[পুরান মালামাল চালাতে আমারও বাজে লাগে। কিন্তু লেখাই আসে না হাতে, তার মধ্যে বহুদিন পর ব্লগে একটু আসতে ইচ্ছে করল। তো খালি হাতে কীভাবে আসি! আসিফ মহীউদ্দিনের উপর হামলার পর খুব অশান্তি থেকেই বোধহয় আবার শুরু করতে ইচ্ছে করল। ]
নানি থাকতেন মনুপুর গ্রামে। সেটা সবাই জানে।
আসলে সে নিজেই এই খবরটা জানায় সবাইকে। মানে নানি যে মনুপুর না-থেকে বিদেহীগঞ্জ কিংবা গুমখানা অঞ্চলেও থাকতে পারতেন সেটা খুবই ক্যাসুয়াল একটা বাস্তবতা। সেরকম কোনো একটা জায়গায় নানি থাকলেও লোকজনের বিশেষ কিছু বলার ছিল না। তখন সেটাই মনে রাখত লোকজন। কিন্তু সে বরাবরই তার নানির খবর বলত লোকজনকে, এবং বললে মনুপুর অঞ্চলের বিবরণীই দিয়ে থাকত।
ফলে লোকজনের মনে নানির নিবাস হিসেবে মনুপুর যে গেঁথে আছে তাতে লোকজনের বিশেষ কোনো কৃতিত্ব নেই। কৃতিত্ব বিশেষ নানিরও নেই। যা কিছু কৃতিত্ব তা হলো তার। সে-ই নানিকে জনদরবারে নানানভাবে হাজির রাখে। নানি সম্বন্ধে এটা সেটা সে বলতেই থাকে লোকজনকে।
ফলে এখানের লোকজন নানিকে খুব ভাল চেনে। নানির প্রসঙ্গ এলেই লোকজনের মাথায় মনুপুরও চলে আসে। আবার যদি মনুপুর নিয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা চললেও নানি অবধারিতভাবে চলে আসে। সে নিজেই উদ্যোগী হয়ে এসব আলাপ-আলোচনা জারি রাখে।
নানি মহাজ্ঞানী প্রাজ্ঞ।
নানি অতিশয় অজ্ঞ।
নানি ত্রিকালজ্ঞ।
নানি আম-জনতা।
নানি আম-বাগানের মালকিন।
নানি কৃষিজ।
নানি লোকজ।
নানি ঐতিহ্যবাহী।
নানি নক্সী-কাঁথার ডিব্বা।
নানির ডিব্বা-ভরা পান।
নানির খাল-পাড়ে টাট্টিখানা।
নানি সেইখানেতে যান। ...
নানি সম্বন্ধে হেন কোনো কথা নেই যা সে বলে না। বলাই বাহুল্য, সেগুলো পরস্পরের সঙ্গে অনেক সময়েই বেমানান। কিন্তু লোকজন সেগুলোই পরম পরিতোষের সঙ্গে বিশ্বাস করে থাকে। সবগুলোই।
কারণ লোকজন আসলে তার নানি বিষয়ে স্বতন্ত্র কোনো জ্ঞানলাভের রাস্তা রাখে না। তাছাড়া লোকজন তাকে অসন্তুষ্ট করতেও চায় না। উপরন্তু লোকজন নানান সময়ে নানান কিছু বিশ্বাস করতে ভালবাসেও বটে। ফলে নানি এখানে লোকজনের বিশ্বাসের উপলক্ষ মাত্র। লোকজন তার উপর বিশ্বাসী।
কিংবা সে যেসব কল্পগল্প বলে থাকে সেগুলোতে বিশ্বাসী। অথবা লোকজন ¯্রফে অভ্যাসবশত বিশ্বাস করতে থাকে। সেখানে নানিও থাকে।
সে নিজে যা যা বলে নানিকে নিয়ে তার থেকেও কিন্তু সে আরও অনেক বেশি কৌতূহলী। নানির বিবিধ সম্পদের ব্যাপারে সে বিশেষ খবরাখবর রাখে।
বস্তুত তার আগ্রহ নানির থেকেও নানির বিবিধ সম্পদ নিয়েই বেশি। প্রায়শই তাকে দেখা যায় নানির সম্পদের তালিকা বানাচ্ছে। যদিও হালখাতার মতো একটা খেড়ো-খাতা সে টোল হিসেবে পেয়েছিল এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে, এখানে সে লেখাপত্র করতে পছন্দ করে না। এটা সে বরং তার ড্রইংরুমে নানাবিধ ট্রফির পাশে সাজিয়ে রাখে। আর তার ট্রফিরও অন্ত নেই।
আর সেগুলোর বিবিধ শান-শওকাত। যেমন শূন্যে তিনবার ডিগবাজি খাবার কারণে যে ট্রফিটা সে পেয়েছে সেটার আকৃতি যদি দর্শকের মনে ধরে, তার পাশেরটার উজ্জ্বল ধাতব রঙ দর্শককে মাতাবেই। পাশের ট্রফিটা সে পেয়েছে বিদেহীগঞ্জের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোকে একরাতের মধ্যে খালি করে দেবার কারণে। বস্তুত পাশের গ্রামগুলোও তখন বিদেহীগঞ্জের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। দীর্ঘ গম্বুজের মতো যে ট্রফিটা তার বাম দিকের তাকে রাখা সেটা পাবার ইতিহাস তাকে এখনও আপ্লুত করে রাখে।
নগরপালের ভবনের সাথে পাল্লা দিয়ে আরও বড় ভবন তারই নাকের ডগায় বানাতে পারার পুরস্কার এটি। সূচালো নাকের মতো দেখতে যে ট্রফিটা সেটা পাবার জন্য তাকে অনেক কসরৎ করতে হয়েছে। লোকজন বাসায় বসে বসে কয়বার নাক খোঁটে কিংবা হাঁচি দেয়, নজরদারি করে সেগুলোর নিঁখুৎ পরিপাটি হিসেব কষার জন্য সে অর্জন করেছে এটি। কিন্তু নাক-খোঁটা বা হাঁচি-দেয়াই কেবল নয়, সে আসলে এরকম যাবতীয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম লৌকিক কাজকর্মের খতিয়ান রাখতে পারঙ্গম। ফলত, এই লাইনে তার ট্রফির পরিমান বেসুমারই বলতে হবে।
আসলে ট্রফি নিয়ে বলতে গেলে এখানে ঠিক কুলিয়ে ওঠা যাবে না। ট্রফির বিষয়টাই একটা স্বতন্ত্র এক ইতিহাস হয়ে যাবে। আর বিষয় যে শুধু ট্রফি তা নয়, সে বণিকদের কাছ থেকে নানাবিধ দর্শনীয় বস্তু উপহার পেয়ে থাকে। সেগুলোরও জায়গা ওই ড্রইং। নানাবিধ দর্শনীয় বস্তুপিণ্ড।
অভ্যাগত মেহমানবৃন্দ সেসব দর্শনীয় বস্তুপিণ্ড তো দেখেই, সে নিজেও মুগ্ধ বিস্ময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এগুলো দেখতে থাকে। যাকগে, আলোচ্য বিষয় তার ড্রইংরুমও নয়। বিষয় হলো সেই খেরো-খাতাটি সে কোথায় রাখে। সে রাখে হলো গে ড্রইংরুমে এবং ট্রফি ও শোপিসগুলোর সঙ্গে। সে কারণেই নানির সম্পদের হিসেব-নিকেশ কষতে যে খেরো-খাতা নিয়ে বসে না।
নানান সময়ে তাকে যদি ট্যাব বা আইপ্যাডে টোকাটুকি করতে দেখা যায়, বুঝে নিতে হবে নানির সহায়-সম্পদ নিয়ে হিসেব নিকেশ করছে। কিংবা লিস্টি বানাচ্ছে।
এরকম সময়ে হঠাৎ হঠাৎ কোনো কোনো দুপুরে সে নানিকে ফোন দিয়ে বসে। তার মানে হলো নানির সম্পদ নিয়ে হিসেব-নিকেশ সে আউলিয়ে ফেলেছে। আর তক্ষুনি হন্তদন্ত অস্থির সে একটা ফোন লাগিয়ে দেয়।
নানি অবশ্য বরাবরই বলেছে যে ফোন তার বিশেষ পছন্দের না। এবং টিএন্ডটি লাইনের কাল পর্যন্ত এটা সেটা বলে নানি সেটা ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছিলও বটে। কিন্তু দেশে যেই না মোবাইল কোম্পানি শনৈ শনৈ করে ঢুকতে শুরু করেছে, নানির কোনো বাধাই আর কাজে আসল না। এক তো হচ্ছে মোবাইল কোম্পানিগুলোর টাওয়ার আর বিজ্ঞাপনের অত্যাচারেই নানি যারপরনাই অতিষ্ট। এর মধ্যে সে নিজেও মোবাইল কেনার জন্য নানির উপর মারাত্মক চাপ দিতে শুরু করেছিল।
প্রথমে ঘ্যানঘ্যান, পরে মোবাইলের উপকারিতা বিষয়ে বক্তৃতা ইত্যাদি ছিল তার পদ্ধতি। কিন্তু নানির সুদীর্ঘ বহুবছরের ঘাড়ত্যাড়ামির সঙ্গে এই পদ্ধতিতে সে কিছুতেই সুবিধা করে উঠতে পারছিল না। পরে সে সিকিউরিটি কিংবা নিরাপত্তা বিষয়ক আলাপ-সালাপ তুলে নানিকে কাবু করার চেষ্টা করছিল। মোবাইল ফোন যে নানির নিরাপত্তার জন্য অতীব জরুরি, নানির সর্বক্ষণিক খোঁজ খবর নিতে তার এই ফোনে নানিকে পাওয়া খুব দরকার এসব কথা ইনিয়ে বিনিয়ে সে বলেছে। নানির বয়স যে আর কমছে না সেই অত্যন্ত বেহুদা কথাটাও সে নানিকে মনে করিয়ে দিয়েছে।
মৃত্যুর ভয় নানিকে দেখানোর পর নানি নির্লিপ্ত গলায় খালি জিজ্ঞাস করেছে এই মোবাইল তাকে কদিন বেশি বাঁচিয়ে রাখতে পারবে কিনা। সে তাতে একটু বিব্রত হয়েছিল বটে। পরে সে ধমক-ধামক দেবার রাস্তা নিতেও ভোলেনি। নানির যদি বিপদ-আপদ হয়ে যায় তাহলে যে সে কোনো দায়িত্ব নেবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
নানি খানিক অতিষ্ট হয়েই শেষমেশ মোবাইল নিতে রাজি হয়।
আসলে এই ঘ্যানঘ্যান আর তার পক্ষে বহন করা সম্ভব হচ্ছিল না। এতরকম করে নানিকে পটানোর কারণে নানি খানিকটা আশা করেছিল মোবাইল ফোনটা সে-ই কিনে দেবে নানিকে। কিন্তু সে নানিকেই কিনে নিতে বলে। নানি তার সম্বন্ধে ধারণা রাখে, ফলে অবাক হয়নি। পরে নানি খানিক বুদ্ধি করে খবর পাঠায় যে তার মনুপুর গ্রামে বিশেষ ভাল মোবাইল পাওয়া সম্ভব হবে না।
এমনকি না পাওয়াও যেতে পারে। তাই সে যেন একটা ভাল মোবাইল কিনে পাঠায়। সে-ও আরেক দিন একটা খবর নানিকে পাঠায়। জানায় যে নানির যে বয়স তাতে ভাল মোবাইলের কোনো দরকার নেই। এই মোবাইল তখন খাবে কে! আর মনুপুর গ্রামে মোবাইল পাবার কোনোই সমস্যা নেই।
মোবাইলের দোকান যেন মনুপুর পর্যন্ত স্থাপিত হয় তার জন্য সে অনেক চেষ্টা করেছে। মোবাইল এখন মনুপুরে সুলভ। এমনকি মোবাইল কিনতে যেন আর কোনো কষ্ট কারও না হয় সেজন্য ব্যাঙ্কলোনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। নানি নিশ্চিন্তে এই ব্যাঙ্কে ট্রাস্ট করতে পারে। নানির অবশ্য লোন ছাড়াই মোবাইল কিনতে পারার অবস্থা।
কিন্তু সে চাইল যে নানি যাতে লোনই নেয়। ক্যাশ টাকার মায়ায় নানি সেটাও মেনে নিল। তবে নানি যতই মোবাইল নতুন দেখুক না কেন, দুদিন ব্যবহার করার পরই নানি ঠিকই বুঝল যে তার স্বাস্থ্য-টাস্থ্য বাহানা। আসলে নানির উপর নজরদারির জন্যই এই যন্ত্র তাকে দেয়া হয়েছে। কখন যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে এসব খবর দিতে দিতে নানির জান জেরবার।
একেক দিন তার মনে হতো ছাগলের গলায় ফোনটা বেঁধে দেয়। কিন্তু ছাগলের অসুবিধার কথা ভেবে সেটাও তার করা হয় না।
যাকগে, ওই হিসেব মেলানোর সময়ে সে তড়িঘড়ি নানিকে ফোন লাগিয়ে বসে কোনো কোনো দিন। নানি ফোন কানে লাগিয়েই বলে:
“কি রে আবার মাথায় ক্যারা উঠছে না বড়!”
নানি ইদানীং খুবই ভাল বোঝে যে কখন কীজন্য সে ফোন করে। সেও খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠল:
“বেহুদা প্যাচাল বাদ দাও।
বল তোমার দাদা শ্বশুরের যে এক কলস মোহর ছিল সেইটা ঠিকঠাক মতো মাটির তলায় রাখছ তো? তোমারে না বলছি ওইটা তোমার ঘরের মাটির তলে রাখবা। ”
“ওরে বলদার পোলা বলদা। তোর বুদ্ধিশুদ্দি হাঁটু তামাতই থাকল। মাটির তলে রাখলে তো ইন্দুরে একটা একটা কইরা মুখে নিয়া যাবে। তর চইখ পড়ছে, আর ইন্দুরে মহর চিনব না? কলসি রাখছি আমি টাট্টিখানার নিচে।
ওইখানে কেউ যাবো না। ”
সে মোহর উদ্ধারের চিত্র কল্পনা করতে বসল। সম্ভাব্য কী উপায়ে রূপান্তরিত দ্রব্যাদি ভেদ করে সে কলস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে তার ভাবনায় কাবু হয়ে গেল।
“এইটা কী করছ? মোহর বাইর করা লাগব না?”
“আমার মহর আমি গুয়ের মধ্য থিকা বাইর করব। তর এত চিন্তা কিয়ের?”
নানিও এসব বিষয়ে ছেড়ে কথা বলে না।
সে মাঝেমধ্যেই বুঝে উঠতে পারে না নানির সঙ্গে কথাবার্তায় কীভাবে তাল পাবে। আসলেই কলসি-ভরা মোহর আছে কিনা নাকি নানি আগেই সেটা খেয়ে ফেলেছে নাকি কোনোদিনই ওইটা ছিল না, নানি তাকে খালি বোকা বানানোর জন্য বলেছে, থাকলেও সেটা আসলেই কোন খানে রাখা এসব ভেবে সে দিশেহারা বোধ করে।
আবার অন্য এক দিন ফোন করেই সে আর সময় নষ্ট করে না:
“নানি তোমার পুকুরধারের তেঁতুলগাছটা আর দরকার নাই। কাইটা বিক্রি কর। আমারে কিছু কাঠও দিও আর বিক্রির টাকাটা পাঠায়া দিও।
”
নানিও তেঁতুল গাছ ছাড়ে না:
“ওই চোরার পো চোরা! তেঁতুল গাছে চইখ পড়ছে? আমার খাটিয়া বানাইতেও তো গাছ লাগবে। লাগবে না গাছ?”
সেও কি ছাড়ে?
“ক্যান? তোমার কি গাছের অভাব পড়ছে? তেঁতুল গাছের খাটিয়া বানায় নাকি কেউ? আর তোমার মরার পর খাটিয়া নিয়ে তো তোমার ভাবার দরকার নাই। ”
আমার খাটিয়া কী দিয়া বানাবে তুই ঠিক করবি? তুই তো পারলে খাটিয়া নিয়া বয়াই আছস। খালি আমার চইখ বোজার বাকি। ”
কথাটা এত সত্য যে তার বিশেষ বলার কিছু থাকে না।
কিন্তু সে খুব ভালই জানে যে নানিকে টাইট না রাখলে আরও কাঁধে চেপে বসবে এবং তখন নানির কথার তোড়ের সামনে সে কিছুই করতে পারবে না। এমনিতেই তার কথা বিশেষ আসে না। হাত-পা চালাতে সে ওস্তাদ। নানির খোঁটা শুনে সে বলে:
“আলতু-ফালতু কথা ছাড়ো। আমি না থাকলে তুমি কবেই শ্যাষ হইয়া যাইতা।
আমিই তোমারে ঠিকঠাক মতো দেইখা রাখছি। নাইলে কোন বানের জলে যাইতা গিয়া। ”
“বানের জলের আর বাকি কি রাখছস? শকুনের চইখ তর। সব তর খাওয়া লাগে। মনুপুরের এক ছটাক জমিও তুই ছাড়তে পারস না।
ওই জমিখেকো... একটা গাছও তর ভোগে না দিলে চলে না। তুই তো আমারে বিদেহীগঞ্জ নাইলে গুমখানায় পাঠাইতে পারলেই খুশি। আমিও তরে কই, বাঁইচা থাকতে তুই কিছুই করার পারবি না। মরলে যেইখানে ইচ্ছা পাঠাইস। তুই করোস-ফায়ারে দিস আমারে।
শকুনের বাচ্চা...”
শেষের গালিটা না দিলেও নানির চলত। কিন্তু নানি না-দিয়ে পারে না। ওদের দুজনের যেকোনো সংলাপের এই মোটামুটি পরিণতি। ঐতিহাসিকভাবেই এটা ওদের সম্পর্ক। নানি খুব ভাল জানে যে নানির সহায়সম্পদের দিকেই তার মনোযোগ।
আর দরকার পড়লে তাতে সে নানিকে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করবে না। ফলে নানিও বেঁচে থেকেই মরার জীবন যাপন করতে নারাজ। মুখে খই ফুটিয়ে বাঁচতে চায় নানি।
যদিও নানির সম্পত্তি নিয়ে তার নিশিদিনের ভাবনা, কিন্তু আশপাশের নিজের লোকজনকে বলবার সময় নানির স্বাস্থ্য, নানির নিরাপত্তা, নানির নিবাস ইত্যাদি নিয়েই বলতে থাকে। এমনকি নানির শিক্ষা বিষয়েও সে তার ব্যাকুলতা প্রকাশ করে বসে।
পুরাতন পুঁথি আর ঐশী কিতাবে নানির কিছু তালিম থাকলেও সে বলবার সময়ে নানির আধুনিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর তাতে তার অনাগত উদ্যোগের তালিকা বলতে থাকে। এসব বলার কালে মনুপুর নিয়ে তার মমত্বের ফিরিশতি দিতে থাকে। এসব ফিরিশতি কালে তাকে অশ্র“সজল দেখা যায়। সে স্মৃতিচারণ করতে থাকে কীভাবে সাইকেল চড়ে সে মনুপুর দেখতে যেত। নানি ও তার নানির লোকজনের জীবন সে প্যাডেল মেরে মেরে নিজ চোখে দেখত।
কীভাবে সে গত বছরও সেখানে নতুন নতুন অট্টালিকা আর মোবাইল ফোনের টাওয়ার বসিয়েছে। ধানের জমিতে পপকর্ন চাষ শুরু করেছে। তার লোকজন তখন মনে করিয়ে দেয় যে সেটা পপকর্ন চাষ নয়, বলতে হবে ভূট্টার চাষ। সে তাড়াতাড়ি শুধরে বলে ‘ওই হলো’। মনুপুর তার এতই পছন্দ যে সেখানে গার্মেন্টস কারখানা দেয়া ছাড়াও আগামীতে একটা পরিপূর্ণ মাল্টিপারপাস আধুনিক আবাসিক এলাকা গড়ে তুলতে চায়।
সেখানে থাকবে সে আর তার লোকজন। এভাবেই মনুপুরের প্রতি ভালবাসা সে স্মৃতির মিনার বানিয়ে রাখবে।
আর বলতে থাকে নানির প্রতি তার অফুরান ভালবাসার কথা। নানির সম্পত্তির পরিমাণ নিয়ে একটু আধটু বলে বসলেও সেই সম্পত্তি নিয়ে তার আগ্রহের কথা মুখ ফসকেও সে কাউকে বলে না। নিজের পেটের মধ্যে রেখে দেয়।
এমনকি নিজের মুখের উপর তার পুরাপুরি বিশ্বাস নেই বলে সে নানাবিধ মুখের ব্যায়াম করে থাকে। প্রতি সকালে উঠেই সে প্রাত্যহিক কর্ম সারবার কালে যে অবধারিত বায়বীয় শব্দাবলী ঘটিয়ে থাকে তখনই প্রেসনোট লিখবার কলা-কৌশল মহড়া দিয়ে নেয় সে। প্রকৃতপক্ষে প্রতি সকালে সেই মহড়াতেই সে ঠিক করে ফেলে নানিকে নিয়ে কী কী ধরনের কথা সে সেদিন জনদরবারে পেশ করবে। সেই বায়বীয় শব্দাবলীর মধ্যে তার পেটের মধ্যে জমিয়ে রাখা কথা যেন কিছুতেই বেরিয়ে না-পড়ে তার জন্যও তাকে বিশেষ সতর্ক থাকতে হয়। এরজন্য সে মুখের উপর শাসন করতে পারে এমন বেশ কিছু সেন্সরশিপ সে বিভিন্ন দেয়ালে লিখে রাখে যাতে সেগুলো দেখে মুখ সতর্ক হয়ে যায়।
পেটের কথা যাতে বিশেষ বেরিয়ে না পড়ে সেটার জন্যও সে বিশেষ সতর্কতা নিয়ে থাকে। বলা চলে পেটের ব্যায়াম করে সে এজন্য। তার পেটের ব্যায়ামটি এমন কিছু অভিনব নয়। বেশ সহজ প্রযুক্তির। আরও আরও বেশি জিনিস পেট যাতে ধরে রাখতে পারে সেজন্য সে বেশি বেশি খেতে শুরু করে দেয়।
বেশি খাবার খেতে পারতে সে দেশি ও বিদেশি সব ধরনের খাবারেরই বিস্তর বন্দোবস্ত করে রাখে। এসব সতর্কতামূলক তৎপরতার পরই কেবল সে বাইরে আসে। প্রথমে সে নিশ্চিত হয় মুখ আর পেট তার পুরোদস্তুর নিয়ন্ত্রণে আছে, তারপর কুচকাওয়াজ করতে করতে সে জনদরবারে হাজির হয়। বস্তুত তার জীবনে দুটো অত্যন্ত জরুরি স্তম্ভ হচ্ছে আওয়াজ আর কুচকাওয়াজ। এটা ঠিকই যে আওয়াজ আর কুচকাওয়াজ খুবই সম্পর্কিত তার জীবনে, কিন্তু যত সহজ এ দুয়ের সম্পর্ক মনে হয় ততটা কিন্তু নয়।
তার আওয়াজ জোরদার রাখতে কুচকাওয়াজ করতে হয়, আবার কুচকাওয়াজের জন্যও তার আওয়াজ দিতে হয়। তার মাথায় কোনো কিছু নিয়ে ঝামেলা পাকালে সে কুচকাওয়াজের ব্যবস্থা করে। আবার মাঝে মধ্যে নানির সম্পদ নিয়ে ভেবে ভেবে সে যখন খুশি, কিংবা ভারী উত্তেজিত তখনও সে কুচকাওয়াজ করে। আর দৈনিক প্রাত্যহিক ক্রিয়ার মতো কুচকাওয়াজ করা কিংবা লোকজনকে দিয়ে করানো তো আছেই।
কিন্তু আজ যখন সে নানির সঙ্গে ফোনালাপ সেরে বাইরে বেরোচ্ছে তখন আর প্রাত্যহিক ক্রিয়াদির নৈমিত্তিক বায়বীয় আওয়াজ দিয়ে প্রেসনোট সারতে তার মন চাইছে না।
কিংবা প্রতিদিনের নিয়মিত কুচকাওয়াজ যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না তার। তার মনে হলো বুড়ি বড্ড বেড়ে গেছে। বুড়ির বোঝা দরকার যে তার দয়াতেই সে টিকে আছে। বুড়িকে টাইট না করলে তার অহংকার থাকে না। তাছাড়া বুড়ির সহায়-সম্পদও এতদিন ফেলে রাখার মানে হয় না।
নেহায়েৎ নানিকে জনদরবারে কদর না করলে বদনাম বলে এদ্দিন সে সহ্য করেছে। কিন্তু বুড়ির চ্যাটাং চ্যাটাং কথাতে তার আর ধৈর্য থাকছে না। বদনামের ভয় তার সাজে না। পাজামা খুলে দামামামূলক পোশাক পরার কালে সে আয়নাতে নিজেকে দেখল। একবার তার মনে হলো বটে যে কদিন পরেই বুড়ি মরবে, এখন এই হুজ্জত না করলেই হয়।
কিন্তু এই দুর্বলতা সে বিশেষ পাত্তা না দেবার চেষ্টা করল।
এদিকে নানিও কোনো কারণে বুঝে গেছিল যে পরিস্থিতি আর সে কেবল কথার খৈয়ে ধরে রাখতে পারবে না। মনুপুরের সকল কিছু তার নাতি খাবে। আর তাকেও খাবে। নানি হুঙ্কার দিয়েছিল বেঁচে থাকতে মনুপুর থেকে সে সরাতে পারবে না নানিকে।
নানি জানত এই হুঙ্কার তার মনুষ্য-অহঙ্কার। মনুপুরের ঘোষণাপত্র। কিন্তু ভিতরে ভিতরে নানি আসলে দান ছেড়ে দিতেই চাইছে। নানি ক্লান্ত। কিন্তু নানি নিশ্চিত হতে পারছে না যে নিজে নিজেই বিদায় নেবে নাকি সে যখন আসবে তখন তার লোকজন নানিকে খেদিয়ে দেয়া পর্যন্ত নানি অপেক্ষা করবে।
বিদেহীগঞ্জ কিংবা গুমখানা কোনো জায়গার ব্যাপারেই নানির বিশেষ কোনো ভেদবিচার নেই। এক জায়গায় গেলেই হলো। বিদেহীগঞ্জ কিংবা গুমখানা না হয়ে যদি সওয়ালবাগ বা যাঁতানগর হয় তাতেও নানির কিছু আসে যায় না। সব জায়গার বাসই বড় সুলভ মহাসড়কে।
চৈত্রের খাঁ খাঁ রোদে এরপর দেখা গেল নানি সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
দেশি হোগলায় নিজেকে পুরাপুরি পাটিসাপটার মতো মুড়ে নিয়েছে নানি। বাস আসবে। প্রথম যে বাস পাবে, নানি সেই বাসেই উঠবে। সে যখন একদঙ্গল কুচকাওয়াজ দল নিয়ে মনুপুর উন্নয়ন মহাসড়ক ধরে আসছে, তখন হোগলায় মোড়ানো নানিকে দেখেই সে চিনতে পারল। দূর থেকে একটা বাস এসে হোগলা-নানির সামনে এসে দাঁড়াল।
হতে পারে সেটা বিদেহীগঞ্জের বাস, কিংবা গুমখানার; কিংবা হয়তো সওয়ালবাগ বা যাঁতানগরের। কিছু আসে যায় না নানির। সে ভেবে দেখল তারও কিছু আসে যায় না। গাড়ির লোকজন পাঁজাকোলা করে হোগলা-নানিকে বাসে তুলে নিল।
কুচকাওয়াজ দল তখন গতি দ্বিগুণ করে দিল।
বাসের সামনে এসে তারা তোপধ্বনি করল। বাদ্যদল বাদ্য বাজাল। সঙ্গীত দল গান গেয়ে উঠল। আর সে প্রেসনোট পড়তে শুরু করে দিল। প্রকৌশল দলের লোকজন এসে বাসের গায়ে সবুজ রঙ মাখিয়ে দিল, পতাকা সেঁটে দিল।
নানির কিন্তু সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই। হোগলায় মোড়া নানি তখন ভাবছে যে তেঁতুল গাছটা আসবার কালে সে পুড়িয়ে দিয়ে এসেছে। আর পরদাদার সেই মোহরভরা কলস। সেই কলস উপুড় করে নানি খালপাড়ের অগুনতি টাট্টিখানার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে এসেছে।
নানি জানে কুচকাওয়াজ দল নিয়ে সে কীসের মধ্যে পড়বে।
(জুন-জুলাই ২০১২॥ উত্তরা, ঢাকা)
[ঈদ সংখ্যা যায়যায়দিন ২০১২]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।