আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুমাইয়া থাকবে না, থাকবেন দেলোয়ার!

সুমাইয়া মারা যাবে। ১৬ বছর বয়স ওর। এই বয়সে কত কী প্রিয় থাকে কিশোরীর। সুমাইয়ার কোনো প্রিয় রং নেই, ও জানে মানুষ ৪০-এর বেশি বাঁচে না। ওর কোনো স্বপ্ন নেই; ওর মায়ের বয়স এখন ৩৩।

মা যদি ৪০ পর্যন্ত বাঁচেনও, ও বাঁচবে না। সুমাইয়ার মায়ের একটি স্বপ্ন ছিল। ইটভাটায় যতই তিনি হাড়জ্বালানো খাটুনি খাটতেন, ততই স্বপ্নটা তীব্র হতো। বাচ্চা মেয়েটি পোশাক কারখানায় অনেক ওভারটাইম করে কিছু বাড়তি টাকা যখন পেত, তখন স্বপ্নটা সম্ভব মনে হতো। মায়ে-ঝিয়ে মিলে তাঁরা টাকা জমাচ্ছিলেন, ঘর তুলবেন গ্রামে।

তারপর দুজনে মিলে চলে যাবেন, এই শহরে আর ভাল্লাগে না। সেই স্বপ্নটাও ধসে গেছে রানা প্লাজার মতো, পুড়ে গেছে তাজরীন ফ্যাশনসের মতো।
বাঁচলেই না তবে মানুষ স্বপ্ন দেখে। সুমাইয়া আর বাঁচবে না। মেহনতের ঘামের প্রতিটি ফোঁটা দিয়ে যে সঞ্চয় করেছিল, তা-ও শেষ।

তবু যমের মুঠি আলগা করে বেঁচে থাকবে—এই আশা ফুরায় না মা-মেয়ের। যন্ত্রণা অসহ্য, তার থেকে অসহ্য যে মৃত্যু! অসহ্য ব্যথায় মায়ের হাত কামড়ে রক্তাক্ত করে করেও বাঁচতে চায় সুমাইয়া। কিন্তু দেলোয়ার হোসেনকে কিছুই করতে হয় না। সরকারিভাবে অন্তত ১১১ জন পোশাকশ্রমিকের মৃত্যুর দায় নিয়েও তিনি ফুরফুরে ঘুরে বেড়ান। তিনি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ আগুন-বিপর্যয়ের নায়ক।

তাঁর কৃতকর্মের ফলে হাজারের বেশি শ্রমিক আহত-পঙ্গু-সর্বস্বান্ত হন। তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি সরকারের ‘সদয় বিবেচনার জন্য যে সুপারিশগুলো করেছিল’, তার প্রথমেই লেখা ছিল, ‘...এত বিপুল মৃত্যুর জন্য মালিকের অমার্জনীয় অবহেলাই দায়ী। এটা সুস্পষ্টভাবে অবহেলাজনিত মৃত্যু ঘটানোর অপরাধ। তাই তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের মালিককে দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারায় আইনের আওতায় এনে বিচারে সোপর্দ করার সুপারিশ করছি। ’ প্রতিবেদনে দেলোয়ার হোসেনের পাশাপাশি কারখানার আরও নয় কর্মকর্তাকেও বিচারে সোপর্দ করার সুপারিশ করা হয়।


সেই সদয় বিবেচনা সরকারের মনে জাগেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের নিজেদের তদন্ত প্রতিবেদনও ‘গোপন’ করে রাখে; এবং দেলোয়ার হোসেন ‘স্বাভাবিক’ জীবন যাপন করতে থাকেন। সুমাইয়া ছিল তাঁরই কারখানার শ্রমিক। সুমাইয়াকে তিনি দেখতে যাননি, বিজিএমইএ সুমাইয়াকে কিছু দেয়নি। বরং ভুল চিকিৎসার পথে ঠেলে দিয়ে মৃত্যুটা নিশ্চিত করেছে।


সরকারের কাজ যখন সরকার করেনি, তখন এগিয়ে এসেছিলেন একদল তরুণ নৃবিজ্ঞানী ও আইনজীবী। সরকারি তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য, অবহেলাজনিত মৃত্যুর দায়ে দেলোয়ারের বিচার চেয়ে রিট পিটিশন করেন তাঁরা। উচ্চ আদালতে শুনানির পর শুনানি হয়, দেলোয়ার হোসেনকে আগের চেয়ে আরও আত্মবিশ্বাসী মনে হয়। আদালতকক্ষ থেকে তিনি যখন দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে গটগট করে চলে যান দামি উকিলের শৌখিন চেম্বারে, তখন আদালতের বারান্দায় তিন মেয়ে হারানো বাবা বাবলু মিয়ার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে।
এ দেশে দেলোয়ারদের কিছু হয় না, কিন্তু সুমাইয়ারা বারে বারে মরে যায়।

শুধু মরে না, পৃথিবীতে যত কষ্ট মানুষকে দেওয়া সম্ভব, তার সবই তাকে ভোগ করতে হয়। শৈশবের না-খাওয়া, কিশোরীকালে হাড়ভাঙা খাটুনির পরও তাদের জন্য অপেক্ষা করে কারখানার আগুন বা ধস, রাস্তায় মাস্তানের আগ্রাসী হাত, দুরারোগ্য ব্যাধি।
সুমাইয়াকে প্রথম দেখতে যাই গত ঈদের আগে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি ওয়ার্ডে শুয়ে ছিল। বাঁ চোখটি ঠেলে বেরিয়ে আসছে।

চোখের পাশ থেকে নাকের নিচ পর্যন্ত সেলাইয়ের দাগ। তাজরীনে আগুন লাগার তিন দিন আগের একটি ছবি আছে ওর, মুঠোফোনে তোলা। ১৮ ঘণ্টা কাজ করেও পরির মতোই ছিল সে। সেই পরিটি আগুনের মধ্যে কারখানার ফ্লোরে ছোটাছুটি করতে গিয়ে মেশিনে ধাক্কা খায়। নাক ফাটে।

পরিটি তখনো নিঃশ্বাস টানছিল, যে নিঃশ্বাসে রাসায়নিক পোড়া ধোঁয়া, মানুষের মাংস পোড়া গন্ধ। তারপর কীভাবে আরও সবার সঙ্গে গ্রিল ভেঙে উঁচু থেকে লাফ দিয়ে পড়েছিল পাশের বাড়ির চালে, ওর মনে নেই। খবর পেয়ে আশুলিয়ার ইটভাটা থেকে মা আসেন, মেয়েকে নিয়ে বাসে ময়মনসিংহ রওনা হন। রক্ত থামাতে চার-পাঁচটি ওড়না ভিজে যায়। ময়মনসিংহের এক ম্যাটার্নিটি ক্লিনিকে অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই নাকে কাটাছেঁড়া চলে।

খরচ ৬০ হাজার টাকা। ফলাফল, বাঁ চোখটি ক্রমশ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়, দৃষ্টি চলে যায়, মাথার ভেতর চলে অসহ্য যন্ত্রণা। তারপর ঢাকায় এসে কত কত হাসপাতাল, ক্লিনিকে ঘোরাঘুরি করে জমানো টাকা শেষ করা। তার দরকার ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে যাওয়া। কিন্তু অভিশপ্ত বিজিএমইএর গণ্ডমূর্খ মেডিকেল অফিসার একপ্রকার বাধ্য করেন ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হতে।

অথচ সেখানে ওর অসুখের কোনো চিকিৎসা নেই। মাথার মধ্যে ‘ক্যানসারাস টিউমার’। চিকিৎসকেরা বলে দিয়েছেন, কিছু করার নেই আর। কিছু যখন করার থাকে না, তখনো তো অসহ্য যন্ত্রণা থেকে বাচ্চা মেয়েটি পরিত্রাণ চায়। ও পরিত্রাণ চায় ওর মাথার ভেতরের আগুনের পোকাগুলো থেকে।

ওর বিশ্বাস, তাজরীনের সেই মরণসন্ধ্যায় নিঃশ্বাসের সঙ্গে ওর মাথার মধ্যে অনেকগুলো পোকা ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলোই এখন কুটকুট করে ওর মগজ খেয়ে ফেলছে!
যদি সঠিক চিকিৎসাটা গোড়া থেকেই পেত, তাহলে হয়তো সুমাইয়া বেঁচে যেতে পারত। কিন্তু কেউ ছিল না তার, না তার সরকার, না তার মালিক, না মালিকের মালিক বিজিএমইএ। সুমাইয়াকে এখন দেখে রাখে, চিকিৎসার খরচ জোগায় অ্যাক্টিভিস্ট নৃবিজ্ঞানী নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী চক্র। নৃবিজ্ঞানী সায়দিয়া গুলরুখ আর সুমাইয়ার সম্পর্কটা অদ্ভুত। পরস্পরকে ওরা মা ডাকে।

সুমাইয়া তার এই নতুন পাওয়া মাকে না খাইয়ে ছাড়ে না, সায়দিয়ারও জীবন থমকে আছে সুমাইয়ার বিছানার পাশে। তাঁরা চাঁদা তুলে সুমাইয়ার চিকিৎসা তহবিল চালান। (অ্যাকাউন্ট: Sumaya khatun, Pubali bank, Principal branch, Islamic banking window, Dhaka) উকিলের কাছে দৌড়ান, সাংবাদিকদের নিয়ে যান সুমাইয়ার কাছে। দেলোয়ার হোসেনের দায় ওঁরা সবাইকে মনে করিয়ে দেন।
সায়দিয়া আর নাজনীন শিফা মিলে উচ্চ আদালতের দরবারে রিট পিটিশন করেছেন, কেন অবহেলায় মৃত্যুর অপরাধে দেলোয়ার হোসেনের বিচার হবে না! যথারীতি ফুরফুরে মনে দেলোয়ার আদালতে হাজির হন, হাজির হন তাজরীনে নিহত কিন্তু ক্ষতিপূরণ না পাওয়া শ্রমিকদের আত্মীয়স্বজনেরা।

তাঁদেরই একজন একদিন আদালতের বারান্দায় দেলোয়ার হোসেনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনার ঘুম হয়? আপনার সন্তানেরা আপনাকে ঘৃণা করে না?’ যে দেলোয়ার শ্রমিকের ঘাম আর শিশুদের প্রাণের দামে কোটিপতি হয়েছেন, যাঁকে হত্যা, নাশকতা, পরিকল্পিত অবহেলা ইত্যাদির জন্য বিচারের হাতে সোপর্দ করার সুপারিশও সরকার চেপে গিয়েছে; সেই দেলোয়ারের মানুষের অভিশাপ পরোয়া না করারই কথা।
ঘটনার পর অনেকের মতো আমিও তাজরীনে গিয়েছিলাম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন, অ্যাক্টিভিস্ট নৃবিজ্ঞানীদের গবেষণা এবং কাণ্ডজ্ঞান থেকে দেলোয়ারের কাছে অনেকগুলো প্রশ্ন আমরা করতে পারি: ১. ফায়ার অ্যালার্ম বাজার পরও কেন শ্রমিকদের বলা হয়েছিল আগুন নেভানো হয়েছে। কেন সবগুলো দরজায় তালা লাগানো হয়েছিল। কেন মজুত থাকা সত্ত্বেও পানির হোসপাইপ বা অক্সিজেন সিলিন্ডারের একটিও ব্যবহূত হয়নি? কেন কর্মকর্তাদের একজনেরও কিছু হলো না, কিন্তু মারা গেলেন এতগুলো শ্রমিক? কেন আগুন লাগার আধা ঘণ্টা পরে দমকল বাহিনীকে খবর দেওয়া হয়েছিল? সরকারের প্রতিও জিজ্ঞাসা: এত প্রমাণ, এত অভিযোগ থাকতেও এই ব্যক্তিকে কেন আইন ছুঁতেই পারছে না? কেন আজ পর্যন্ত একজনও অভিযুক্ত পোশাকমালিকের বিচার হলো না? কেন সুমাইয়ারা ধুঁকে ধুঁকে মরবে আর দেলোয়াররা দায়মুক্তি পাবেন?
পোশাকশিল্পের মেয়েদের অনেকের অপরিণত, প্রতিবন্ধী কিংবা মৃত সন্তান হচ্ছে।

কর্মপরিবেশের কারণে অথবা দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিকেরা জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। বস্ত্রশিল্পে কী হচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণা চালানো জরুরি। আমাদের কাছে তাজরীন ও রানা প্লাজার হতাহত ব্যক্তিদের অনেক স্মৃতিচিহ্ন। অজস্র আইডি কার্ড, ছবি, স্যান্ডেল, ফিতা, মাতৃত্বকালীন ছুটির দরখাস্তসহ কত কিছু। এসব নিয়ে আমরা কী করব? একটা জাদুঘর করব; যার নাম হবে মৃত্যুর কারখানা।

সেই জাদুঘরের উদ্বোধন করবেন কোনো ‘নিরপরাধ’। যিনি আইনের ঊর্ধ্বে, তাঁর থেকে নিরপরাধ আর কে? সুমাইয়াকে বিদায় দিয়ে আসুন আমরা দেলোয়ার হোসেনের হাত দিয়েই সেই মৃত্যুর জাদুঘরের উদ্বোধন করাই!
সুমাইয়া হয়তো মরে বেঁচে যাবে, আমাদের রেখে যাবে দেলোয়ারদের সঙ্গে এক বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য। যে বাতাসে তাজরীনের পোড়া লাশের গন্ধ আর সুমাইয়ার মাথার ভেতরের আগুনপোকারা ভাসে।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।