আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

++অর্জনই পাওনা, উত্তরাধিকার অবহেলার এবং বিভক্ত পরিচয়

জন্মোপার থেকে পৃথিবী হয়ে অনন্তে >>> ©www.fazleelahi.com

প্রতিটি মানুষই চায় নিজেকে অর্থবহ করে তুলতে, তা যেদিক থেকেই হোক। ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা, কাজকর্ম এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি এক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব ফেলে থাকে; ইচ্ছা-অনিচ্ছাও অনেক সময় গৌণ হয়ে যায় এ পর্যায়ে এসে। কিন্তু গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠার আন্তরিক প্রস্তাবে কিছুমাত্র হের-ফের হয় না, সে তখন জানা-অজানায় সন্ধান করতে থাকে তার পক্ষের উপাদানগুলো। এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম সে যা পায় তা হলো, তার জন্মসূত্রে পাওয়া বংশীয় পরম্পরা, এরই ধারাবাহিক অনুসন্ধানে প্রভাব বিস্তার করে পিতা-মাতার আচার-আচরণ, পরিবারের সাধারণ নিয়ম-পদ্ধতি, স্থানীয় সামাজিক পরিবেশের একটা সম্মিলিত জীবনাচার। একটি মানব শিশু পৃথিবীতে প্রচলিত কোন ভাষা নিয়ে জন্মায় না, যারা তার লালন-পালনের দায়িত্ব নেন তাদের ভাষাই হয়ে যায় তার ভাষা, তাদের জীবন-পদ্ধতিই হয়ে যায় তার স্বাভাবিক জীবনরীতি; এক্ষেত্রে সে কোন্ দেশের, কোন্ ভাষার, কোন্ সংস্কৃতির পিতা-মাতার ঔরসে জন্মালো তা মূখ্য নয়, তার লালন-পালনকারীর ভাষা-বিশ্বাস, সংস্কৃতি-আচারই তার নিজস্ব হয়ে উঠে বেড়ে উঠার সাথে সাথে।

একথা চিরন্তন সত্য যে, প্রতিটি মানব শিশুই জন্মগ্রহণ করে তার স্রষ্টা-প্রদত্ত নিয়ম-পদ্ধতি এবং এসবের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থাশীল হয়েই, পাশাপাশি বয়ে নিয়ে আসে মানবীয় গুণ-বৈশিষ্ট্যও, যার পরিপ্রেক্ষিতে খুব সহজেই সে ধারণ করে নিতে পারে তার চারপাশকে। শুধুমাত্র একটা ব্যাপারে সে নিপতিত হয় দ্বিধা-দ্বন্ধে, তা হচ্ছে তার ইচ্ছা বা পছন্দ। আর এক্ষেত্রে তাকে জগতের প্রতিটি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করে তার প্রাপ্তজ্ঞান, বিবেক ও চিন্তাশক্তি। যেহেতু মানুষের আগমন পিতা-মাতার মাধ্যমে, সেহেতু পৃথিবীতে মানুষের বসবাসের শুরু থেকেই পিতা বা পূর্বপুরুষের পরম্পরা রক্ষা করা একটা প্রাকৃতিক রীতির মতই চলে আসছে এবং এর সাথে জড়িয়ে থাকে মানুষের সামাজিক পরিচয়, রীতি-নীতি, অনেক ক্ষেত্রে গর্ব-অহংকার ইত্যাদিও। প্রভাবের অনেক দিক-বিভাগ থাকলেও এখানে আলোচনা করতে চাই শুধুমাত্র বিশ্বাস এবং আদর্শের দিকটি, যার প্রভাব মূলতঃ অন্য সবকর্মকাণ্ডেই লক্ষ্যণীয়।

যে বংশ বা গোত্র যে বিশ্বাস ও আদর্শকে নিজেদের জন্য বাছাই করে নিয়েছে কিংবা তাদের পূর্বপুরুষরা কোন একসময় জেনে-নাজেনে জড়িয়ে পড়েছে এবং পরম্পরায় ধারণ ও মেনে আসছে, পরবর্তী বংশধররা তাকেই তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে আসছে। আর এই সাধারণ নিয়মটাকে মান্য করে চলছে মানুষের অবচেতন মন অন্যকথায় অসচেতন মানুষেরা, যখনি সে বংশে কোন ব্যক্তি সচেতন হয়েছে, তখনি সে তার জ্ঞান অনুযায়ী খুঁজে-পেতে নির্ধারণ করে নিয়েছে তার নিজস্ব পথ, তার আদর্শ। এই নির্ধারণে সঠিক ও সত্য নির্বাচন করতে না পারলে তার জন্য একথাই প্রযোজ্য যে, অবচেতন ভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে প্রবেশ করেছে সচেতন ভুলে; যার বিভিন্ন কারণ হতে পারে। মুসলমানদের ক্ষেত্রে মূলতঃ সচেতনতার বিকল্প নেই, যদিও বর্তমান অধিকাংশ মুসলমান পরিচয়ই বংশগত। এটাকে একটা সামাজিক বিভক্তিতে ফেলা যায় মাত্র, আদর্শের বিচারে খুবই দুর্বল এই পরিচয়।

বলা যায় মুসলমানদের বর্তমান সংকটাবস্থার পিছনে মূল কারণ হচ্ছে তাদের আত্মবিস্মৃতি। পৃথিবীতে বংশগত মুসলমানের সংখ্যা প্রচুর, সে তুলনায় প্রকৃত পরিচয়-সচেতন মুসলমানের সংখ্যা খুবই নগন্য। ইসলামের সঠিক বিচারে বেশীর ভাগই পারিবারিক পদবী হিসেবে মুসলমান শব্দ ব্যবহারকারীর পর্যায়ে পড়ে, আর একারণেই তাদের দ্বারা ইসলাম শুধুমাত্র সংখ্যাবৃদ্ধি ছাড়া আর কোন উন্নতি পাচ্ছে না। বস্তুতঃ যে কোন আদর্শকে আমরা আমাদের নিজেদের কল্যাণেই গ্রহণ করি, তাই আমাদের সম্মিলিত কল্যাণের ফলাফলই আমাদের আদর্শের ফলাফল হয়ে দাঁড়ায়। মুসলমানগণ কালের যে প্রান্তে এসেই নিজেদের কল্যাণসাধনে যত বেশী অবহেলা করেছে, ইতিহাসে ইসলামের জন্য সে সময়টাই ছিল ভয়াবহ।

উদাহরণস্বরূপ তাতারীদের উত্থান-কালে মুসলমানদের নির্জীবতা এবং পরবর্তী গবেষণায় সে সময়ে নিজেদের ভূমিকা নিয়ে আশ্চর্য হওয়ার ব্যাপারটা উল্লেখ যোগ্য। তবে একথা সুখের যে, বংশগতভাবে মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়ার ফলে ইসলামকে জানা যতটা সহজসাধ্য, এর বাইরে থেকে জানাটা ততটাই কঠিন। শিশু যদি বুঝ-জ্ঞান হবার পর থেকেই আল্লাহ্, রাসূল, আখেরাত, কুরআন, হাদীস, ঈমান, ইসলাম, সৎকাজ ইত্যাদি শব্দগুলো এবং এগুলোর পরিচয়-সংজ্ঞা মুখে মুখে ও প্রাথমিক শিক্ষায় পেয়ে যায়, তাহলে তার পরবর্তী জীবনে এসব নিয়ে ভাবনা-চিন্তা কোনভাবেই অগ্রাহ্য হবার মত নয়। পরন্তু সে যদি এসব ব্যাপারগুলোতে সঠিক জ্ঞান লাভ করতে পারে তবে সিদ্ধান্ত নেয়ার বয়সে এসে নিজের জন্য আদর্শ নির্বাচন তার জন্য সহজ হয়ে যায়। কারণ একটা বিশ্বাস-আদর্শের সাথে তার শৈশব থেকে পরিচয়, পৃথিবীর বাদবাকী বিশ্বাস-জীবনাচার গুলো দেখে সে সহজেই ভাল-মন্দ যাচাই করে নিতে পারবে, যদি তার মধ্যে থাকে সেই সচেতনতাবোধ।

অবশ্য এই সচেতনতাবোধও জাগ্রত করার দায়িত্ব তার পরিবারের, পরিবেশের; অন্যথায় আহার-বিহার সর্বস্ব মানুষ পরিচয় বহনকারীই বাকী থাকবে পৃথিবীতে পদচারণার জন্য। বয়সের একটা পর্যায়ে এসে মানুষ বিচার-বিচেনায় স্বয়ং-সম্পূর্ণতা লাভ করে থাকে, তখন থেকেই আল্লাহ্র আইনে তার ভাল-মন্দের সংরক্ষণ শুরু হয়। এরপূর্বে সে যে ধর্ম বা জীবনাচারের মাঝেই থাকুক না কেন মূলতঃ জীবনের এ পর্যায়ে এসে এবং এখান থেকে বাকী জীবনের যে কোন সময়েই তার জন্য সুযোগ রয়েছে ইসলামকে জেনে-বুঝে গ্রহণ করার। এই গ্রহণ করাটা মুসলিম সমাজের ভেতর থেকে যতটা সহজ ও প্রশংসনীয়, এর বাইরে থেকে ঠিক ততটাই কঠিন ও নিন্দনীয়। আর তাই ইসলামকে জেনে-বুঝে, এ সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান লাভ করে কেউ মুসলমান হলে ইসলাম সম্পর্কে তার যে চেতনা বোধ থাকে, বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত ইসলামী ভাবধারায় সেটা খুব একটা দেখা যায় না।

এ জন্য আমরা দেখতে পাই যে, ইসলামের বিধান ও কর্মে যতটা সাফলতা দেখিয়েছেন প্রাথমিক যুগে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গী-সাথীগণ, ততটা পরবর্তী আর কোন যুগেই দেখা যায়নি। অবশ্য মুসলিম সমাজের ভেতরে থেকেও ইসলামী শিক্ষাকে সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে জেনে-বুঝে যারা গ্রহণ ও চর্চা করে যাচ্ছেন, তারাই যুগে যুগে ইসলামের শিক্ষা এবং সাক্ষ্য নিয়ে শির উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন পৃথিবীবাসীর সামনে। অন্ধকার পৃথিবীতে আলো জ্বালানোর এ দায়িত্ব বনী-ইস্রাঈলের (ইয়াহূদীদের) পর আল্লাহ্ মুসলমানদেরকেই দিয়েছেন। মুসলমানদের এ ব্যাপারে আত্মসমালোচনা থাকা উচিত যে, তার প্রতিটি কর্মকাণ্ড তার প্রভূ আল্লাহ্ তা'আলার নিকট কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে; কিভাবে পাচ্ছে সে মানদণ্ড কুরআন ও হাদীসে সুস্পষ্ট। উত্তরাধিকার সূত্রে যারা মুসলিম, তাদের ভেবে দেখা উচিত যে, যদি সে থাকতো মুসলিম সমাজের বাইরের কেউ এবং তার এই বুঝ আসতো যে ইসলামই দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য একমাত্র শান্তি ও কল্যাণের পথ, তখন তাকে স্বীয় ধর্মমত, পরিবার-পরিজন, সম্পদ-সম্পর্ক ইত্যাদি কত ত্যাগ আর কুরবানী করেই না ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিতে হতো; যেমনটি করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত নওমুসলিমদের।

অথচ কত সহজেই না সে পেয়ে গেল ইসলামকে, ইসলামের শিক্ষাকে; বরং এ শিক্ষা অর্জনে অবহেলার দরুন শাসন পেয়েছে গুরুজনদের কাছ থেকে, এসব কি মোটেই প্রশংসার দাবী রাখে না? বস্তুতঃ আল্লাহ্্র কাছে কোন বান্দার সৎকর্ম গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে দু'টি বিষয়। এ ব্যাপারে আল্লাহ্ তা'আলা বলেন ঃ "হাঁ, যে কেউ আল্লাহ্র কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে এবং সৎকর্মশীল হয়, তার প্রতিদান তার রবের কাছে রয়েছে এবং তাদের কোন ভয় নেই ও তারা দুঃখিতও হবে না। " [সূরা আল-বাকারাহ্ ঃ 112] এখানে আল্লাহ্র নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ ব্যাপারটা আত্মিক বা বিশ্বাস-চিন্তা-চেতনাগত এবং সৎকর্ম তো পরিস্কার যে কর্মগত ব্যাপার, আর এ সৎকর্মের শিক্ষক হিসেবেই আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে পাঠিয়েছেন আমাদের কাছে তাঁর কিতাব আল-কুরআনসহ। আল্লাহ্ এবং বিশ্বাসের অন্যান্য বিষয়গুলোতে ইখলাছের সাথে পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিপূর্ণ সঠিক আনুগত্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ইসলামের যাবতীয় কল্যাণ। আল্লাহ্্র ইখলাস ও রাসূলের আনুগত্যের ব্যাপারে মানুষের অবস্থান চার পর্যায়ে ঃ 1) কারো কারো ইখলাস নেই, রাসূলের আনুগত্যও নেই, সে ব্যক্তি মুশরিক, কাফের।

2) কারো কারো ইখলাস আছে, কিন্তু রাসূলের আনুগত্য নেই, সে ব্যক্তি বিদ'আতকারী। 3) কারো কারো ইখলাস নেই, কিন্তু রাসূলের আনুগত্য আছে (প্রকাশ্যে), সে ব্যক্তি মুনাফেক। 4) কারো কারো ইখলাসও আছে, রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণও আছে, সে ব্যক্তি হলো প্রকৃত মুমিন। বংশগত মুসলিমদের মধ্যে এই চার শ্রেণীই বিদ্যমান; এ ব্যাপারে সে জানুক বা না জানুক যে কোন এক পর্যায়ে তাকে পড়তেই হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ঃ 'মহান আল্লাহ্ তোমাদের শরীর ও আকৃতির দিকে দেখেন না; বরং তোমাদের হৃদয় ও কর্মের দিকে দেখেন।

' [মুসলিম ঃ 2564] সুতরাং নিজেকে যে যেভাবেই অর্থবহ কিংবা গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চাই না কেন, আমাদের উচিত আত্মবিস্মৃত না হওয়া, নিজ নিজ পরিচয় ভুলে না যাওয়া এবং এ চেতনা সর্বদা জাগ্রত রাখা যে, যত সহজেই আমি ইসলামের মত সুবিশাল কল্যাণ-সম্পদ লাভ করেছি, তা অর্জন করতে অন্যদেরকে কি পরিমাণ ত্যাগ করতে হয়। 'লোকে বলে মন্দ তাই আমিও পেতে শুরু করলাম গন্ধ' -এমন চিন্তাবিদ বুদ্ধিজীবী হওয়ার চাইতে মালিক আর বকরীর পাল চেনা রাখাল অনেক কল্যাণের, পৃথিবীর জন্য, মানবতার জন্য। আল্লাহ্ আমাদেরকে সকল পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করে আত্মপরিচয় জানা সত্যিকারের মুমিন হওয়ার তাওফিক দান করুন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।