আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার ছাত্রশিবির জীবন-7

যা বুঝি, যা দেখি, যা শুনি এবং যা বলতে চাই

বড়মামার উসকানিতে ইমাম গাজ্জালি আর এদিকে রফিকের মারিফত দর্শন পড়ে আমি ততদিনে বুঝতে শুরু করেছি ছাত্রশিবিরের ইসলাম সংক্রানত্দ ব্যাখ্যাটাতে গলদ আছে। ছোটবেলায় মাদ্রাসায় পড়েছে এমন এক বন্ধু আমাকে তখন অন্যরকম কিছু ইসলামী বই দিলো। যেখানে ওয়াহাবী ইসলাম, মওদুদীর ইসলাম যে সত্যিকার ইসলাম নয় সে সম্পর্কে বিসত্দারিত লেখা। তাতে হাদিসের নানা উদ্ধৃতি যে নবী মুহাম্মদ ভবিষ্যত বাণী করে গিয়েছিলেন যে তার অনুসারীরা বিভিন্ন ফেরকায় বিভক্ত হবে আর একটা মাত্র অংশই বেহেশতে যাবে। কারো কারো মতে সে দলটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত।

এই সুন্নী জামায়াতের লোকজন আবার ছাত্রশিবির তথা জামায়াতে ইসলামীর ঘোর বিরোধী। নানাবাড়িতে যখন ছিলাম তখন নানাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমরা কোন ঘরানার মুসলমান। নানা জানিয়েছিলেন আমরা কাদেরিয়া। ছাত্রশিবিরের বইপত্রে আব্দুল কাদের জিলানীর কোনো উল্লেখই দেখি না। তারা অবশ্য পীর-মুর্শিদ বিরোধী।

নবী মুহাম্মদকে সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি মর্যাদা দিতে তারা নারাজ। কবর ভেঙে সমান করে দেয়ার ঘটনাও তারা ঘটিয়েছে। এসব তো গেল ইসলামী দল হিসেবে তাদের বিভিন্ন সমালোচনার দিক। এর সাথে যুক্ত হয়েছে জামায়াতে ইসলামের স্বাধীনতা বিরোধী ভূমিকা। আমি এতোটা নির্বোধ কখনও ছিলাম না যে নিজ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধীদের কর্মকান্ড বিনাবাক্যে মেনে নেবো।

আমার কিছু কিছু বন্ধুরা জামায়াত-শিবিরের স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকান্ডের নানা তথ্য ও সে সম্পর্কিত বই আমাকে সরবরাহ করতে লাগলো। আমি তথ্যগুলো সযত্নে টুকে রাখলাম। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক ছিলেন, গাজীপুর ক্যান্টনমেন্টেই চাকুরি করতেন তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার পাঁচ পাঁচটি ছেলে শহীদ হয়েছেন। ঘটনাটি তাকে মানসিকভাবে বিপর্যসত্দ করে ফেলেছিলো।

একটু আউলা থাকতেন তিনি সবসময়। ছুটির দিন বিকাল বেলায় পার্কে তিনি আমাদেরকে গোল করে বসিয়ে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গল্প বলতেন। এর নাম দিয়েছিলেন তিনি 'উইকলি কুইক ক্লাস'। তার মাধ্যমেও স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাই। সব মিলিয়ে এই তিনরকমের বিরোধী বক্তব্যগুলো সম্পর্কে শিবিরের নেতাদের মতামত জানার জন্য তাদের কাছে প্রশ্নগুলো করি।

ভাওয়াল বদরে আলম কলেজ তখনও সরকারী হয়নি। সেখানে ছাত্রশিবিরের কর্মশালা হতো। সেই কর্মশালায় ঢাকা থেকে আসা শিবির নেতাদের কাছে প্রশ্নগুলো করে জবাব জানতে চাই। স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াত নেতাদের ভূমিকা, মূলধারার সুন্নী ইসলামের সাথে ওয়াহাবী ইসলামের বিরাট পার্থক্য ও বিরোধ, মারিফত, তরীকতের মত ইসলামের অন্যান্য ধারাগুলোকে একেবারে অস্বীকার এসব বিষয় নিয়ে আমার প্রশ্নে তারা খুবই আহত ও হতবাক হয়ে পড়েন। আমি পরে জানতে পারি যে, তারা বিস্মিত হয়ে স্কুলের দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে জানতে চেয়েছেন আমি কিভাবে ছাত্রশিবিরের কর্মী হলাম।

স্কুল পর্যায়ে ছাত্র সংগঠন থাকার কথা নয়। বিভিন্ন সংগঠনের নামের আড়ালেই ছাত্রশিবিরের কাজ চলতো। কিন্তু বেশিদিন একে আর লুকিয়ে রাখা যায়নি। অভিভাবকদের অভিযোগের কারণে সমরাস্ত্র কারখানার মহাপরিচালক এ বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রধান শিক্ষককে বলেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দল তখন হুমকি দেয় যে, স্কুল পযায়ে যদি কোনো রাজনৈতিক দল কাজ করে তবে আমরাও আমাদের ছাত্র সংগঠনের কাজ শুরু করবো।

বিরোধ তখন বেশ প্রকাশ্যে চলে আসে। স্কুলে অনত্দত: ছাত্রশিবিরের কর্মকান্ড গুটিয়ে যায়। তবে কর্মীরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রেখে স্কুলের বাইরে নিয়মিত মিলিত হতে থাকে। এইসব গোপনীয়তার কারণে আমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। একসময় খেয়াল করি আমাকে এড়িয়ে চলছে অনেক কর্মী।

কাউকে জিজ্ঞেস করে কোনো সদুত্তর পাইনি আমি কিন্তু নিজেই বুঝতে পারি যে আমাকে বাদ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এমন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শিবিরের মনোনয়ন না পাওয়ায় শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি শিবির ত্যাগ করেন। এরকম আরো কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটায় শিবির আরো সাবধান হয়ে আরো গুছিয়ে কাজ শুরু করে। ততদিনে আমি শিবির বিরোধী তথ্যে নিজেকে সমৃদ্ধ করে ফেলেছি। আমরা তখন ওল্ড টেন।

নিউ টেন আমাদের এক বিদায় সম্বর্ধনার আয়োজন করে। সেই সভায় আমাকে আমার ক্লাসের পক্ষ থেকে বক্তৃতা দিতে বলা হয়। শিবির সম্পর্কে আমার জানা সব তথ্য তাদের কর্মকান্ড সব আমি সেই অনুষ্ঠানে স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকদের সামনে প্রকাশ করি। নবীন ও অপেক্ষাকৃত বয়সে ছোট ছাত্র-ছাত্রীদেরকে এ বিষয়ে সাবধান হতে অনুরোধ করি। স্কুল পর্যায়ে রাজনীতি বন্ধ করার জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষ ও স্কুল শিক্ষকদেরকে অনুরোধ করি।

স্কুল শিক্ষকদের মধ্যে দুজন জামায়াতের অনুসারী ছিলেন। তারা ছাড়া বাকীরা আমার সৎসাহস ও উপলব্ধির প্রশংসা করেন। কিন্তু আমার শিবির বন্ধুদের কাছে আমি চির শত্রম্নতে পরিণত হয়ে যাই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.