও গর্ব বোধ করি যখন আমি আমার নিজের মত অদ্ভুত কোন কিছু গড়তে পারি। তাই আমার ই"ছা তার শুর"টা হবে অস্পষ্ট, সমাপ্তি অধরা ..দূর ... সুদূর ... বহুদূর, কোন সীমা বা সীমান্তযাকে ধরতে পারে না। কিছু জিনিস আমাদের সবার মাঝে আছে।
তবে সেগুলোর চরিত্র ও রূপ বিভিন্ন হলেও এক সময় তা খুবই সাধারণ হয়ে যায়, একেবারে মাটির কাছে নেমে আসে এবং সেই সাথে আমাদের নিষ্ঠুর হিংস্র দুর্ভাবনাগুলো অর্থহীন হয়ে যায়। যাদের সরব নীরবতাকে আমি পছন্দ করি, তাদের কাছ থেকে শিখেছি আমাকে যদি কোন কিছু বলতেই হয়, তাহলে চিৎকার করে আমাকে বলতে হবে অস্তিত্বহীন বিষয়গুলোর প্রতি আমার ভালোবাসার কথা। যা অস্তিত্বহীন, তবে আমি সবসময় চেয়েছি তা সত্য হয়ে আমার কোলে নিষ্পাপ শিশুর মত হেসে উঠুক। যা প্রত্য-অস্তিত্ববান, যার মাঝে আমরা বাস করছি আনন্দের সাথে বা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে থেকে, যা এই বিরান জগৎ ধ্বংস করে দেবে আমাদের সমাপ্তির অন্ধকার ভীতকর মুহূর্তে-- আমি সেই অস্তিত্ববান জগতের অর্থ খুঁজে পাই একমাত্র অদ"শ্য অস্তিত্বহীন কোন এক জগতের মাঝে।
রাত্রির তীরে তুমি আমাকে পেয়েছ,
এভাবে... নি:সঙ্গ
যৌবনের শুরু থেকেই যে নারী
গভীর অর্থগুলোর ছায়া হেলে পড়ে
পুরোনো আতরের মত তুমি তাকে পিছনে ফেলে গেছ
অধরা কয়েকটি মুহূর্ত
* * *
জীবনকে অতিক্রম করে যাওয়া ?--সে তো মাহা পুরুষদের কর্ম, কিংবা নিছকই সুন্দর একটি কল্পনা।
আমরা যেটা করতে পারি তা হচ্ছে সময় এবং অন্যান্যদের ফাঁকি দিয়ে তার কিছু ছিনিয়ে নেওয়া। কিন্তু সবার প েকি সম্ভব সরাসরি এই বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া? যে সত্যের অনুভূতি ছাড়া এই জগৎ হয়ে ওঠে ভয়ানক রকম অসহ্য দুর্বোধ্য, গুরুত্বপূর্ণ সব কিছুই হারিয়ে ফেলে, এমনকি আমাদের ফোলা ফোলা দগদগে দু:খগুলোও। অথচ সব শেষে এই যন্ত্রণাগুলোই কিনা একমাত্র প্রমাণ হয়ে বেঁচে থাকে যে, সব কিছুর পরও আমরা অনুভূতিসম্পন্ন প্রাণী--মানুষ। আমাদের নিহত ইচ্ছাগুলোর নিজস্ব স্বভাবই আসলে আমাদের হত্যা করে এবং এক চরম নির্বোধতার মাঝে আমরা জীবন চর্চা করতে থাকি। বিষয়টা শুরু থেকেই আমার নিকট স্পষ্ট।
সেই কারণেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই সর্বনাশা নি:সঙ্গতা, যা আমাকে ছায়ার মত অনুসরণ করছে, তার কাছ থেকে পালিয়ে যাব, লিপিকার মৃত্যু থেকে পালাব। তাই এখন আমার যাবতীয় দুর্বলতা সত্বেও আমি ডুবে থাকি একরাশ অর্থহীন শোরগোলের মাঝে এবং এখানে .. এখানেই ... আমার জন্ম নেওয়া উচিত, বেঁচে থাকা উচিত নাম-পরিচয়, মুখাবয়বহীন... মহান কোন ল্য বা উল্লেখ্যযোগ্য কোন স্বপ্ন ছাড়া।
যারা একে অপরকে ঘৃণা করে, আমার জীবন সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে এমন পরস্পর বিরোধী বিভিন্ন শয্যায়। পরস্পর লড়াইয়ের চরম মুহূর্তে সবাই মিলে তারা আমাকে ছুঁড়ে দেয় অদৃশ্যের রোমশ থাবার মুখে। কিন্তু মৃত্যুর অতল গভীর থেকেও আমি তাদের প্রত্যাখ্যান করি, ঝুলে থাকি চিকন একটি সুতা আঁকড়ে, যা আমাকে পৌঁছে দেবে আলোর উপর ঝুঁকে থাকা অসম্ভব ছোট্ট, সরু কোন গুলগুলিতে।
আমার ভেতরে যে উন্মাদ প্রত্যাখ্যান বাস করে তাই আসলে আমার প্রশস্ত অভ্যন্তরের তমসায় নিমজ্জিত প্রান্তগুলোকে আলোকিত করে রাখে। সে যখন জলে উঠে তখন আমার ভিতরে ছড়িয়ে দেয় একরাশ ফুলকি, অনেক সময় যার ফলে আমার ভেতরে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে যায়। আমার ভেতরে দাউ দাউ করে জ্বলছে প্রকাণ্ড এক আগুন। তাই তারা যে আমাকে জাহান্নামের প্রচণ্ড আগুনের ভয় দেখায়, পবিত্র মুহূর্তগুলোতে তার কথা মনে পড়লে আমার মনে দয়া জাগে, আর যখন অবিশ্বাসী ঔদ্ধত্য আমাকে বিধ্বস্ত করতে থাকে তখন জাহান্নামের আগুনের কথা শুনলে আমি প্রচণ্ড ঘৃণা বোধ করি।
আগুন ... ? আল্লাহ ! হে চির পরিচ্ছন্নতার প্রভু তুমি তাকে হাবিয়া দোজখে নিপে কর, তাকে শাস্তি দাও তার চির নির্বোধ দু:খগুলো দ্বারা, তার অভিশপ্ত পাপবিদ্ধ চেতনা দ্বারা, মানুষের মাঝে থেকেও তার নি:সঙ্গতা দ্বারা।
তুমি জান সে তোমার লীলা বুঝেনি এবং এই অজ্ঞতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছে সুতরাং শাস্তি তার প্রাপ্য। তাকে শাস্তি দাও প্রভু ... শাস্তি দাও। আগুন হচ্ছে সেই অনিবার্য অভিশপ্ত উপাদান ঊর্ধ্বে আরোহণের জন্য যার কোন বিকল্প নাই ... আহ ! তপ্ত অভিশপ্ত আগুন... এখন আমি জানি আদিম জাতিগুলোর পবিত্রতার কারণ কি। আগুন হচ্ছে আমাদের সৃষ্টির একটি মৌলিক উপাদান। তাই যদি না হত তাহলে আমার নাড়িতে নাড়িতে জলতে থাকা এই আগুন কোত্থেকে এল?
* * *
পুনশ্চ : এতণ যা শুনলে তোমার বিস্মৃতিপ্রবণ স্মৃতি থেকে তার অধিকাংশই মুছে ফেল।
ধরে নাও তা আমার সেই নকল বিচ্যুত স্বপ্নগুলোর একটি, যেগুলো গেঁথে এক গভীর খাদের পরান্মুখ কিনারায় আমি প্রসাদ নির্মাণ করতে চাইছি।
চল আমরা ছুটে যাই সুদূর প্রান্তে ... সীমা হারা দিগন্তের দিকে। গল্পের তোরণে আমরা একই সাথে ঢুকব। বিশ্বাস কর আমি একা এই গল্প বলতে পারব না। কারণ এটা আমার একার গল্প নয়।
এটা আমার গল্প, তোমার গল্প, তার গল্প-- আমাদের সবার গল্প, যার অদৃষ্টে কোন তীরে নোঙ্গর ফেলার ভাগ্য নাই।
সাতটি বেদনার্ত গান, বর্ষণমুখর রাতে বাতাসের নারীর উদ্দেশ্যে তুমি তা অর্পণ করবে।
প্রথম অধ্যায়
প্রথম গান
যে নারী প্রতি রাতেই তার শেষ নাচের প্রতিশ্রুতি দেয়...
“আমাদের শহর সবসময় তার ব্যাধি ও বেদনাগুলোকে ঢেকে রাখে। আমাদের শহর তার পুরোনো, সংকীর্ণ এবরোথেবরো গলিগুলোয় ঘুরে বেড়ানো লোকগুলোর উদ্দেশ্যে আনন্দ ছড়িয়ে দেয়। তবে সে নিজেও জানে না এই আনন্দের উৎস কোথায়।
কারণ তা তার নিজের ভেতর থেকে উঠে আসে না। আমাদের শহর কখনো তার সন্তান বা ভিনদেশি পথিকদের সামনে নগ্ন হয় না। কেউ তার হারানো মর্যাদার জন্য শোক করুক সেটা ও চায় না।
যে মহান প্রভু নির্দয়ভাবে একের পর এক আবাদ জনপদ ধ্বংস করতে পারেন একমাত্র তিনিই জানেন আমাদের মহান শহরের দুর্বলতাগুলো।
এই বৃষ্টিভেজা দিনগুলোতে আমাদের শহর খুব কথা বলে... সে সারাণ বকবক করতে থাকে, যাতে সে উল্লেখযোগ্য কিছু না বলে ফেলে।
তবে মাঝে মাঝে ও একেবারে চুপ করে যায়। তখন তার সেই বিধ্বংসী নিস্তব্ধতার প্রতিধ্বনিগুলো এক ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটাতে থাকে। “লক্ষ্মী সোনা আমার ! বল আমাকে, আমাকে বল ও তোকে কি গোপন ওছিয়ত করেছে। দ্বিধা করিস না .. অহংকার করিস না। আমাদের শহর প্রভুর হেফাজতে এক গভীর কূপের ভেতর থাকে।
” আমার দাদিমা আমার কানের সামনে সবসময় কান্তহীনভাবে এই সব বলে যেতেন। তখনও আমি এক উচ্ছল কিশোরী, যার অনুর্বর গর্ভে ধীরে ধীরে বেরে উঠছে মৃত্যু, তার নাড়ি বেয়ে উঠে আসছে এক বিকট ব্যর্থতা।
দিনগুলো কেটে যেতে থাকে-- একঘেয়ে, বৈচিত্র্যহীন, ফ্যাকাশে। মাঝে মাঝে নতুন যা ঘটে তাতে আমার আশেপাশের লোকেরা খুশি হতে পারেন না। তবে যারা সবসময় সঠিক সিদ্ধান্তটা দিয়ে থাকেন সেই মুরুব্বিরা তাদের ক্রোধ প্রকাশ করার সাহস করেন না।
শুধু অভিশপ্ত ললাট-পোড়া আমি দেখতে পাই সজীব সবুজ রক্তিম দৃশ্যগুলো একের পর এক শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। বীভৎস উল্লাস ধ্বনি করে তার স্থান দখল করে নিচ্ছে ধ্বংস বিনাশ, মৃত্যুর মত নিস্তব্ধতা ও নি:সঙ্গতায় ভরে যাচ্ছে পৃথিবী। প্রতিদিন সকালে পৃথিবী খুলে দিচ্ছে তার জীর্ণ ঝুলে পড়া স্তন এবং এক দল পচা লাশ মুখভরা লোভ নিয়ে তার স্তন থেকে পান করছে তার বিশুদ্ধ রক্ত। আবার দিন শেষে সন্ধ্যায় পরম মমতায় পৃথিবী তাদের দান করে মাংস-- আকাশের মেঝে জুড়ে পৃথিবী বমি করতে থাকে রাশি রাশি টাটকা মাংস।
আমি জানি এগুলো নিছকই লাশ।
তবে আমি তাদের কথা বলতে শুনি। লাশের পচা গন্ধে ভরে যায় বদ্ধ চরাচর... অবশ্যই এগুলো লাশ, তবে তাদের কপালে দাফনের মর্যাদা জুটে না... কারণ তারা এখনও মৃত্যু পান করে তৃপ্ত হয় নি। ক্রুদ্ধ শূন্যে ছড়িয়ে থাকা ধোঁয়ার শেয়ালের মত তাদের চিৎকার শোনে মনে কর না তারা মৃত নয়।
* * *
এই সন্ধ্যা আমাকে ডাকে, আমাকে আত্মহারা করে দেয়। ব্যাকুল হয়ে প্রেমের কাবা শরীফ ঘিরে আমার তওয়াফ করতে ইচ্ছে করে।
আকাশ জুড়ে ছেয়ে আছে কালো পুরু মেঘ। মনে হয় মেঘের ভারে আকাশ ভেঙে পড়বে ভীত পৃথিবীর উপর। মনে হয় এই আকাশ আমার মাথার উপর ভেঙে পড়বে। নির্দয়ভাবে থেঁতলে দেবে আমার মাথা-মগজ-হাড়-মজ্জা। কানে কানে ফিসফিস করছে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি।
যেন চরাচর জুড়ে একটি দু:খিত গান বাজছে। এই গান আমার প্রতিটি লোমকূপে অজস্র বৈদ্যুতিক তরঙ্গ ছড়িয়ে দেয়। আমার শ্রান্ত মনে জেগে ওঠে এক দুর্বার উদ্যম। তবে আমি জানি এই উদ্যমের নাম মৃত্যু, যার মনে আছে অসীম দয়া এবং জীবনের প্রতি ক্রুদ্ধ সীমাহীন নিষ্ঠুরতা।
জীবন আর মৃত্যু পরস্পর জড়াজড়ি করে অভিন্ন বস্তু হয়ে গেছে এবং তাতে মিশে গেছে জগতের যাবতীয় অর্থ।
আমাকে ছেয়ে আছে পবিত্র পরিচ্ছন্ন এক পরম অনুভূতি, যা আমাকে উড়িয়ে নেয় সপ্ত আকাশ ছাড়িয়ে ... আর আমি অবিরাম ছুটতে থাকি মহাকাশের অনন্ত সীমান্ত ধরে।
শহরটা যখন বদ্ধ থাকে তখনই তার অলিগলিতে ঘুরতে আমার ভাল লাগে। তবে তাকে সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে যখন তার আকাশটা নোংরা হয়ে যায়, বিকট বীভৎস মেঘগুলো সর্বনাশা ঝড়ের বার্তা নিয়ে তার প্রান্তে প্রান্তে ঘুরতে থাকে। আজ শুক্রবার। আজ শহরটা প্রায় ফাঁকা।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক সেদিক ঘুরছে কিছু পথিক, বদ্ধ-ভ্রূ-কোঁচকানো দরজগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে : “রাতের আসরের জন্য পেস্তা খুঁজছ ? লাভ নেই। আজ পেস্তা, বাদাম, কলা কিংবা উচ্ছ স্বরে চেঁচানো পশমহীন রোমান মোরগ... আজ কিছুই বেচা-কেনা হচ্ছে না। এই মিয়া ! লাজুক..উষ্ণ... বেদেনী বউকে খুশি করার জন্য মেহদী, বুটি-করা রুমাল কিংবা রেশমি গাউন খুঁজছ ? নেই। আজ শহরে কিছুই নেই। মনিব ! আপনার বিস্তৃত উদার ছায়াতলে আল্লাহ সবাইকে আজীবন থাকার তৌফিক দান করুন।
আপনি তো এই শহর এবং তার কুৎসিত চেহারাটা পছন্দ করেন না !! তাহলে তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন না কেন ? আপনি তো শুধু শরিয়তসম্মত দরজাগুলোতেই প্রবেশ করবেন। বদ্ধ দরজাগুলো পেরিয়ে আপনি আপনার পবিত্র আত্মাকে কলুষিত করতে চান না। ওগুলো থাক দিশেহারা, নি:সঙ্গতায় বিধ্বস্ত লোকগুলোর জন্য। ওরা ওখানে গিয়ে তাদের অবাধ্য নফসগুলো শান্ত করবে, রক্তাক্ত করবে উদ্ধত রূহগুলোকে। ”
হে রাব্বুল আলামিন ! আমাকে এই রুগ্ণ শহরটাকে ভালোবাসার শক্তি দান করুন।
আমি জানি ও ক্রমশ বিষণ্ন, অবসাদগ্রস্ত এবং বিরান হয়ে যাচ্ছে।
কোন কোন পর্যটক তার আদিম নিস্তব্ধ অবনত দেয়ালগুলোর পাশে গিয়ে বসে, তার উঁচু উঁচু স্তম্ভগুলো ছুঁয়ে দেখে, যেগুলো তার নকল আড়ম্বরহীন গৌরবের কিছু কিছু নিশান এখনও ধরে রেখেছে। তাদের মুগ্ধ অনুসন্ধানী দৃষ্টি ঘুরে বেড়ায় তার পাথরগুলোর উপর, যার গায়ে সময় ফ্যাকাশে কালিতে তার রক্তশূন্য বেদনাগুলো এঁকে রেখেছে। আর আমি নিচু দেয়াল দেওয়া দোকানগুলোর ভেতর ছুঁড়ে দেই আমার পচা আত্মাটাকে।
শহরটা খুবই কান্ত আর আমি দুর্বল এক কিশোরী।
তবে আমি আমার প্রখর মেধাকে সর্বণ শান দিয়ে যাচ্ছি, যাতে আমার বেপরওয়া বুক উঁচিয়ে চলাকে কেউ নির্বুদ্ধিতা বলে অভিযোগ করতে না পারে। ভয়ংকর কিছু দু:স্বপ্ন ক্রমশ নির্দয়ভাবে শহরটাকে বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে এবং একটু একটু করে ছিনিয়ে নিচ্ছে তার খান্দানী সাজ। সুন্দর দিনগুলোতে, যখন আমি ছিলাম নি:সঙ্গ সর্বহারা এক কিশোরী, আমি তার সেই অপরূপ সাজ দেখেছি। তার বিকট বিকট দারগুলোর উপর সবসময় কান পেতে থাকি। আমি সংরণ করে রাখছি তার বিলাপ, শান্ততা এবং দুর্বোধ্য রহস্যগুলো।
আমার শহরকে এখন ওরা কেবলই একটি নীল কল্পনা বানিয়ে ফেলেছে, যা ধ্বংসের জন্য পিপাসার্ত হয়ে আছে। তার বিকট জীর্ণ দাঁতগুলো বের করে আছে প্রচণ্ড ক্রোধে এবং আমাদের অজান্তে, ভয়ংকর নিস্তব্ধভাবে, আমাদের চিবাচ্ছে। এটা কোন ব্যাপার নয়-- এমন ভাব করে আমি চলে যেতে পারি না। আমি কিশোরী, ভয়ংকর এক অপরাধ সংঘটনের প্রত্যদর্শী। আমি অভিশপ্ত নারী।
ওরা আমাকে বাধ্য করছে, ক্রমশ লাঞ্ছনা এবং ঘৃণার দিকে অধঃপতিত আমার স্মৃতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে।
উহহহহ... দু:খগুলো মাটি খামচে ঘুরছে আমার নাড়িতে নাড়িতে। দু:খ ইঁদুরের মত আমার আনন্দগুলো খুটে খুটে খাচ্ছে। আমার আনন্দগুলো আমার সাথে প্রতারণা করে, আমার কাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকে। যেন আমার উপর ওদের পুরোনো কোন লোভ আছে।
দু:খ আমাকে ঝলসে ফেলছে অত:পর কালো পুঁজ গড়িয়ে পড়া সবুজ তগুলো লবণে ভরে দি"েছ।
আমার আনন্দগুলো অর্থহীন। কৃপণ সময় আমাকে বিশুদ্ধ হাসি এবং দ্বিধাপূর্ণ ভালোবাসা দিতে রাজি নয়। অথচ এর খোঁজেই আমি আমার দুই পাকে রক্তাক্ত করেছি। ঊর্ধ্ব জগতের খুঁটিটিও আমাকে আশ্রয় দিতে নারাজ।
বরং আমার উপর অবিরাম তার গজব নাজিল হচ্ছে। যেন এই জগতে আমার জন্মই হয়েছে অবাধ্য বাতাস এবং তপ্ত আগুনের উপর দিয়ে হাটার জন্য।
নিজেকে প্রচণ্ড দুর্বল লাগে। মনে হয় আমার দু:খগুলোর গর্তে ভেঙে পড়ছি অবিরাম। ফিসফিস শব্দ করে বিরামহীন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।
তখন পানির গান শোনার জন্য আমি পাগল হয়ে যাই। পানি ... পানি ... আকাশ ভরা বৃষ্টি দূর..বহু দূরের, কুহেলিকা ও বিস্ম"তির ওপারের বাড়িগুলোর নালাগুলোতে প্রবল ধারায় ব"ষ্টি ঝরে পড়ছে।
আমি সবসময় বৃষ্টি, প্রবল অবিরাম বর্ষণ পছন্দ করি। আকাশের মন কত বড় ! দান করে সে খোঁটা দেয় না। উহ ! কান্নার জন্য আকাশে কত চোখ !! কি সুন্দর আমাদের এই দু:খিত শহর, আদিম সময়ের অলংকার !!! প্রবল নিস্তব্ধতার সরবরে সে গোসল করে পবিত্র হচ্ছে।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।